আতাইকুলা বধ্যভূমি ও গণকবর (রাণীনগর, নওগাঁ)
নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলায় অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় এখানে শতাধিক মানুষকে হত্যা করে কবর দেয়া হয়।
নওগাঁ জেলার রাণীনগর উপজেলার আতাইকুলা গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় এপ্রিল, জুন ও জুলাই মাসে তিনবার গণহত্যা, নারীনির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ চালায়। এতে গ্রামের শতাধিক মানুষ নিহত হয়। অনেক বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত হয়। অন্তত ৫০ জন নারী পাকসেনাদের হাতে পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। গণহত্যায় নিহতদের গ্রামে গণকবর দেয়া হয়। বারবার গণহত্যা সংঘটিত হওয়ায় আতাইকুলা গ্রাম বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। রাণীনগরের একটি হিন্দু-অধ্যুষিত, বর্ধিষ্ণু ও সমৃদ্ধিশালী গ্রাম আতাইকুলা। নওগাঁ শহরের দক্ষিণে ১৬ কিলােমিটার দূরে ছােট যমুনা নদীর পশ্চিম প্রান্তের কোলঘেঁষা এ গ্রামটি মীরাট ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত। পাকহানাদাররা বিহারি রাজাকারদের সহায়তায় গ্রামটিতে নৃশংস হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে।
পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রথম ২৫শে এপ্রিল আতাইকুলা গ্রামে হানা দেয়। তারা গ্রামটির চারদিক ঘিরে ফেলে। এ গ্রামের হিন্দু-অধ্যুষিত পালপাড়া ধ্বংস করা ছিল তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। গ্রামে ঢুকে পাকসেনারা পালপাড়ার সকল মানুষকে স্থানীয় জনকল্যাণ হাইস্কুল মাঠে একত্রিত করে। এরপর ঘােষণা করে যে, যারা টাকা দেবে তাদের ছেড়ে দেয়া হবে। দুজন টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করায় সঙ্গে-সঙ্গে তাদের গুলি করে হত্যা করে। চোখের সামনে এ নির্মম হত্যাকাণ্ড দেখে আর কেউ টাকা না দেয়ার কথা বলতে সাহস করেনি। হানাদারদের কড়া প্রহরায় যে যার সাধ্যমতাে টাকা, স্বর্ণ ও মূল্যবান সম্পদ হানাদার বাহিনীর সদস্যদের হাতে তুলে দেয়। এসব সংগ্রহ করার পর তারা গ্রামে তল্লাশি চালায় এবং টাকা, সােনার গহনা ও জিনিসপত্র লুট করে। তারা বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। এতে পালপাড়ার ৩০-৪০টি বাড়ি সম্পূর্ণভাবে ভস্মীভূত হয়। গ্রামের প্রায় ৫০ জন নারীকে বন্দি করে তাদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পাকসেনারা অনেক বাড়ি থেকে পুরুষ ও যুবকদের ধরে আনে। সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তারা সারা গ্রামে নারীনির্যাতন, লুটতরাজ ও অগ্নিসংযােগ চালায়। এরপর আটক করা ৬০ জনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ‘জয় বাংলা বলতে হ্যায়, নৌকামে ভােট দিতে হ্যায়’ ইত্যাদি বলে ব্রাশ ফায়ার করে। এতে ঘটনাস্থলে বহু গ্রামবাসী নিহত হয়। পুকুরে কচুরিপানা মাথায় দিয়ে লুকিয়ে থাকা অবস্থা থেকে শিবেশ্বর সূত্রধরকে তুলে এনে পাকসেনারা হত্যা করে। ভাদু পাল নামে একজনকে রাস্তায় হত্যা করা হয়। যােগেন্দ্রনাথ পালের বাড়িতে প্রথমে হানাদাররা সুরেশ্বর ও লঙ্কেশ্বর নামে দুজন বয়স্ক ব্যক্তিকে সকলের সামনে গুলি করে হত্যা করে। এসময় আতাইকুলা হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক রঞ্জন কুমার সাহা দৌড়ে পালিয়ে যাবার সময় গুলিবিদ্ধ ও আহত হন। হত্যাকাণ্ড শেষে যাবার সময় খেয়াঘাটের মাঝি রঘুবীর ও তার যুবক ছেলে ফিরিঙ্গিকে নৌকাতেই হানাদার সৈন্যরা গুলি করে হত্যা করে। এ গ্রামে পাকসেনাদের প্রবেশ করার আগে ও পরে তাদের বিক্ষিপ্ত গুলিতে ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় ৬-৭ জন নিরীহ গ্রামবাসী নিহত হয়। সবমিলে এদিন ৫২ জন মানুষ প্রাণ হারায়। লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা প্রদ্যুত পাল, ভবেশ্বর পাল, নিধিরাম পাল, গিরিন্দ্র চন্দ্র পাল, মলিন্দ পাল, নৃপেন চন্দ্র পাল ও সাধন চন্দ্র পাল বেঁচে গেলেও সেদিনের চরম ভীতি এখনাে তাদের আতঙ্কিত করে।
আতাইকুলা গ্রামে ২৫শে এপ্রিলের গণহত্যায় নিহত ৫২ জন হলেন- যােগেন্দ্র পাল, সতীশ চন্দ্র পাল, সুরেশ্বর পাল, লস্কর পাল, বলরাম পাল, শ্রীদাম পাল, গােবিন্দ চরণ পাল, সুশান্ত কুমার পাল, প্রশান্ত কুমার পাল, বিদুৎ কুমার পাল, সুধীর চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র নাথ পাল, উত্তম কুমার পাল (বেতারশিল্পী), শঙ্কর পাল, প্রফুল কুমার পাল, ডা. প্রমথ নাথ পাল, বীরেন্দ্র নাথ পাল, নারায়ণ চন্দ্র পাল, সচীন্দ্র নাথ পাল, রসিক চরণ পাল, শশি চরণ পাল, মােহন কুমার পাল, সুধীর চন্দ্র পাল-১, সুনীল চন্দ্র পাল, যােগেন্দ্র নাথ পাল, বাদল চন্দ্র পাল, ভাদু চরণ পাল, সুধীর চন্দ্র পাল-২, নিবারণ চন্দ্র পাল, তাল পাল, নারায়ণ চন্দ্র পাল, শিশু চরণ পাল, দানু পাল, নরেন্দ্র নাথ পাল, নিখিল কুমার পাল, সিদ্ধেশ্বর সূত্রধর, সােমেশ্বর সূত্রধর, শিবেশ্বর সূত্রধর, বিক্ষয় সূত্রধর, রামচন্দ্র সূত্রধর, চৈতন্য সূত্রধর, সুকোমল সাহা, হরেন্দ্রনাথ সরকার, মংলা সরকার, শচীন্দ্রনাথ সরকার, সুধীর সরকার, রসিক হালদার, বীরেশ্বর হালদার, রঘুবীর মাঝি, ফিরিঙ্গি, প্রেম চরণ পাল ও রাজেন্দ্র পাল।
জুন মাসে হানাদার বাহিনী পুনরায় আতাইকুলা গ্রামের পালপাড়ায় হানা দেয়। এসময় গ্রামের অনেক অধিবাসী প্রাণের ভয়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। তারপরও পাশবিক উল্লাসে পাকসেনারা নারীনির্যাতন, লুটপাট ও অনেক হিন্দুমুসলমানকে হত্যা করে। এদিন কেবল আতাইকুলা নয়, পার্শ্ববর্তী অন্য গ্রামের কয়েকজনও নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে যাদের পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- কুজাইল গ্রামের ভবেন, বিশ্বনাথ, খােকা, বিশু সাহা, গণেশ চন্দ্র; আতাইকুলা গ্রামের রেণু পাল, নিবারণ পাল, আমজাদ হােসেন, পানু; রামপুরের মহির উদ্দিন, কাশিমপুর গ্রামের হরেন চন্দ্র, শফির উদ্দিন, কছিমুদ্দিন ও লছিমুদ্দিন।
এরপর ২৬শে জুলাই গভীর রাতে রাজাকারদের সহায়তায় হানাদাররা তৃতীয়বার আতাইকুলা গ্রামে আক্রমণ করে। এদিন তাদের হাতে ২৭ জন গ্রামবাসী নিহত হয়। তারা সকলে রাতে গ্রাম পাহারা দিচ্ছিল। এবারাে হানাদাররা গ্রামটিতে লুটপাট চালায় এবং বিভিন্ন বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে। এভাবে বারবার লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, নারীনির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় এ গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলাের অসংখ্য মানুষ। অবশেষে ভীতসন্ত্রস্ত এসব মানুষ দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়।
২৬শে এপ্রিল ভবেশ্বর পালের নেতৃত্বে গােলক প্রামাণিক এবং আরাে কয়েকজনের সহযােগিতায় আতাইকুলা গ্রামের যােগেন পালের বাড়ির পশ্চিমদিকে একটি বড় গর্ত খুঁড়ে ২৫শে এপ্রিল নিহত হওয়া ৫২ জনকে গণকবর দেয়া হয়। এ গণকবর সংরক্ষিত রয়েছে। স্বাধীনতা লাভের প্রায় ২৬ বছর পর নওগাঁ-নাটোর এলাকার এমপি শাহিন মনােয়ারা হক আতাইকুলা গ্রামের গণহত্যার ঘটনা জাতীয় সংসদে তুলে ধরেন। এতে সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। ১৯৯৭ সালের ১লা অক্টোবর আতাইকুলায় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর ২০০৯ সালের ২৬শে মার্চ নওগাঁ-৬ আসনের সাংসদ মাে. ইসরাফিল আলম শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন। [চিত্তরঞ্জন মিশ]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড