আত্রাইঘাট পুরানাে রেলস্টেশন বধ্যভূমি ও গণকবর
আত্রাইঘাট পুরানাে রেলস্টেশন বধ্যভূমি ও গণকবর (নওগাঁ) নওগাঁ জেলায় অবস্থিত। এটি একটি বড় বধ্যভূমি ও গণকবর। এ রেলস্টেশনে পাকবাহিনীর একটি স্থায়ী ক্যাম্প ছিল। পাকসেনা এবং বিহারিরা আত্রাইয়ের বিভিন্ন এলাকা এমনকি রাজশাহী, নাটোর, শান্তাহার, পার্বতীপুর থেকে প্রতিদিন ১৪-১৫ জন নিরীহ বাঙালিদের ধরে এনে এখানে গুলি ও জবাই করে হত্যা করত। অগণিত মানুষকে হত্যার পর রেল-লাইনের দুপাশের বিল, স্টেশনের উত্তর পাশের ইন্দিরা এবং রেলসেতুর নিচ দিয়ে বয়ে যাওয়া বিলের পানিতে লাশ ফেলে দিত। স্টেশনের উত্তর দিকে রেললাইনের পাশ দিয়ে প্রায় এক কিলােমিটার বিস্তৃত এলাকায় রয়েছে অসংখ্য মানুষের কবর। এখানে নির্মম নির্যাতনে হত্যা করা হয় মুক্তিযােদ্ধা চয়েন উদ্দিন (পাঁচপাকিয়া), মহাদিঘী গ্রামের দুই সহােদর মুক্তিযােদ্ধা আলমগীর (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র) ও মুক্তিযােদ্ধা ফিরােজ (কলেজে ছাত্র)কে। চয়েন উদ্দিন রণাঙ্গন থেকে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার জন্য বাড়িতে এসেছিলেন। রাতে নিরাপত্তার স্বার্থে পাশের রহিম বক্সের বাড়ির গােয়াল ঘরে রাইফেল সঙ্গে নিয়ে ঘুমিয়েছিলেন। এ খবর পেয়ে গ্রামের রাজাকার কমান্ডার মােজাফ্ফর হােসেনের নেতৃত্বে ৭-৮ জন রাজাকার ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে অস্ত্রসহ আটক করে। রাজাকারদের হাত থেকে ছুটে পালানাের সময় তারা তার পায়ে গুলি করে ধরে ফেলে এবং রশি দিয়ে বেঁধে প্রথমে বেলিং কোম্পানির রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে নির্যাতনের পর পাকবাহিনীর আত্রাইঘাটে পুরনাে রেলস্টেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও নির্যাতন চালিয়ে পরে তাঁকে হত্যা করা হয়।
সহােদর দুই ভাইয়ের হত্যাও ছিল লােমহর্ষক ঘটনা। তাঁরা ১০ই জুলাই আত্রাইয়ের পার্শ্ববর্তী রাণীনগর উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে নানীর বাড়িতে মায়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ১১ই জুলাই ভােররাতে পাকবাহিনী ঐ গ্রামে হামলা চালিয়ে প্রায় ৩২ জনকে আটক করে। আটকদের মধ্যে এই দুই ভাইও ছিলেন। ২৯ জনকে হত্যা করার পর পাকবাহিনী যখন শােনে এরা সহােদর দুই ভাই তখন তারা বলে, দুই ভাইয়ের মধ্যে কে দোষী, কাকে তারা মারবে। উভয়ে অন্য ভাইকে বাদ দিয়ে নিজেকে মারতে বলেন। এমতাবস্থায় দুই ভাইকে ক্যাম্পের নির্যাতন সেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাদের রাজাকার হওয়ার প্রস্তাব দেয়া হয়। এ প্রস্তাব তারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। এরপর তাঁদের দুহাত পেছনে বেঁধে খেজুর কাঁটার ডাল দিয়ে নির্যাতন করা হয়। তাদের পিতা সাক্ষাৎ করতে গেলে তাকে সন্তানরা বলেছিলেন, “আমাদের দুই ভাইয়ের মৃত্যুর বদলে যদি দেশ স্বাধীন হয় তাও ভাল, আপনারা দুঃখ-কষ্ট নিবেন না। এমন ছেলেদের লাশ পর্যন্ত বাবা-মা পাননি।
পাকবাহিনী কখন কোথায় অপারেশনে যাবে, সেসব খবর গােপনে এলাকার মানুষকে অথবা মুক্তিবাহিনীকে জানানাের অভিযােগে স্টেশন মাস্টার আব্দুল ওহাবকে তারা জবাই করে হত্যা করে। পাকবাহিনীর নির্মম নির্যাতন আর হত্যা-গুমের নীরব স্বাক্ষী হয়ে আত্রাইঘাট পুরানাে রেলস্টেশনের ঘরগুলাে আজো দাঁড়িয়ে আছে। [ফরিদুল আলম পিন্টু]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড