You dont have javascript enabled! Please enable it!

আগাঠাকুরপাড়ার যুদ্ধ (তালতলী, বরগুনা)

সংঘটিত হয় ১৭ই নভেম্বর। এতে দুজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।
আগাঠাকুরপাড়া বরগুনা জেলার তালতলী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত রাখাইন আদিবাসী অধ্যুষিত একটি গ্রাম। ১৯৭১ সালের ১৭ই নভেম্বর দুপুর থেকে প্রায় দুঘণ্টাব্যাপী পাকবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদরবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে নায়েক সুবেদার হাতেম আলী (বামনা, বরগুনা) যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। বামনা, গলাচিপা, বাকেরগঞ্জ, নলসিটি ও স্থানীয় রাখাইন যুবকরা এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। রাখাইন নারীপুরুষ সদস্যরাও যুদ্ধে সম্পৃক্ত হয়েছিল। ২৫শে মার্চ পাকসেনাদের পৈশাচিক হামলার পর এ গ্রামের রাখাইন যুবকরা মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত হতে থাকে। এসময় পাক সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে আসা নায়েক সুবেদার হাতেম আলী বিভিন্ন এলাকার কিছু ছাত্র ও যুবকদের নিয়ে রাখাইন পাড়ায় অবস্থান নেন এবং রাখাইন যুবকসহ ৪০-৪৫ জনকে নিয়ে একটি বাহিনী গঠন করেন। মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলের দায়িত্বে নিয়ােজিত সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন মেহেদীর নির্দেশনায় হাতেম আলীকে গ্রুপ ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব দেয়া হয়। হাতেম আলীর নেতৃত্বে শুরু হয় রাখাইন ও বাঙালি যুবকদের মধ্যে অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাখাইন ছাত্র উসিট মং, তার ছােট ভাই অং সিট রাখাইন ও যুবনেতা থয়া অং-এর উৎসাহ ও উদ্যোগে এ পাড়ায় গড়ে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প। ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধাদের সার্বিক সহযােগিতা করতেন রাখাইন লাথান ও থয়লা চিং। লাথানর মেয়ে খাইয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের খাবারের ব্যবস্থা করত। বরিশাল মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন ছাত্রী ডা. নেনিয়ে চিন একজন মহিলা। মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন (বর্তমানে তিনি সপরিবারে আমেরিকায় বসবাস করেন)। মুক্তিযুদ্ধকালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী এথিন রাখাইন ডা. নেনিয়ে চিন-এর সঙ্গে সার্বক্ষণিক অবস্থান করে মুক্তিযােদ্ধাদের সেবা-শুশ্রুষা করতেন। এথিন রাখাইনের তিন ভাই উসিট মং, অং সিট ও অং থান মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। এথিন রাখাইন বৈবাহিক সূত্রে পরবর্তীতে কক্সবাজার চলে যান এবং ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে কক্সবাজার, বান্দরবান, রাংগামাটি ও খাগড়াছড়ির সংরক্ষিত মহিলা আসনে। আওয়ামী লীগ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ঈদের ৩-৪ দিন পূর্বে কলাপাড়া থানা থেকে পাকসেনা ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদর বাহিনী হঠাৎ করে আগাঠাকুরপাড়ার চারদিক ঘেরাও করে ফেলে। পাকসেনারা খালের মধ্যে ঢুকে গানবােট থেকে শেল নিক্ষেপ এবং রাজাকার-আলবদর বাহিনী চারদিক থেকে গােলাগুলি শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ করেন। সময়টা ছিল দুপুর। দুঘণ্টাব্যাপী উভয়পক্ষে যুদ্ধ চলে। এ-সময় গ্রামবাসীরা ভয়ে ছােটাছুটি শুরু করে। জনসাধারণের জানমাল বাঁচানাের জন্য কৌশলগত কারণে গ্রুপ ক্যাপ্টেন হাতেম আলীর নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে যান। চারজন মুক্তিযােদ্ধা ধান ক্ষেতে পালিয়ে থাকেন। তাঁরা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। রাজাকার-আলবদররা লুটপাট শুরু করে এবং কয়েকটি ঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রেফতারকৃত মুক্তিযােদ্ধারা হলেনফজলুর রহমান সাজু (পিতা লুৎফর রহমান, গলাচিপা, পটুয়াখালী), এ এম আলি চৌধুরী (নলছিটি, ঝালকাঠি; সেনা সদস্য), রুস্তুম ও মােখলেসুর রহমান। যুদ্ধ শেষে আটককৃত ৪ জন মুক্তিযােদ্ধাকে পাকসেনারা কলাপাড়া থানায় নিয়ে নির্যাতন শুরু করে। একদিন পর তাঁদের পটুয়াখালী জেলা কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। ঈদের দিন রাত ১২টার পর পাকসেনারা মুক্তিযােদ্ধা মােখলেসুর রহমান ও এস এম আলী চৌধুরীকে পাটুয়াখালী থানার সামনে লাউকাঠি নদীর পাড়ে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গুলি করে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। মুক্তিযােদ্ধা ফজলুর রহমান সাজু ও রুস্তুম বেঁচে জান। ৮ই ডিসেম্বর পটুয়াখালীতে পাকসেনাদের পতন হলে তাঁরা দুজন মুক্তি পান। আগাঠাকুরপাড়া যুদ্ধে সুবেদার হাতেম আলীর নেতৃত্বে আরাে যারা যুদ্ধ করেন তাঁদের মধ্যে হাবিবুর রহমান, মােয়াজ্জেম হােসেন, আবদুর রাজ্জাক খান, আফাজউদ্দিন বিশ্বাস, আলতাফ হােসেন চেয়ারম্যান, মােতালেব মাস্টার, শাহজাহান, সিরাজউদ্দিন, বজলুর রশিদ দুলাল, মােসলেম হাওলাদার প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। [শামসুল আলম]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!