You dont have javascript enabled! Please enable it!

আজমিরীগঞ্জ উপজেলা (হবিগঞ্জ)

১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। এর ফলে বাঙালিদের অধিকার আদায়ের পথ সুগম হয়। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পিপিপি নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ষড়যন্ত্রে সে-পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারেন, সেজন্য তারা নানারকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয়। পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়। এর ফলে সারা বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এরূপ পরিস্থিতিতে আসে বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। উপস্থিত লাখাে জনতাকে উদ্দেশ্য করে তিনি আহ্বান জানান, প্রত্যেক ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে’। তাঁর এ ভাষণে সারা বাংলার মতাে আজমিরীগঞ্জের মানুষও রাস্তায় নেমে আসে। তারা স্লোগান দিতে থাকে, ‘রক্তসূর্য উঠেছে – বীর বাঙ্গালী জেগেছে’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা – তােমার আমার ঠিকানা’, ‘ভুট্টো-ইয়াহিয়া ভাই-ভাই – এক রশিতে ফাঁসি চাই’ ইত্যাদি। আন্দোলনের এই চরম মুহূর্তেও ভুট্টো-ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র অব্যাহত থাকায় পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে বাঙালিদের সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।
৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পরপরই দেশের অন্যান্য স্থানের মতাে আজমিরীগঞ্জের রাজনৈতিক নেতা এবং বুদ্ধিজীবীরাও আলােচনা করতে থাকেন পরবর্তীতে কী ঘটতে পারে এবং তা কীভাবে মােকাবেলা করা যাবে। হবিগঞ্জ মহকুমায় এডভােকেট মােস্তফা আলী এমএনএ-কে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। অনুরূপভাবে প্রতিটি থানায়ও সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। আজমিরীগঞ্জ থানার সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন ডা. কৃপেন্দ্র কিশাের বর্মণ। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আজমিরীগঞ্জের প্রাক্তন সৈনিক, তঙ্কালীন সেনাসদস্য, আনসার এবং মুজাহিদদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। এলাকার ছাত্র-যুবকরা গােপনে থানার সকল ব্যক্তিগত বন্দুকের একটি তালিকা তৈরি করে। এসব কাজে সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করেন মইন চৌধুরী, রাখাল সেন, ডা. কৃপেন্দ্র কিশাের বর্মণ, বড়ধন মিয়া, লুৎফুর রহমান চৌধুরী ও কাজল চৌধুরী। ২৫শে মার্চ রাতে পাকবাহিনীর হত্যাযজ্ঞের পর ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আজমিরীগঞ্জ থানার সকল অস্ত্র ছাত্রজনতা দখল করে নেয়। এরপর ২৭শে মার্চ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক গিয়াস উদ্দিনের নেতৃত্বে গঠিত মুক্তিবাহিনীর একটি দল হবিগঞ্জ মহকুমা শহরে মেজর সি আর দত্ত, বীর উত্তম-এর সঙ্গে মিলিত হয় এবং প্রতিরােধ যুদ্ধের কৌশল নিয়ে আলােচনা করে। ঐদিনই কর্নেল এম এ রব ও সি আর দত্তের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধা এবং প্রাক্তন সৈনিকদের প্রায় ৫০০ জনের এক বাহিনী সিলেট থেকে আগত পাকবাহিনীকে মােকাবেলা করার জন্য এগিয়ে যায়। এ বাহিনী রশিদপুর, চালেঙ্গা, শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার ও শেরপুরের পথে এগিয়ে গিয়ে ২৯ ও ৩০শে মার্চ শেরপুর ও সাদীপুরে যুদ্ধ করে হানাদার বাহিনীকে সিলেট পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু হানাদার বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে তারা পশ্চাদপসরণ করেন এবং একটি অংশ তেলিয়াপাড়ায় মেজর কে এম সফিউল্লাহ, বীর উত্তম ও ব্রিগেডিয়ার খালেদ মােশাররফ, বীর উত্তম-এর সমন্বিত বাহিনীর সঙ্গে যােগ দেয়। এরপর আজমিরীগঞ্জের গরুহাঠা মাঠ ও শিবপাশা মাঠে বন্দুক ও বাঁশের লাঠি দিয়ে স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলতে থাকে।
আজমিরীগঞ্জে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা হলেন- ডা. কৃপেন্দ্র কিশাের বর্মণ (সভাপতি, ওয়ালী ন্যাপ ও আজমিরীগঞ্জ থানা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক), নুরুল হক ভূঁইয়া (আনন্দপুর; সভাপতি, আজমিরীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ), ওলীউন নবী বড়ধন মিয়া (সাধারণ সম্পাদক, আজমিরীগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগ), মনিরুজ্জামান কনাই (হুকুড়া), মিজবাহ উদ্দিন ভূইয়া (কাকাইলছেও), রাখাল সেন (আজমিরীগঞ্জ, কমিউনিস্ট নেতা), ডা. যামিনী দাশ (আজমিরীগঞ্জ বাজার), মনােরঞ্জন মােদক (বিরাট, কমিউনিস্ট নেতা), ডা. টি আলী (জলসুখা, কমিউনিস্ট নেতা ও চক্ষু চিকিৎসক), আব্দুল ওয়াহাব চৌধুরী (শিবপাশা), মাহমুদ হােসেন চৌধুরী (শিবপাশা, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক), লুৎফুর রহমান চৌধুরী (শিবপাশা, কাপ্তান), ইঞ্জিনিয়ার আহাদ মিয়া (শিবপাশা), মহিউদ্দিন আহম্মেদ খান (পশ্চিমভাগ), মােশাহিদ আহম্মেদ খান (পশ্চিমভাগ), ইয়াসিন মিয়া (ঘরদাইর), কৃষ্ণচন্দ্র সরকার (পাহাড়পুর), রঞ্জিত দাস (কাটাখালী), এরাজত মিয়া (নগর) প্রমুখ। মাে. রাশিদুল হাসান চৌধুরী (কাজল) ছিলেন যুদ্ধকালীন প্লাটুন কমান্ডার। আজমিরীগঞ্জে দাস পার্টি, নামে একটি স্থানীয় নৌকমান্ডাে বাহিনী ছিল। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন বীর মুক্তিযােদ্ধা জগৎজ্যোতি দাস, বীর বিক্রম পঁয়তাল্লিশ সদস্যের এ বাহিনী দিরাই, জামালগঞ্জ, রাণীগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, মারকুলি, হালিয়াজুরি প্রভৃতি এলাকায় একাধিক সফল অপারেশন চালায়। এর ফলে যুদ্ধের সময় দাস পার্টি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
২৯শে মার্চ তেলিয়াপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেঙ্গে পাকবাহিনী হবিগঞ্জ মহকুমা শহরে প্রবেশ করে। পরের দিন ৩০শে মার্চ বানিয়াচং থানা সদরে যায় এবং ১লা এপ্রিল আজমিরীগঞ্জ থানা সদরে পৌছে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করে। দুর্গম যােগাযােগের কারণে প্রথমদিকে তারা এখানে ক্যাম্প স্থাপন করেনি। পরে ২৫শে জুলাই স্পিডবােটে এসে আজমিরীগঞ্জ থানায় অস্থায়ী ক্যাম্প করে। মাঝে-মধ্যে তারা ভেড়ামােহনা ও কুশিয়ারা নৌপথে গানবােটে এসে অভিযান চালাত।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলায় পাকবাহিনী প্রবেশের পর স্থানীয় মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ ও এনএসএফ-এর নেতাদের অনেকে তাদের সঙ্গে হাত মেলায়। হানাদার বাহিনীর সহযােগিতায় তারা শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে। শান্তি কমিটির সভাপতি ছিল সিরাজ মিয়া (আজমিরীগঞ্জ) এবং সেক্রেটারি আলি রেজা (আজমিরীগঞ্জ)। উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়নেও কমিটি ছিল। সেগুলাে হলাে- আজমিরীগঞ্জ ইউনিয়ন কমিটি, বদলপুর ইউনিয়ন কমিটি (সভাপতি আব্দুল হাশিম মেম্বার), জলসুখা ইউনয়িন কমিটি (সভাপতি মােবাশ্বের চৌধুরী মনু মিয়া), কাকাইলছেও ইউনিয়ন কমিটি (সভাপতি হাজী দুলা মিয়া) এবং শিবপাশা ইউনিয়ন কমিটি (সভাপতি তজমুল আলী চৌধুরী)। থানা রাজাকার কমান্ডার ছিল আব্দুল মন্নান চৌধুরী ও আব্দুল মালেক এবং সহকারী কমান্ডার ছিলেন আব্দুল কাদের। উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধবিরােধী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে সিরাজ মিয়া (আজমিরীগঞ্জ; সভাপতি, আজমিরীগঞ্জ থানা শান্তি কমিটি; আজমিরীগঞ্জ খাদ্যগুদাম জেটি ও জলসুখা গ্রামে গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল), আলী রেজা (আজমিরীগঞ্জ; সেক্রেটারি, আজমিরীগঞ্জ থানা শান্তি কমিটি; নারীনির্যাতন ও গণহত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল), রফিক আহমেদ (আজমিরীগঞ্জ; আইয়ুব খানের সময় এমপি এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ইয়াহিয়া সরকার আয়ােজিত উপনির্বাচনে এমপিএ নির্বাচিত হয়েছিল), মােবাশ্বের চৌধুরী মনু মিয়া (জলসুখা; জলসুখা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি; গণহত্যার সহযােগী, মুক্তিযােদ্ধা নির্যাতনকারী ও রাজাকার বাহিনীর অন্যতম পৃষ্ঠপােষক), হাজী মােহাম্মদ দুলা মিয়া (রসুলপুর; সভাপতি, কাকাইলছেও ইউনিয়ন শান্তি কমিটি; অগ্নিসংযােগ, লুণ্ঠন ও হানাদার বাহিনীর তথ্য সরবরাহকারী), কালা মিয়া, গফুর মিয়া, হাজী আইয়ুব আলী, তজমুল আলী চৌধুরী (শিবপাশা; শিবপাশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি; লুণ্ঠনকারী ও রাজাকার বাহিনীর পৃষ্ঠপােষক), আব্দুল মান্নান চৌধুরী (শিবপাশা; শিবপাশা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সেক্রেটারি; লুণ্ঠনকারী ও থানা রাজাকার কমান্ডার), আব্দুল হাশিম মেম্বার (পিটুয়ার কান্দি; বদলপুর ইউনিয়ন শান্তি কমিটির সভাপতি; লুণ্ঠনকারী, হিন্দু নির্যাতনকারী ও হানাদার বাহিনীর তথ্য সরবরাহকারী) প্রমুখ।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা উপজেলায় হত্যা, গণহত্যা, নারীনির্যাতন, অগ্নিসংযােগ ও লুণ্ঠনের মতাে মানবতাবিরােধী অপরাধ সংঘটিত করে। তারা আসকর মাহমুদ মিয়া (ডুগা মিয়া)-কে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। তিনি হিন্দু নারীদের সম্ভ্রম রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ভানু রায় নামে আরেকজনকে হত্যা করে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকায় আরাে ১৫-১৬ জনকে হত্যা করা হয়।
আজমিরীগঞ্জে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা দুটি গণহত্যার ঘটনা ঘটায় – আজমিরীগঞ্জ জেটি গণহত্যা ও ঘােষপাড়া গণহত্যা ১৭ই জুন আজমিরীগঞ্জ জেটি গণহত্যায় ১০-১৫ জন শহীদ হন। ১৫ই আগস্ট সিরাজ মিয়া, আলী রেজা, আব্দুল করিম ও আব্দুল মালেকের সহায়তায় পাকসেনারা ঘােষপাড়ায় ৯ জনকে হত্যা করে। আজমিরীগঞ্জ থানা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আলী রেজা একজন হিন্দু নারীকে কয়েক মাস রক্ষিতা হিসেবে আটকে রেখে ধর্ষণ করে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে গুপ্তচরের কাজ করতে বাধ্য করে। স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনী তাকে উদ্ধার করে। কাকাইলছেওর আরেক হিন্দু নারী শরণার্থী হিসেবে পালিয়ে যাওয়ার সময় রাজাকাররা তাকে ধরে নিয়ে ৩ দিন যাবৎ ধর্ষণ করে। পরে নুরুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে ছাত্রজনতার একটি দল দুষ্কৃতিকারী দুজনকে হত্যা করে তাকে উদ্ধার করে। পাকবাহিনী কাকাইলছেওর হরলাল দাস এবং কালনী পাড়ার চান মিয়া ও নুরুল ইসলামের বাড়ি লুটপাট করে এবং পুড়িয়ে দেয়। এছাড়া ৪নং বদলপুর ইউনিয়নের পাহাড়পুর, ঝিলুয়া, কাটাখালীসহ প্রায় ১০ গ্রামের হিন্দুরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে। গেলে রাজাকাররা গ্রামগুলাে লুট করে।
আজমিরীগঞ্জ থানা ক্যাম্প পাকবাহিনীর নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। এখানে যাদের আটক করা হতাে, পরে তাদের শ্রীমঙ্গল ক্যাম্পে প্রেরণ করা হতাে। এছাড়া আলী রেজার নিয়ন্ত্রণে একটি ব্যক্তিগত নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির ছিল।
আজমিরীগঞ্জে দুটি বধ্যভূমি ছিল – আজমিরীগঞ্জ জেটিঘাট বধ্যভূমি ও জলসুখা বধ্যভূমি। এ দুটি স্থানে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বহু লােককে ধরে এনে হত্যা করেছে। কিন্তু বধ্যভূমি দুটি সংরক্ষণ করা হয়নি।
আজমিরীগঞ্জে পাকহানাদার ও তাদের দোসরদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের উল্লেখযােগ্য পাঁচটি সম্মুখ যুদ্ধ হয়আজমিরীগঞ্জ থানা অপারেশন, পাহাড়পুর নৌযুদ্ধ, বদলপুর যুদ্ধ, ভেড়ামােহনায় কার্গো কনভয় ধ্বংস এবং কামালপুর নৌযুদ্ধ। ২৫শে জুন আজমিরীগঞ্জ থানা অপারেশনে হানাদাররা পালিয়ে যায়। পাহাড়পুর নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয় জগৎজ্যোতি দাসের নেতৃত্বে ১৭ই আগস্ট। দাস পার্টির ৪০-৪৫ জন যােদ্ধা পাকবাহিনীকে আক্রমণ করে। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শত্রুপক্ষের ব্যাপক
ক্ষয়-ক্ষতি হয় এবং দাস পার্টির কয়েকজন যােদ্ধা আহত হন। পাকসেনারা এক পর্যায়ে পালিয়ে যায়। বদলপুর যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৬ই নভেম্বর। এ-যুদ্ধেও নেতৃত্ব দেন জগৎজ্যোতি। প্রায় ১৮ ঘণ্টাব্যাপী এ-যুদ্ধে জগৎজ্যোতি শহীদ এবং ২ জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হন। ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। যুদ্ধের পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় অবশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করেন। ভেরামােহনায় কার্গো কনভয় ধ্বংস হয় অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে। এতে পাকবাহিনীর একটি কার্গো কনভয় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কামালপুর নৌযুদ্ধ সংঘটিত হয় ৫ই ডিসেম্বর শফিকুল ইসলাম বাচ্চুর নেতৃত্বে। এদিন মুক্তিযােদ্ধারা হানাদারদের একটি কার্গো আক্রমণ করলে ১৮ জন পাক মুজাহিদ নিহত হয়। ৭ই ডিসেম্বর আজমিরীগঞ্জ উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
আজমিরীগঞ্জ উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেনজগৎজ্যোতি দাস (পিতা জিতেন্দ্র চন্দ্র দাস, জলসুখা; ১৬ই নভেম্বর বদলপুর যুদ্ধে শহীদ), শ্রীকান্ত দাস (পিতা নীলকান্ত দাস, পাহাড়পুর; মুক্তিযুদ্ধকালে সিলেট এম সি কলেজের ছাত্র; ২৭শে নভেম্বর সুনামগঞ্জের মঙ্গলকাটার যুদ্ধে শহীদ; সুনামগঞ্জের ভাতেরটেকে সমাহিত), গৌরাঙ্গ দেবনাথ (পিতা ভারতচন্দ্র দেবনাথ, কাকাইলছেও; প্রশিক্ষণরত অবস্থায় বিমান দুর্ঘটনায় শহীদ) এবং সুবেদার (অব.) ইউসুফ আলী চৌধুরী (পিতা ইউনুছ চৌধুরী, আজমিরীগঞ্জ)।
উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের স্মরণে একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আজমিরীগঞ্জ পৌরসভার উদ্যোগে আজমিরীগঞ্জ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে উপজেলার সকল মুক্তিযােদ্ধার স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। ২নং বদলপুর ইউনিয়ন ও বাজারের মধ্যবর্তী মাঠের পশ্চিম পার্শ্বে ইউনিয়নের সকল মুক্তিযােদ্ধার নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। উপজেলা কমপ্লেক্স থেকে শহীদ মিনার পর্যন্ত সড়কের নাম রাখা হয়েছে শহীদ জগৎজ্যোতি দাস বীর বিক্রম সড়ক। সিলেট এম সি কলেজে শ্রীকান্ত দাসের নামে একটি ছাত্রাবাসের নামকরণ করা হয়েছে। সুনামগঞ্জ জেলা সদরে জগৎজ্যোতির নামে একটি পাঠাগার আছে। পাকসেনারা জগৎজ্যোতি দাসের মৃতদেহ যে-স্থানে বৈদ্যুতিক খুঁটিতে ঝুলিয়ে রেখেছিল, সেখানে তাঁর নামে একটি স্মৃতিস্তম্ভের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। জগৎজ্যোতি যে স্কুলের ছাত্র ছিলেন সেই এ এ বি সি হাইস্কুল প্রাঙ্গণে উপজেলা চেয়ারম্যান আতর আলীর উদ্যোগে তাঁর নামে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এছাড়া হবিগঞ্জ-আজমিরীগঞ্জ সড়কের একটি সেতুর নাম জগৎজ্যোতির নামে এবং আজমিরীগঞ্জ-পাহাড়পুর সড়কের নাম শ্রীকান্ত সড়ক রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। [মাে. রাশিদুল হাসান চৌধুরী কাজল]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!