আড়ানি ব্রিজ অপারেশন
আড়ানি ব্রিজ অপারেশন (বাঘা, রাজশাহী) পরিচালিত হয় ২২শে অক্টোবর। এতে ব্রিজটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং কিছুদিনের জন্য রাজশাহী ও পাবনার মধ্যে রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যােগাযােগের খুবই গুরুত্বপূর্ণ পথ হিসেবে ঈশ্বরদী-রাজশাহী রেললাইন ব্যবহার করত। এ রেললাইনের একটি অংশে আড়ানি ব্রিজ। রাজশাহী জেলার আওতাধীন বাঘা উপজেলার বড়াল নদীর ওপর ব্রিজটির অবস্থান। এ পথ ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনী ঈশ্বরদী থেকে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার বিভিন্ন সেনা অবস্থান ও স্থাপনায় প্রয়ােজনীয় রসদ, গােলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি সরবরাহ করত। ব্রিজটি নাটোর-রাজশাহী সড়কপথের নিকটবর্তী হওয়ায় সামরিক দিক থেকে এর কৌশলগত গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এসব কারণে ভারতের কাজিপাড়া মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পের প্রধান মেজর আবদুর রশিদের তত্ত্বাবধানে মুক্তিযােদ্ধারা আড়ানি ব্রিজ অপারেশনের পরিকল্পনা করেন। ইট-সিমেন্টে নির্মিত ৬টি পিলার ও ৮টি স্প্যানযুক্ত আড়ানি ব্রিজের দৈর্ঘ্য ২০০ মিটার। মাঝের দুটি স্প্যান অর্থাৎ ৩টি পিলার বরাবর ব্রিজের দুধারে লােহার গার্ডার। মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশনকালে ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিম পাড়ে রেললাইনের দুই পাশে পরিখা খনন করে ২০-২৫ জন পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্য রাইফেল, এসএমজি, গােলাবারুদ প্রভৃতি মারণাস্ত্র নিয়ে অবস্থান করে।
ঘটনার দিন মুক্তিযােদ্ধা আজাদ আলী, বীর প্রতীক-এর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল কুষ্টিয়ার খাজুরারথাক বিওপি থেকে রাতের অন্ধকারে নৌকাযােগে প্রমত্তা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে প্রথমে আড়ানির নিকটবর্তী পাঁকা, বাঁকা, তেঁতুলিয়া ও পাকুড়িয়া গ্রামে আশ্রয় নেয়। এদিন বেলা ১১টার দিকে অপারেশন পরিচালনার লক্ষ্যে মুক্তিযােদ্ধারা ফসলের মাঠে অবস্থান নেন। জুম্মার নামাজের আযান শুরু হলে তারা অতি সাবধানে ও ক্ষিপ্র গতিতে আড়ানি বাজারের ভেতর দিয়ে ব্রিজের দিকে অগ্রসর হন। তারা প্রথম সুযােগে ব্রিজের কাছে পাহারারত পাকিস্তানি আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যদের পরাস্ত করেন। পরবর্তীতে ব্রিজের ৩টি পিলার ও ৪টি স্প্যানের দুপাশে দুটি করে লিমপেট মাইন স্থাপন করেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্রিজে লাগানাে বিস্ফোরক মাইন বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। এতে ব্রিজের দুটি স্প্যান নদীতে ভেঙ্গে পড়ে এবং ব্রিজটি চলাচলের অযােগ্য হয়ে পড়ে।
আড়ানি ব্রিজ অপারেশনে দুজন নৌকমান্ডােসহ ৪৭ জন মুক্তিযােদ্ধা ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করেন। প্রথম দলের সদস্যরা হলেন- মাে. নাজির হােসেন (কমান্ডার), মাে. মােজাম্মেল হক (ডেপুটি কমান্ডার), মাে. মােজাম্মেল হক। (জিন্নু), মাে. লােকমান হােসেন, মাে. জলিল মােল্লা, মাে. রবিউল ইসলাম আবু, মাে. জামাল উদ্দিন, মাে. জমির উদ্দিন, মাে. নজরুল ইসলাম, মাে. ইয়াসিন আলী, মাে. সাদেক আলী, মাে. আতিউর রহমান, মাে. ফজলুল হক (টাঙ্গাইল) ও মাে. মখলেসুর রহমান মুকুল (হড়গ্রাম)। দ্বিতীয় দলের সদস্যরা হলেন- মাে. আজাদ আলী (কমান্ডার), মাে. মাহবুবউল গণি বাবলু (ডেপুটি কমান্ডার), মাে. মােজাম্মেল হক, মাে. আনসার আলী, মাে. আকসেদ আলী, মাে. এজার আলী, মাে. উসমান আলী, মাে. বজলুর রহমান, মাে. ছমির উদ্দিন, মাে. হামিদুল হক, মাে. আব্দুস সাত্তার, মাে. মােকসেদ আলী, মাে. আফছার আলী, মাে. সন্টু, মাে. খলিল, গিরীন্দ্র মােহন সরকার ও মাে. শফিউর রহমান (শফি)। তৃতীয় দলের সদস্যরা হলেনহাবিলদার রুস্তম আলী (কমান্ডার), হাবিলদার মনসুর রহমান (ডেপুটি কমান্ডার), মাে. নুরুন নবী, নায়েক শফি (এলএমজি আলী, হাবিলদার শফিউর রহমান, মাজেদ জাহাঙ্গীর, খন্দকার হায়দার আলী, মাে. আমজাদ হােসেন, মহির উদ্দিন, মাে. তসলিম, মাে. আলী তৈয়ব, সেকেন্দার আলী, মাে. আজিমুদ্দিন, মাে. রফিকুল। এ অপারেশনে মাঝিমাল্লা হিসেবে কাজ করেন এলাহী বশ মণ্ডল (এ্যালু মাঝি), জনাব আলী মাঝি, শুকুর আলী, আমির আলী, আবুল সরকার, ওয়াহেদ আলী, আফসার আলী, নফেল, ইনসার, মতলেব সরদার, আকবর সরদার, জফু, রহমান, ছারেতুল্লাহ, চিকু মাঝি, হুদা সরদার ও ওয়াজ মণ্ডল। এ অপারেশনের ফলে বেশ কিছুদিনের জন্য রাজশাহী ও পাবনার মধ্যে রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
অপারেশনের সাফল্যে অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন। জেলার অন্যান্য স্থানেও গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। দিনের বেলায় যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ায় অভিযানটি মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য একটি বিশেষ সাফল্যের পরিচয় বহন করে। মুক্তিকামী মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, অচিরেই মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর নিশ্চিত পরাজয় ঘটবে। ব্রিজ অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল বহুলাংশে হ্রাস পায়। মুক্তিযােদ্ধারা প্রকাশ্যে বড় ধরনের অপারেশন করতে পারে তা হানাদার বাহিনীর ধারণায় ছিল না। পাকিস্তানি বাহিনী এ অপারেশনের পরদিন ব্রিজের পার্শ্ববর্তী বাসুদেবপুর গ্রামে প্রতিশােধ হিসেবে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। [মােস্তফা কামাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড