আড়ানি রেল স্টেশন যুদ্ধ
আড়ানি রেল স্টেশন যুদ্ধ (বাঘা, রাজশাহী) সংঘটিত হয় ৭ই জুলাই। এতে ৪ জন রাজাকার- নিহত হয়, ৫ জন মিলিশিয়া ও ২ জন রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে এবং বাকিরা পালিয়ে যায়। শত্রুপক্ষের ৬টি ৩০৩ রাইফেল মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
ভারতের বীরভূম জেলার চাকুলিয়া ক্যাম্পে উচ্চতর প্রশিক্ষণ শেষে কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধাকে লালগােলা সাবসেক্টর ক্যাম্পে পাঠানাে হয়। এ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন মেজর গিয়াসউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী। তিনি এই মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্য হতে ১২ জন দুর্ধর্ষ এফএফ গেরিলাকে নাজির হােসেনের নেতৃত্বে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ধূলাউড়ি ক্যাম্পে পাঠান। ধূলাউড়ি ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতের ১৯ মারাঠা রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন পি জি ভাট। তিনি এই ১২ জন মুক্তিযােদ্ধাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেন। এরপর এই যােদ্ধারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এসে কুষ্টিয়ার খাজুরারথাক বিওপি ক্যাম্পে অবস্থান গ্রহণ করেন। এখানে অবস্থানকালে তাঁরা খবর পান যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযােগী রাজাকাররা আড়ানি রেল স্টেশন ও এর আশেপাশে দুর্ভেদ্য বাঙ্কার খনন করে অবস্থান নিয়েছে। এ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা আড়ানি রেল স্টেশন আক্রমণ এবং তা হানাদারমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। মুক্তিযােদ্ধারা ৬ই জুলাই রাতে গাইড সফিউরের সহায়তায় খাজুরারথাক থেকে নৌকাযােগে আড়ানিতে এসে আশ্রয় নেন। পরদিন ৭ই জুলাই বিকেল ৪টায় তারা রাজাকার বাহিনীর অবস্থানে অতর্কিত হামলা চালান এবং হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে শত্রুপক্ষের বাঙ্কার ধ্বংস করে দেন। মুক্তিযােদ্ধারা ৩০৩ রাইফেল, ৭.৬২ বােরের এসএলআর, স্টেনগান ইত্যাদি অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করায় রাজাকাররা হতভম্ভ হয়ে আত্মরক্ষার্থে দিগ্বিদিক পালাতে শুরু করে। ৫ জন মিলিশিয়া ও ২ জন রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। বাঙ্কারে শত্রুদের ৪ জন নিহত হয়। শত্রুপক্ষের ৬টি ৩০৩ রাইফেল মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। এরপর মুক্তিযােদ্ধারা রেল স্টেশনের সন্নিকটবর্তী রেল লাইনে জিসি স্রাব নামক বিস্ফোরক স্থাপন করে তা উড়িয়ে দেন। এ অভিযানে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- মাে. নাজির হােসেন (কমান্ডার), মাে. মােজাম্মেল হক (ডেপুটি কমান্ডার), মাে. মােজাম্মেল হক (জিঞ্জু), মাে. লােকমান হােসেন, মাে. জলিল মােল্লা, মাে. রবিউল ইসলাম আবু, মাে. জামাল উদ্দিন, মাে. ছমির উদ্দিন, মাে. নজরুল ইসলাম, মাে. ইয়াসিন আলী, মাে. সাদেক আলী, মাে. আতিউর রহমান, মাে. ফজলুল হক (টাঙ্গাইল) ও মাে. মখলেসুর রহমান মুকুল (হড়গ্রাম)।
এ অপারেশনে গমনাগমনের জন্য একটি নৌকা ব্যবহার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা খাজুরারথাক থেকে বের হয়ে পায়ে হেঁটে চিলমারির চর পাড়ি দিয়ে ঘাটে ভেড়ানাে নৌকায় এসে ওঠেন। শক্ত হাতে নৌকার দাঁড় ধরেন আফসার মাঝি। এক সময় তারা পদ্মা নদী পাড়ি দিয়ে বাঘার নারায়ণপুর ঘাটে পৌছান। গাইড সফিউরকে অনুসরণ করে মুক্তিযােদ্ধারা আড়ানির নির্দিষ্ট স্থানে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ অপারেশনে আড়ানি ব্রিজ ও রেল লাইন উড়িয়ে দেয়ায় এ পথে কিছুদিনের জন্য রাজশাহী-পাবনার মধ্যে ট্রেন চলাচল ও টেলিযােগাযােগ বন্ধ থাকে। এ অপারেশনের সাফল্যে মুক্তিযােদ্ধারা খুবই অনুপ্রাণিত হন এবং জেলার অন্যত্র গেরিলা যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া অভিযানটি দিনের বেলায় সংঘটিত হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এটি বিশেষ সাফল্যের পরিচয় বহন করে। অন্যদিকে আড়ানি ব্রিজ অপারেশনে পাকিস্তানি বাহিনীর মনােবল ভেঙ্গে পড়ে। [মােস্তফা কামাল]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড