You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধে আখাউড়া উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) - সংগ্রামের নোটবুক

আখাউড়া উপজেলা

আখাউড়া উপজেলা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) পাকিস্তানের দীর্ঘ অপশাসনের বিরুদ্ধে আখাউড়ার মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হতে থাকে। তারা মুক্তির পথ খুঁজতে থাকে। অবশেষে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর ভাষণে উজ্জীবিত হয়ে এ অঞ্চলের মানুষ মুক্তিসংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে।
২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে গণহত্যাসহ লুণ্ঠন-নির্যাতন শুরু হলে এখানকার মানুষ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। শুরুতেই এখানে গড়ে ওঠে আখাউড়া স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। আখাউড়ার সঙ্গে ঢাকাসহ সারা দেশের যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যায়। উপজেলা আওয়ামী লীগ এর সভাপতি লিলু মিয়া, এ কে এম নাজির হােসেন, এ এম মাে. ইসহাক, এম এ কাদের চৌধুরী, আব্দুল আজিজ প্রমুখ একটি ঘরােয়া সভা করে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করেন। পরবর্তীতে সুবেদার গােলাম আম্বিয়া ও হাবিলদার মমতাজ উদ্দিনসহ বেশকিছু প্রাক্তন সৈনিক, পুলিশ ও আনসারদের নিয়ে গণবাহিনী গঠিত হয়। এঁদের নেতৃত্বে তােফায়েল আজম হাসপাতাল মাঠ (বর্তমানে আখাউড়া ভবন) ও দেবগ্রাম পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এম এ কাদের চৌধুরী, আব্দুল আজিজ, সুজাত আহম্মদ খান, মাে. সুলতান প্রমুখ। এ উপজেলায় দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনাে কমান্ডার ছিল না। প্রাক্তন সৈনিকদের নেতৃত্বে এখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। এপ্রিল মাসের শুরুতে মুক্তিযােদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সড়ক প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। শুরুতেই তারা উজানিসার ব্রিজ ও দরুইন ব্রিজের কাছে প্রতিরক্ষাব্যুহ স্থাপন করেন। একই সময় কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে পাকবাহিনী রওনা হয়। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থানরত ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ওপর আক্রমণ করার জন্য অগ্রসর হতে থাকে। উজানিসার এলাকায় পৌঁছালে পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধের মুখে পড়ে এবং তারা এক পর্যায়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এপ্রিল মাসে পাকবাহিনী উজানিসার ব্রিজের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেঙ্গে আখাউড়ায় অনুপ্রবেশ করে এবং বেশ কয়েকটি ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রথমে দেবগ্রামে একটি ক্যাম্প স্থাপনের পর পর্যায়ক্রমে তারা আখাউড়া রেলওয়ে জংশন, আবু তাহেরের বাড়ি, রেলওয়ে রেস্ট হাউজ, খড়মপুর ও আজমপুর এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে।
মুক্তিযুদ্ধবিরােধী লােকজনকে নিয়ে আখাউড়ায় রাজাকারবাহিনী ও শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যে শান্তি কমিটির তৎপরতা ছিল উল্লেখযােগ্য। এর নেতৃত্বে ছিল এম এ তাহের (আখাউড়া সদর)। শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় ২০০ জনের মতাে। তাদের মধ্যে এম এ তাহের, মােবারক হােসেন, নওয়াব মিয়া, সেলিম খাদেম, আব্দুল হামিদ, ফারুক মিয়া, কিছমত আলী খাদেম, ফরহাদ খাদেম, মদন মিয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য।
পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা আখাউড়ার বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, নারীনির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগের ঘটনা ঘটায়। একটি সভায় যােগদান করার কথা বলে ২২শে আগস্ট দুপুরে তারা মােগড়া ইউনিয়নের জাঙ্গাল ও টানমান্দাইল গ্রামের ১৩০ জনকে গঙ্গাসাগর দীঘির পাড়ে নিয়ে আসে। পরদিন এদের মধ্য থেকে বেছে-বেছে মুক্তিবাহিনীর পরিবারের ৩২ জন সদস্যকে সারি বেঁধে দাঁড়করিয়ে তারা গুলি করে হত্যা করে এবং বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে গণকবর দেয়। এটি গঙ্গাসাগর গণহত্যা নামে পরিচিত। পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা কিশােরী জোহরাকে জোর করে তাদের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। এবং একদিন তাকে সেখানে। আটক রেখে তার ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। পরদিন এলাকার মুরব্বি জমসিদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী ও আবু মিয়া তাকে সেখান থেকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। এছাড়া পাকসেনারা সুফিয়া বেগম, জুবেদা খাতুন, আনােয়ারা বেগম ও রেনু বেগমের। ওপরও নির্যাতন চালায়।
আখাউড়া রেলওয়ে জংশন স্টেশনের পূর্বপাশে রেলওয়ে রেস্ট হাউজ, রাধানগরের করিম গার্ডের বাড়ি ও খড়মপুর প্রাথমিক স্কুল ছিল পাকসেনাদের নির্যাতনকেন্দ্র। আগস্ট মাসে পাকহানাদার বাহিনী উপজেলার নারায়ণপুরে এক গণহত্যা চালায়, যা নারায়ণপুর গণহত্যা নামে পরিচিত। এতে ১৭ জন গ্রামবাসী নিহত হন। এছাড়াও উপজেলায় অনুপ্রবেশের পর থেকে একাধিক গণহত্যা সংঘটিত করে এবং নিহতদের স্থান হয় গণকবরে।
আখাউড়াতে বেশ কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলাে হলাে- গঙ্গাসাগর গণকবর, টানমান্দাইল গণকবর, নারায়ণপুর গণকবর, সেনারবাদী নাে-ম্যান্সল্যান্ড গণকবর, তারাগন গণকবর ও ধাতুরপহেলা গণকবর।
এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাকবাহিনী দরুইন দিয়ে আখাউড়ায় প্রবেশের চেষ্টা করে। এসময় মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ গড়ে তুললে যুদ্ধ হয়। এক পর্যায়ে গােলা-বারুদ ফুরিয়ে গেলে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটেন। এ-যুদ্ধে সিপাহি মােস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ এবং মানিক মিয়াসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। এটি দরুইনের যুদ্ধ নামে পরিচিত। ৩০শে নভেম্বর থেকে ১লা ডিসেম্বর পর্যন্ত আখাউড়ার উত্তর সীমান্তবর্তী আজমপুর ও রাজাপুরে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ৩রা ডিসেম্বর রাতে মুক্তিযােদ্ধারা আজমপুরে শক্ত অবস্থান নিলে পাকবাহিনীর সঙ্গে তাঁদের ব্যাপক যুদ্ধ হয়। এ-যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। এটি আজমপুর যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। ৪ঠা ডিসেম্বর আজমপুরে পাকসেনাদের মর্টার শেলের আঘাতে শহীদ হন লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল।
৪ঠা ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। সম্মিলিতভাবে আখাউড়ায় পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ করে। ৫ই ডিসেম্বর সারাদিন ও সারারাত তুমুল যুদ্ধের পর ৬ই ডিসেম্বর আখাউড়া সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত হয়। পরে আখাউড়া ডাকঘরের সামনে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উত্তোলন করেন মুক্তিযুদ্ধকালীন পূর্বাঞ্চলীয় জোনের বেসামরিক প্রশাসক জহুর আহাম্মদ চৌধুরীসহ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- মাে. আলমগীর করিম, বীর প্রতীক, আব্দুর রহমান, বীর প্রতীক- (টানপাড়া), মাে. নােয়াব মিয়া বীর প্রতীক (হীরাপুর), সফিল মিয়া, বীর উত্তম (রাজাপুর), আবু সালেহ মােহাম্মদ নাসিম, বীর বিক্রম, আব্দুল হক ভূঁইয়া, বীর বিক্রম, আবুল হাসেম খান, বীর প্রতীক, আব্দুর রশিদ, বীর প্রতীক, মােহাম্মদ হােসেন, বীর প্রতীক, মঙ্গল মিয়া, বীর প্রতীক, তাজুল ইসলাম ভূঁইয়া, বীর প্রতীক, দেলােয়ার হােসেন, বীর প্রতীক, কাজী মুরশেদুল আলম, বীর প্রতীক, শহিদুল হক ভূঁইয়া, বীর প্রতীক, মাে. জাহাঙ্গীর ওসমান ভূঁইয়া, বীর প্রতীক ও এ এম মাে. ইসহাক, বীর প্রতীক। এখানকার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- আব্দুর রহিম (বা-সার), মাে. আলমগীর করিম, বীর প্রতীক (আখাউড়া), আব্দুল মতিন (উমেদপুর), আমীর হােসেন (রাধানগর), আলতাফ আলী (দেবগ্রাম), আব্দুর রহমান, বীর প্রতীক (টানপাড়া), মাে. নােয়াব মিয়া বীর প্রতীক (হীরাপুর), সফিল মিয়া, বীর উত্তম (রাজাপুর), কাজী মুরশেদুল আলম, বীর প্রতীক (নিলাখাদ), মানিক মিয়া (বরিশাল), সিপাহি মােস্তফা কামাল, বীরশ্রেষ্ঠ এবং লেফটেন্যান্ট ইবনে ফজল। মুক্তিযােদ্ধাদের নামে আখাউড়ায় বেশ কয়েকটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলােমানিক মিয়া, আমীর হােসেন, আলমগীর কবির এবং এ এম মাে. ইসহাক সড়ক। এছাড়া উপজেলা প্রাঙ্গণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি কলেজ এবং কলেজের পাশে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ মােস্তফা কামালের শহীদ হওয়ার স্থানে সমাধি নির্মিত হয়েছে। [বিশ্বজিৎ পাল বাবু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড