আগৈলঝাড়া উপজেলা (বরিশাল)
বরিশাল জেলার উত্তর দিকে মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলা সংলগ্ন এলাকা। মুক্তিযুদ্ধকালে এ উপজেলা গৌরনদী উপজেলার অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর উত্তরে কালকিনি, পূর্বে গৌরনদী ও উজিরপুর, দক্ষিণে উজিরপুর এবং পশ্চিমে কোটালীপাড়া উপজেলা। আগৈলঝাড়া থানা গঠিত হয় ১৯৮১ সালের ১৬ই জুন এবং ১৯৮৩ সালের ৭ই নভেম্বর ৫টি ইউনিয়ন নিয়ে উপজেলায় রূপান্তরিত হয়। বিলাঞ্চল হিসেবে পরিচিত এ উপজেলা ছিল মুলত হিন্দু অধ্যুষিত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-এর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নিলে সারা দেশের মতাে এখানকার মানুষও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ অঞ্চলের মানুষের প্রিয় নেতা ও আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমএনএ আবদুর রব সেরনিয়াবাত এলাকার ছাত্রযুবকদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য উদ্বুদ্ধ করতে থাকেন।
বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর পর আবদুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ, এডভােকেট করিম সরদার এমপি, নিজামুদ্দিন আকন (হােসনাবাদ), আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মতলেবুর রহমান (নাঠৈ), কমিউনিস্ট নেতা মিহির দাসগুপ্ত (গৈলা), মতিউর রহমান তালুকদার, ন্যাপ নেতা ফকরুল আলম (নাঠৈ), ছাত্রলীগ নেতা আইয়ুব আলী মিয়া, মাে. সফি (বিল্লগ্রাম), নুর মােহম্মদ গােমস্তা (বিল্লগ্রাম), ফজলু ভূইয়া (বাশাইল), কাজী শাহআলম (ভালুকশী) প্রমুখের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম শুরু হয়। ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর গৈলা হাইস্কুল মাঠে স্থানীয় ছাত্রযুবকদের নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। আনসার কমান্ডার শাহ সেকান্দার, সিপাহি আলাউদ্দিন বকস্, আনসার কমান্ডার মৌজে আলী, ডা. হারেস মােল্লা, মােসলেম মাস্টার (গৈলা হাইস্কুল) প্রমুখ এখানে প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। স্থানীয়ভাবে আমবৌলা ইউনাইটেড ক্লাব মাঠ এবং সুরেন চ্যাটার্জীর বাড়িতে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। তাছাড়া গৌরনদী কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ চলে, যেখানে আগৈলঝাড়ার অনেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
১৫ই মে বাট্টা হাইস্কুল মাঠে সেনাসদস্য হেমায়েত উদ্দিন, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে আসমত আলী খান এমপিএ, হরনাথ বাইন এমপিএ এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে হাজারাে জনতার মাঝে হেমায়েত বাহিনীর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। এ-সময় হেমায়েত উদ্দিন নিজে মেজর উপাধি গ্রহণ করেন। উপজেলার আলতাব হােসেন (পিতা মকবুল হােসেন বেপারী, মধ্য সিহিপাশা), মাে. হােসেন মিয়া (পিতা সফিজ উদ্দিন মিয়া, বাকল), কাজী ইলিয়াস হােসেন (পিতা কাজী আবদুল হাই, ভালুকশী), সেকেন্দার আলী তালুকদার (পিতা তাহের আলী তালুকদার, বাদুরতলা), বিশ্বনাথ মল্লিক (পিতা অশ্বিনী কুমার মল্লিক, বাকাল), এম এ হক (পিতা আবদুস সাত্তার, ফুলুশ্রী), কাজী সাইফুল ইসলাম (পিতা কাজী আ. কাদের, ভালুকশী), গােলাম মােস্তফা সরদার (পিতা আলহাজ সুলতান মাহমুদ সরদার, বগরবাড়ি), কাজী বদিউজ্জামান (পিতা কাজী আবদুল হাই, ভালুকশী), কাজী আকরাম হােসেন (পিতা কাজী মুজাফফর হােসেন, ভালুকশী), মাে. আবদুল খালেক পাইক (পিতা মাে. আজাহার আলী পাইক, ফুল্লশ্রী), কাজী আলাউদ্দিন (পিতা কাজী আবেদীন, ভালুকশী), আবদুল কাইয়ুম বখতিয়ার (পিতা আবদুল লতিফ বখতিয়ার, পয়সারহাট), মাে. আশরাফ আলী পাইক (পিতা মাে. মণ্ডল পাইক, যবসেন), মাে. আবদুল আজিজ মােল্লা (পিতা লেহাজ উদ্দিন মােল্লা, রাজিহার), মাে. মাহবুবর রহমান (পিতা আবদুল অহেদ সরদার, ফুল্লশ্রী), মাে. আলী দেওয়ান (পিতা ইসমাইল দেওয়ান, পয়সারহাট), জাহেদা বেগম (পিতা আলী আহমেদ ভূঁইয়া, গৈলা), ফরিদা বেগম (পিতা গণি বেপারী, রাংতা), কমলা রাণী (পয়সারহাট) প্রমুখ হেমায়েত বাহিনীতে যােদ্ধা হিসেবে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন।
আগস্ট মাসে হেমায়েত উদ্দিনের নেতৃত্বে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা সেবার জন্য পয়সারহাটে নির্মিত হয় ২পয়সারহাট মুক্তিযােদ্ধা হাসপাতাল ৬ জন ডাক্তার, ২ জন ফার্মসিস্ট, ৭ জন সমাজকর্মী এবং ৪ জন সেবিকা এখানে চিকিৎসা সেবায় নিয়ােজিত ছিলেন। ডা. বি কে রঞ্জিত, তাঁর স্ত্রী মনা রানী ব্যানার্জী (পয়সারহাট, বাকাল) ও মঞ্জুরানী রায় (রাজিহার) এ হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ, এডভােকেট করিম সরদার এমপিএ, নিজামুদ্দিন আকন (হােসনাবাদ), আওয়ামী লীগ নেতা সৈয়দ মতলেবুর রহমান (নাঠৈ), কমিউনিস্ট নেতা মিহির দাসগুপ্ত (গৈলা), মতিউর রহমান তালুকদার, ন্যাপ নেতা ফকরুল আলম (নাঠৈ), ছাত্রলীগ নেতা আইয়ুব আলী মিয়া (কমান্ডার, উপজেলা মুক্তিযােদ্ধা কমান্ড), মাে. সফি (বিল্লগ্রাম), নুর মােহম্মদ গােমস্তা (বিল্লগ্রাম), ফজলু ভূঁইয়া (বাশাইল), কাজী শাহআলম (ভালুকশী) প্রমুখ ছিলেন উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সংগঠক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
উপজেলার অনেকেই হেমায়েত বাহিনীর সদস্য ছিলেন, যারা পয়সার হাটের যুদ্ধসহ অনেকগুলাে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর নেতৃত্বে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা এলাকায় সক্রিয় ছিলেন। তাছাড়া বেইজ কমান্ডার আইয়ুব আলী মিয়া, রফিক সেরনিয়াবাত, মাে. রহমান (ন্যাপ ও কমিউনিস্ট)-এর নেতৃত্বে একটি গেরিলা বাহিনী গড়ে ওঠে।
২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বরিশাল শহরে অনুপ্রবেশকালে গৌরনদী উপজেলার কটকস্থলে সুবেদার সৈয়দ আবুল হাশেমের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। উভয় পক্ষের যুদ্ধে আগৈলঝাড়ার সিপাহি আলাউদ্দিনসহ ৬ জন শহীদ হন। এটিই দক্ষিণাঞ্চলে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। ২৫শে এপ্রিল গৌরনদী কলেজে পাকবাহিনী অনুপ্রবেশ করে ক্যাম্প স্থাপন করে। পরবর্তী সময়ে তারা গৌরনদী থানা, বাটাজোড় অশ্বিনীকুমার ইনস্টিটিউশন ও মাহিলাড়ায় ক্যাম্প স্থাপন করে। রাজাকার কমান্ডার আফতাবউদ্দিন মুন্সীর বাড়ি ছিল রাজাকার ক্যাম্প। এ সকল ক্যাম্প থেকে তারা গৌরনদীসহ আগৈলঝাড়ার বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশন চালিয়ে গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ করত। ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী গৌরনদী কলেজে ক্যাম্প স্থাপনের পর তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। মুসলিম লীগ নেতা আফতাব উদ্দিন মুন্সী (গৈলা) ছিল শান্তি কমিটির সভাপতি। শান্তি কমিটির অন্য সদস্যরা হলাে- হালিম দাড়িয়া, সাহাবুদ্দিন মাওলানা, রেজাউল পাইক, বশির ফকির, নজর আলী ফকির, সােনামুদ্দি বাদ্যকার, মােহন বাদ্যকার প্রমুখ। আফতাবুদ্দিন মুন্সি গৈলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি দখল ও মুন্সিবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত টর্চার সেলের নেতৃত্বে ছিল। গৈলা ইউনিয়নের নেছের উদ্দিন বেপারী এবং মাহিলাড়ার খাদেম মিলিটারি, প্রফুল্ল অরিন্দা ছিল কুখ্যাত রাজাকার। শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, দখল, নারীনির্যাতনসহ পাকসেনাদের নির্দেশিত সকল ধরনের অপরাধমূলক কাজে তৎপর ছিল। পাকিস্তানি বাহিনী গৌরনদী কলেজে ক্যাম্প স্থাপনের পর তাদের দোসর শান্তি কমিটির সদস্য এবং রাজাকারদের সহায়তায় আগৈলঝাড়ার বিভিন্ন এলাকায় গণহত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে। ১৬ই মে তারা দি রয়েল বেঙ্গল সার্কাসের মালিক লক্ষ্মণ দাস এবং তাঁর হাতি গুলি করে হত্যা করে। তারা বিজয় কৃষ্ণ ভূঞ্জমালির বাড়িতে অগ্নিসংযােগ ও তাকে হত্যা করে। হানাদার বাহিনী উপজেলায় অনেকগুলাে গণহত্যা সংঘটিত করে। সেগুলাে হলাে- কোদালধােয়া গণহত্যা, সিহিপাশা হাওলাদার বাড়ি গণহত্যা, কেতনার বিল গণহত্যা, পতিহার গণহত্যা, রাংতা বেপারী বাড়ি গণহত্যা, কাঠিরা গণহত্যা, রথখােলা গণহত্যা, বাগদা দাসপাড়া গণহত্যা, রাজিহার খ্রিস্টানপাড়া গণহত্যা ও বাকাল গণহত্যা আগৈলঝাড়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৫ কিমি উত্তরপশ্চিমে বাকাল ইউনিয়নের কোদালধােয়া গ্রাম। পাকিস্তানি বাহিনী ১লা মে এখানে নৃশংস গণহত্যা চালায়। এতে বেশ কয়েকজন গ্রামবাসী শহীদ হন।
১৪ই মে গৌরনদী উপজেলার দোনারকান্দিতে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হেরে যায়। পরের দিন ১৫ই মে তারা স্থানীয় রাজাকার নুরু খানের সহযােগিতায় দক্ষিণ সিহিপাশা গ্রামের হাওলাদার বাড়িতে প্রতিশােধমূলক হামলা, অগ্নিসংযােগ ও গণহত্যা চালায়। হাওলাদার বাড়ির এ গণহত্যায় কয়েকজন এলাকাবাসী শহীদ হন। একই দিন পাকিস্তানি বাহিনী রাংতা গ্রামের বেপারী বাড়ি (বইয়ের বাড়ি) গণহত্যা চালায়। তারা বাড়ির প্রতিটি ঘরে অগ্নিসংযােগ করে এবং আশ্রয় নেয়া প্রায় সকলকে হত্যা করে। বেপারী বাড়ি গণহত্যায় টরকী বন্দর থেকে আশ্রয় নেয়া ব্যবসায়ী নির্মল চক্রবর্তীর পরিবার এবং তাঁর স্ত্রীর বােনের পরিবারের ১০ জন সদস্যসহ বেশ কয়েকজন মানুষ শহীদ হন।
আগৈলঝাড়া সদর থেকে প্রায় ৬ কিমি দূরে কেতনার বিলে ১৫ই মে হানাদার বাহিনী গণহত্যা সংঘটিত করে। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিরাপদ স্থান হিসেবে আশ্রয় নেয়া সহস্রাধিক মানুষসহ ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র স্বপন বসু ও তাঁর দুই বােন এ গণহত্যার শিকার হন। উপজেলার বিলাঞ্চলের পতিহার গ্রামে ১৬ই মে সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল গৌরনদী ক্যাম্প থেকে বিল্বগ্রাম হয়ে আবদুর রব সেরনিয়াবাত-এর বাড়ি সেরাল যাওয়ার পথে গণহত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযােগ করে। রাজাকার শাহ আলী এবং তফিজউদ্দিন মৃধার দেখানাে পথে তারা মজুমদার বাড়ি, শীল বাড়ি ও চিত্ত ডাক্তারের বাড়িতে অগ্নিসংযােগ করে এবং যাকে যে অবস্থায় পেয়েছে সেখানেই হত্যা করেছে। ৩০শে মে হানাদার বাহিনী কাঠিরা গণহত্যা সংঘটিত করে। হিন্দু এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায় অধ্যুষিত এ গ্রামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে রয়েছে ব্যাপ্টিস্ট সম্প্রদায়ের একটি চার্চ এবং হিন্দুদের পূজামণ্ডপ। রাজাকার প্রফুল্ল অরিন্দার দেখানাে পথে হানাদার বাহিনী কাঠিরা চার্চে গণহত্যা চালায়। কাঠিরা গণহত্যায় দূর-দূরান্ত থেকে এসে আশ্রয় নেয়া শতাধিক লােক নিহত হন।
আগৈলঝাড়া উপজেলা সদর থেকে ৫ কিমি পূর্বদিকে গৈলা ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম রথখােলায় ৩০শে মে হানাদার বাহিনী স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার ওমর আলী, আব্দুল হালিম, মােহাম্মদ আলী প্রমুখের সহায়তায় গণহত্যা চালায়। এতে অগ্নিদগ্ধ হয়ে দুজন বৃদ্ধা এবং কয়েকজন এলাকাবাসী শহীদ হন। আগৈলঝাড়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিমি দূরে বাগদা দাসপাড়ায় ১৬ই জুন স্থানীয় রাজাকার কমান্ডার আক্কেল আলী বালী, সাত্তার প্রমুখের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনী বিকেল ৪টার দিকে বাগদা দাসপাড়ায় আক্রমণ করে লুণ্ঠন এবং গণহত্যা চালায়। গ্রামের বেশ কয়েকজন মানুষ এ গণহত্যার শিকার হন, যাদের মধ্যে কোটালীপাড়া থেকে বেড়াতে আসা একই পরিবারের ৩ জন সদস্য ছিলেন। ১৭ই জুন সােমবার দুপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দল গৌরনদী কলেজ ক্যাম্প থেকে চাঁদশী হয়ে আগৈলঝাড়া উপজেলার রাংতা ইউনিয়নের রাজিহার গ্রামের খ্রিস্টানপাড়ায় উপজেলা শান্তি কমিটির সভাপতি আফতাব মুন্সীর ভাই জয়নাল মুন্সীর নির্দেশে আক্রমণ করে এবং গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সৈন্যরা পাড়ার পুরুষ সদস্যদের বাকাল ব্রিজের ওপর নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। রাজিহার খ্রিস্টানপাড়া গণহত্যায় ১৫ জন গ্রামবাসী শহীদ হন। আগৈলঝাড়া উপজেলার ৪ কিমি উত্তর-পশ্চিম দিকে বিলাঞ্চলে বাকাল গ্রামে পাকিস্তানি সৈনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ২০শে জুন গণহত্যা, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযােগ করে। গ্রামের বেশ কয়েকজন মানুষ এ গণহত্যার শিকার হন। হানাদার বাহিনীর গৌরনদী কলেজ ক্যাম্প, গৌরনদী থানা ক্যাম্প, বাটাজোড় অশ্বিনীকুমার হাইস্কুল এবং গৈলা মুন্সি বাড়ি ক্যাম্প ছিল নির্যাতনকেন্দ্র এবং বন্দিশিবির তৎসংলগ্ন হাতেম আলী পিওনের বাড়ির খালের ঘাটলায় মানুষ জবাই করে হত্যা ও নির্যাতন করা হতাে।
রাংতা ইউনিয়নের রাজিহার গ্রামের বাকাল ব্রিজ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বধ্যভূমি। এখানে ১৭ই জুন তারা গণহত্যা সংঘটিত করে। অমূল্য পাত্র ও মণীন্দ্র পাত্রের বাড়ি, রাংতা বেপারী বাড়ি, কাঠিরা চার্চ, বাগদা দাসপাড়া নীলকান্ত ধুপীর বাড়ি ও নারায়ণ ধুপীর বাড়িতে গণকবর রয়েছে। উপজেলার সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য গণকবর হলাে রাজিহার খ্রিস্টানবাড়ি গণকবর।
আগৈলঝাড়া উপজেলায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের কয়েকটি যুদ্ধ হয়। এর মধ্যে পয়সারহাট যুদ্ধ এবং আমবৌলার যুদ্ধ উল্লেখযােগ্য। কোটালীপাড়ার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে হানাদার বাহিনী প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়। প্রতিশােধ নিতে তারা ২১শে মে রাজাপুর গ্রামে হেমায়েত বাহিনীর ঘাঁটি উচ্ছেদকল্পে আক্রমণ করলে পয়সারহাটে তাদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। এছাড়া আমবৌলায় আইয়ুব আলী মিয়ার নেতৃত্বে পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। এ উপজেলার হেমায়েত বাহিনীর অনেক সদস্য বিভিন্ন যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। হেমায়েত বাহিনীর সদস্য বাশাইলের নূরু বেপারী ও সেকান্দার আলী গৌরনদী যুদ্ধে শহীদ হন। ২২শে ডিসেম্বর গৌরনদী উপজেলা হানাদারমুক্ত হওয়ার দিনেই আগৈলঝাড়া উপজেলা হানাদারমুক্ত হয়।
উপজেলার খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা হলেন আলিমুল ইসলাম, বীর প্রতীক (রত্নপুর)।
আগৈলঝাড়া উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- সেনাসদস্য আলাউদ্দিন বকস্ (পিতা আব্দুল হাসেম সরদার, গৈলা; ২৫শে এপ্রিল কটকস্থলে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ যুদ্ধে শহীদ), মােস্তাফা হাওলাদার (পিতা ফেলু চৌকিদার, উত্তর সিহিপাশা), নুরুল ইসলাম (পিতা কাশেম হাওলাদার, দক্ষিণ সিহিপাশা), সেনাসদস্য সিরাজুল ইসলাম (পিতা বলু সেপাই, সেরাল), মান্নান মােল্লা (পিতা রওশন মােল্লা, মধ্য সিহিপাশা), আব্দুল মান্নান খান (পিতা আদরী খান, ভালুকশী), গােলাম মাওলা (পিতা মুন্সি মতিউর রহমান, বাশাইল), সেকেন্দার আলী বেপারী (পিতা শাহমদ্দিন, ছােট বাশাইল), আব্দুল হক হাওলাদার (পিতা ফয়জোর আলী হাওলাদার, বসুণ্ডা), আব্দুল আজিজ সিকদার (পিতা হাসান উদ্দিন, বাশাইল), সামসুল হক (পিতা খাদেম আলী, পয়সা), ইপিআর সদস্য মনসুর আহম্মদ আকন (পিতা ইসলাম আকন, ফুলুশ্রী), তৈয়ব আলী বক্তিয়ার (পিতা ইউসুব বক্তিয়ার, চাত্রীশিরা), কাজী আব্দুস সালাম (পিতা আ. সাত্তার, বেলুহার), ফজলুল হক হাওলাদার (পিতা হােসেন। হাওলাদার, রত্নপুর) ও ইপিআর সদস্য মহসিন আলী (পিতা। আব্দুল আজিজ, বরিয়ালী)।
কাঠিরা গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ এবং রাজিহার খ্রিস্টানপাড়া গণহত্যায় শহীদদের গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয়েছে। গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে কটকস্থল যুদ্ধে শহীদ সিপাহি আলাউদ্দিনের কবর বাঁধাই করে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। বাকাল গ্রামে শহীদ সুরেন চ্যাটার্জী স্মরণে স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। আগৈলঝাড়া কলেজের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাদ কলেজ’। [মনিরুজ্জামান শাহীন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড