You dont have javascript enabled! Please enable it!

আত্রাই উপজেলা (নওগাঁ)

আত্রাই উপজেলা নওগাঁ সদর থেকে ৩২ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত। এ এলাকাটি ছিল বামপন্থীদের প্রভাবাধীন। ষাটের দশকের গােড়ার দিকে এখানে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে দুবার কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন দুটিতে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা বামপন্থী নেতা যােগদান করেন। তাঁদের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে এলাকার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবকরা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়। পরবর্তীকালে উনসত্তর ও সত্তরের গণআন্দোলনের সময় তারা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। ফলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তাদের নিয়ে এক বিরাট মুক্তিবাহিনী গঠন করা সম্ভব হয়।
একাত্তরের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ঐতিহাসিক ভাষণের পর আত্রাইয়ের বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি নিয়ে আলােচনা শুরু হয়। এখানকার বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে বৃহৎ দল ছিল পূর্ব-বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল)। এ দলটি কেন্দ্রীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে স্থানীয় নেতা-কর্মীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা শুরু করলে এ থানায় সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। এপ্রিলের প্রথম দিকে আত্রাই থানার বিহারীপুর গ্রামের আবুল হাশেমের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দলের কতিপয় সাহসী নেতাকর্মীর এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বৈঠকে ১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন আত্রাই মােল্লা আজাদ মেমােরিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মােতাহার রহমান এবং সদস্য ডা. সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, তােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী, মােল্লা আফতাব আহমেদ, ওহিদুর রহমান, প্রভাষক বাদল দত্ত, ডা. আব্দুল খালেক, আবুল হাশেম, খায়রুল ইসলাম, সাজেদুর রহমান দুদু ও বেলাল হােসেন।
১০ই এপ্রিল ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে ২৫ জনের একটি দল আত্রাই থানার অস্ত্রাগার ভেঙ্গে ৩৯টি রাইফেল ও পাঁচ বাক্স গুলি হস্তগত করে। এসব অস্ত্র দিয়ে ভোপাড়া গ্রামের আনসার কমান্ডার শেখ নাছিরউদ্দিনের নেতৃত্বে সাহেবগঞ্জ ফুটবল মাঠে এবং ওহিদুর রহমানের বড়ভাই কয়সা গ্রামের সাবেক সেনাসদস্য এমদাদুর রহমানের নেতৃত্বে ভবানীপুর হাইস্কুল মাঠে স্থানীয় কর্মীদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে একটি খবর আসে যে, পাকবাহিনী নাটোর থেকে সড়কপথে আত্রাই প্রবেশ করছে। এ খবর শুনে আত্রাই মােল্লা আজাদ মেমােরিয়াল কলেজের অধ্যাপক বাদল দত্ত আবুল হাশেমসহ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে তলােয়ার, হাসুয়া, কুঁচ-ফালা ও আগ্নেয়াস্ত্র হাতে প্রায় দুই কিলােমিটার পথ ছুটে যান পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করার জন্য। কিন্তু পাকবাহিনীর আগমনের খবরটি ছিল গুজব। তবে তার এই সাহসী ভূমিকা স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল দারুণভাবে বৃদ্ধি করে। এ ঘটনার পর অস্ত্রসহ অন্যান্য সহযােগিতা আদায়ের জন্য বাদল দত্তকে ভারতে পাঠানাে হয়।
আত্রাইয়ে পাকবাহিনী প্রবেশের কয়েকদিন আগে আত্রাই ন্যাশনাল ব্যাংকের ম্যানেজার মােঃ হানিফ সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আবুল হাশেম ও ওহিদুর রহমানের মাধ্যমে পরিষদকে ৩০ হাজার টাকা দেন, যা ঐ সময় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই অভিযােগে ২৬শে মে সিংসাড়া গণহত্যার সময় ব্যাংক ম্যানেজার হানিফকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পূর্বে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ আত্রাইয়ে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন। আত্রাই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন ওহিদুর রহমান এবং গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন আবুল কালাম আজাদ, আব্দুল মালেক, সাজেদুর রহমান দুদু, রফিকুল ইসলাম পটল, আলমগীর হােসেন ও আব্দুল আজিজ কালু। ২২শে এপ্রিল পাকবাহিনী নাটোর থেকে এসে আত্রাইয়ে প্রবেশ করে এবং আত্রাই রেলওয়ে স্টেশনে ক্যাম্প স্থাপন করে। আত্রাই উপজেলার ভোপাড়া ইউনিয়নের সৈয়দপুর (সদুপুর) এর জান বক্স শেখ জানার নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনী এবং নাটোর জেলার নলডাঙ্গা উপজেলার মাধনগরের বাসিন্দা (শ্বশুরবাড়ি আত্রাই উপজেলার সাহাগােলা ইউনিয়নের তারাটিয়া) মকলেছুর রহমানের নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। রাজাকার প্রধান জানা পাকবাহিনীকে নিয়ে আত্রাইয়ের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযােগ ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালায়। আত্রাই উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা অনেকগুলাে গণহত্যা সংঘটিত করে। সেগুলাে হলােসিংসাড়া গণহত্যা ও গণকবর, বান্দাইখাড়া গণহত্যা, মিরাপুর গণহত্যা, হাটকালুপাড়া গণহত্যা, তারাটিয়া গণহত্যা, পাইকড়া গণহত্যা এবং তারানগর-বাউল্লাপাড়া গণহত্যা ২৬শে মে সিংসাড়া গণহত্যায় ২৯ জন, ৭ই জুলাই ও ২০শে সেপ্টেম্বর দুদফায় বান্দাইখাড়া গণহত্যায় ৭৯ জন, ১১ই জুলাই মিরাপুর গণহত্যায় ৩০ জন, একই দিন তারাটিয়া গণহত্যায় ৯ জন, ২৭শে জুলাই হাটকালুপাড়া গণহত্যায় ২১ জন, আগস্টের মাঝামাঝি পাইকড়া গণহত্যায় ৮ জন এবং ২০শে সেপ্টেম্বর তারানগর-বাউল্লাপাড়া গণহত্যায় ১৩ জন সাধারণ মানুষ নিহত হয়। আত্রাই পুরাতন রেলস্টেশন ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। এখানে মুক্তিকামী বাঙালিদের বন্দি করে রেখে নির্যাতন করা হতাে।
আত্রাই উপজেলায় একটি বধ্যভূমি ও গণকবর রয়েছে। সেটি হলাে আত্রাই পুরাতন রেলস্টেশন বধ্যভূমি ও গণকবর এখানে বহুসংখ্যক মানুষকে হত্যা করে কবর দেয় হয়েছে, আবার কাউকে-কাউকে বিলের পানিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছে। আত্রাইয়ে ওহিদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল, যা ওহিদুর বাহিনী নামে পরিচিত। ওহিদুর রহমান ছিলেন বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা। তাঁর অসামান্য দক্ষতা, অসীম সহসিকতা এবং বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে এ বাহিনী গড়ে ওঠে। তাঁর নেতৃত্বে আত্রাই মুক্তিযুদ্ধে বামপন্থীদের ভূমিকা ছিল খুবই উল্লেখযােগ্য।
অত্রাই উপজেলায় পাকবাহিনী ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের দুটি যুদ্ধ হয় – গােয়ালবাড়ি যুদ্ধ ও তারানগর-বাউল্লাপাড়া যুদ্ধ। গােয়ালবাড়ি যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২৯শে আগস্ট দুপুরবেলা। কালিকাপুর ইউনিয়নের গােয়ালবাড়ি গ্রামে মুক্তিযােদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছেন এ খবর পেয়ে পাকবাহিনী বিলের মধ্য দিয়ে একটি স্পীডবােট ও দুটি নৌকাযােগে এদিকে অগ্রসর হয়। এ-সময় গ্রুপ কমান্ডার আবুল কালাম আজাদের নেতৃত্বে ১৫ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল তাদের আক্রমণ করে এবং গুলি চালায়। তাৎক্ষণিকভাবে পাকবাহিনী পিছু হটে পাশের এক উঁচু ভিটায় পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলি চালায়। এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করলে পাকবাহিনী গােটা গােয়ালবাড়ি গ্রামটি পুড়িয়ে দেয় এবং তিনজন গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তারানগর-বাউল্লাপাড়া যুদ্ধ সংঘটিত হয় ২০শে সেপ্টেম্বর কমান্ডার ওহিদুর রহমান ও মকলেছুর রহমান রাজার নেতৃত্বে। এযুদ্ধে প্রায় ১০০ পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া ৬ই অক্টোবর মুক্তিযােদ্ধারা একটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। সেটি হলাে ২সাহাগােলা রেলওয়ে ব্রিজ অপারেশন ওহিদুর রহমান ও মকলেছুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত এ অপারেশনে ব্রিজটি পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। ১৪ই ডিসেম্বর আত্রাই উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
আত্রাই উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- লুৎফর রহমান (সাহাগােলা), মজিবর রহমান (সিংসাড়া), চয়েন উদ্দিন (পাঁচপাকিয়া), আলমগীর হােসেন (মহাদিঘী) এবং ফিরােজ (মহাদিঘী)। আত্রাই উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্বরূপ বান্দাইখাড়া, সিংসাড়া, হাটকালুপাড়া ও তারাটিয়া গণহত্যার স্থলে চারটি স্মৃতিফলক নির্মিত হয়েছে। [ফরিদুল আলম পিন্টু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!