আজগরা গণহত্যা
আজগরা গণহত্যা (লাকসাম, কুমিল্লা) সংঘটিত হয় ৬ই এপ্রিল। আজগরা ইউনিয়ন পরিষদ অফিস সংলগ্ন আজগরা। বাজারে হাটবারের দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বিমান হামলা চালায়। তারা বােমারু বিমান থেকে শেলিং করে। এতে ৫০ জনের মতাে লােক নিহত এবং ২০০ জনের অধিক আহত হয়।
স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক আলতাফ আলীর নেতৃত্বে উত্তাল মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে আজগরাতে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ চলছিল। ঘটনার দিনও বাজার সংলগ্ন ইউনিয়ন পরিষদের ছাদে ও তৎসংলগ্ন মাঠে মুক্তিযােদ্ধারা কেউ লাঠি হাতে, কেউ খালি হাতে শারীরিক কসরত করছিলেন। হঠাৎ বাজারের ওপর দিয়ে দুটি যুদ্ধবিমান চট্টগ্রামের দিকে চলে যায়। যুদ্ধবিমান দেখে কসরতরত অনেকেই লাঠি উঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠে। মিনিট বিশেক পর বােমারু বিমান দুটি ফিরে এসে আকস্মিকভাবে হাটে বেচা-কেনায় ব্যস্ত সাধারণ মানুষের ওপর এলােপাতাড়িভাবে শেল নিক্ষেপ শুরু করে। প্রথমবার শেল নিক্ষেপ করলে সেটি বাজার সংলগ্ন রেললাইনের পাশের ডােবায় গিয়ে পড়ে। দ্বিতীয়বারের শেলটি তরকারি ও খুচরাে ধান-চালের বাজারে গিয়ে পড়ে। আশপাশের বিভিন্ন গ্রাম ও দূর-দূরান্ত থেকে আগত অসংখ্য মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দ্বিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। রক্ত, লাশ আর মানুষের আর্তচিৎকারে মুহূর্তেই ঘটনাস্থলে একটি বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শেলের প্রচণ্ড আঘাতে অনেকেই ক্ষতবিক্ষত ও রক্তাক্ত হয়, কারাে হাত-পা-মাথা উড়ে যায়, কারাে দ্বি-খণ্ডিত লাশ পড়ে থাকে, কারাে মগজ ও ভুঁড়ি আশপাশের গাছে ও টিনের চালে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। ঘটনাস্থলে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেন। আবার অনেকেই ঘটনার কয়েক বছর বছর পরও দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থেকে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এ ঘটনার পর আহতদের সাহায্যার্থে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক জালাল আহমেদ, আবদুল আউয়াল, খােরশেদ আলম সুরুজ, আলতাফ আলী, সাইফুল গণি চৌধুরী, প্রফেসর অহিদুর রহমান, রফিকুল আলম, সফিকুর রহমান, আবদুর রহিম প্রমুখ ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। তারা আহতদের স্থানীয় ক্লিনিক ও ডাক্তারের চেম্বারে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। গুরুতর আহতদের উন্নত চিকিৎসার জন্য লাকসাম হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু সেখানে প্রয়ােজনীয় ডাক্তার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় তাদের রেলের একটি বগিতে করে চাঁদপুর রেলস্টেশনে নিয়ে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সিদ্দিকুর রহমানের নিকট হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে চাঁদপুর হাসপাতালে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়।
আজগরা গণহত্যায় নিহতদের মধ্যে যাদের নাম-পরিচয় জানা গেছে, তারা হলেন- ছাদেক আলী (পিতা রমজান আলী, পাওলি), আবদুল মান্নান (পিতা রহমত আলী, পাওলি), মাে. তাজুল ইসলাম (পিতা আলী মিয়া, পাওলি), নুরুল ইসলাম (পিতা আলী মিয়া, পাওলি), কালা মিয়া (পিতা জহির উদ্দিন, পাওলি), আফজাল হােসেন (পিতা আরফান উদ্দিন, নােয়াগাঁও), আব্দুর রশিদ (পিতা রজ্জব আলী, নােয়াগাঁও), রহমত আলী (পিতা রঙ্গু মিয়া, লােলাই), মাে. আলী আশরাফ (পিতা আব্দুল করিম মােল্লা, কালিয়াচৌ), আব্দুর রশিদ (পিতা ডেংগু মিয়া, খিলপাড়া), ইউনুস মিয়া (পিতা ডেংগু মিয়া, খিলপাড়া), কাজী ছেরাজুল হক (পিতা সেকান্দার আলী, আমদুয়ার), আব্দুল গফুর (পিতা মকবুল আহম্মেদ, কৃষ্ণপুর), বাছা মিয়া (পিতা ইউসুফ আলী, বড়বাম), আব্দুল কাদির (পিতা আব্দুল আজিজ, বড়বাম), সৈয়দ আলী (পিতা ধনগাজী, ঘাটার), আব্দুস সামাদ (ঘাটার), সূর্যমােহন দাশ (পিতা হরিমােহন দাশ, বাতাবাড়িয়া), ওয়াহেদ আলী (পিতা মেহের আলী, নাওটী), কোরবান আলী (পিতা আতর আলী, চরবাড়িয়া), আব্দুল মান্নান (পিতা রহমত আলী, উত্তরদা), আলী আজম (পিতা আলী আকবর, দক্ষিণ নরপাটি), আব্দুল হামিদ (পিতা মুন্সী ইয়াকুব আলী, সাহাপুর), মাে. খলিলুর রহমান (পিতা আলী আহম্মেদ, পূর্ব সাহেবপাড়া), সুলতান আহমেদ (পিতা সৈয়দ আলী, ছিলুইন), সৈয়দ আলী (পিতা তমিজ উদ্দিন, ভােজপাড়া), মনােরঞ্জন দেবনাথ (পিতা হরিমােহন দেবনাথ, আশকামতা), রুস্তম আলী (পিতা আলী আশরাফ, কোমড়া), মাে. ইব্রাহিম (তুলাগাঁও, নাঙ্গলকোট), হরিপদ দাশ হােরামনি (হেসাখাল, নাঙ্গলকোট), আলী হােসেন (পিতা রহমত আলী, বালিয়া পুষ্করণী, নাঙ্গলকোট), মাে. ইব্রাহিম খলিল (পিতা হাসান আলী, বালিয়া পুষ্করণী, নাঙ্গলকোট) ও জয়নাল আবেদীন (পিতা আব্দুল আজিজ, বালিয়া পুষ্করণী, নাঙ্গলকোট)। ছেরাজুল হক (পিতা ছাদেক আলী, খিলপাড়া), আলতাফ আলী মেস্ত্রী (পিতা ছফর আলী, খিলপাড়া), বজু মিয়া (পিতা আশ্রাফ আলী, খিলপাড়া) প্রমুখ শেলের আঘাতে আহত হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করে কয়েক বছর পর মারা যান।
সেদিন আজগরা বাজারে বােমারু বিমান হামলায় আহতদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায়, তারা হলেন- বড়গ্রাম গ্রামের আলী হােসেন, মাে. ইয়াছিন, সিদ্দিকুর রহমান, আব্দুল হামিদ ও আব্দুল বারিক; ঘাটার গ্রামের আলী ওহাব, কালা মিয়া, মােস্তফা মিয়া ও আবুল খায়ের; নােয়াগাঁও গ্রামের শরাফত আলী, সৈয়দ আহাম্মদ, আবুল কালাম, আবুল বাশার, ইদু আলী ও চন্দ্রকুমার দেবনাথ; খিলপাড়া গ্রামের মমতাজ মিয়া, আবদুল মান্নান, আলী হােসেন, চান গাজী ও রফিকুল ইসলাম; পাওতলি গ্রামের আরব আলী ও নূর মিয়া; শুকতলা গ্রামের ফজলে আলী, জয়নাল আবেদীন, মাে. হানিফ ও চান্দু মিয়া; নাওটী গ্রামের আব্দুস ছত্তার, খােরশেদ আলম ও আবদুল মজিদ; আমদুয়ার গ্রামের আবদুল মান্নান ও আনােয়ার আলী; উত্তরদা গ্রামের বজলুর রহমান ও মাকু মিয়া; কালিয়াচৌ গ্রামেরর রমজান আলী; কৃষ্ণপুর গ্রামের হাবিবুর রহমান; চন্দনা গ্রামের রুস্তম আলী; শােলা পুষ্করণী গ্রামের আবদুস সােবহান; বালিয়া পুষ্করণী গ্রামের আবদুল আজিজ মজুমদার; জোড়পুকুরিয়া গ্রামের আবদুল মালেক, হেসাখাল গ্রামের আবুল কাশেম প্রমুখ। [ইমন সালাউদ্দিন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড