আকরাম আহমেদ, বীর উত্তম
আকরাম আহমেদ, বীর উত্তম (জন্ম ১৯৪৬) বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি ১৯৪৬ সালের ৯ই জানুয়ারি যশাের শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ এবং মাতার নাম মাফিয়া খাতুন। তিনি ১৯৬১ সালে খুলনা সেন্ট জোশেফ স্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৬৩ সালে ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এ বছরই তিনি ঢাকা ফ্লাইং ক্লাবে ভর্তি হয়ে বিমান চালানাের প্রশিক্ষণ শুরু করেন। সফলতার সঙ্গে প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬৭ সালে তিনি বিমান চালানাের বাণিজ্যিক লাইসেন্স প্রাপ্ত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তান এয়ারলাইন্স-এ পাইলট হিসেবে যােগ দেন। ঐ বছরই তিনি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন কৃষি মন্ত্রণালয়ে প্লান্ট প্রটেকশন বিভাগে যােগ দেন। তাঁর দায়িত্ব ছিল বিমান থেকে ঔষধ ছিটিয়ে পােকার আক্রমণ থেকে বন রক্ষা করা।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে আকরাম আহমেদ ঢাকার পূর্ব পাকিস্তান উদ্ভিদ রক্ষা (প্লান্ট প্রটেকশন) বিভাগে কর্মরত ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট-এর নামে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর গণহত্যা ও নির্যাতন শুরু করলে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের সুযােগ খুঁজতে থাকেন। মে মাসে তিনি ঢাকা থেকে পালিয়ে আগরতলা যান এবং মেজর খালেদ মােশাররফ, বীর উত্তম-এর সঙ্গে দেখা করে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন।
২৮শে সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধে বিমান উইং (বাংলাদেশ বিমানবাহিনী) গঠিত হলে আকরাম আহমেদ এ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হন। ভারতের দেয়া একটি ডিসি-৩ ডাকোটা বিমান (যােধপুর মহারাজার নিকট থেকে উপহার হিসেবে প্রাপ্ত), একটি অটার বিমান ও একটি এলুয়েট হেলিকপ্টার দিয়ে ভারতের নাগল্যান্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে এ বাহিনীর কার্যক্রম শুরু হয়। ১লা অক্টোবর থেকে এ বাহিনীর মুক্তিযােদ্ধাদের ব্যাপক প্রশিক্ষণ, অনুশীলন ও মহড়া শুরু হয়। তিনি ও তাঁর সহযােদ্ধারা জঙ্গলাকীর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে অনেক নিচু দিয়ে রাতের বেলা শুধু কম্পাসের ওপর নির্ভর করে বিমান চালিয়ে আলােবিহীন রানওয়েতে অবতরণের মতাে কঠিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। প্রশিক্ষণ শেষে আকরাম আহমেদ পাকিস্তানি সেনাদের তেলের ডিপাে, ঘাঁটি ও কনভয়ের ওপর ১২টি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। সে-সবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য হলাে চট্টগ্রামের ইস্টার্ন রিফাইনারি অপারেশন। পাকিস্তানি বাহিনীর জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে ৩রা ডিসেম্বর তিনি তাঁর সহযােদ্ধা শামসুল আলম, বীর উত্তম-কে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি, সেনাদের রাডারকে ফাঁকি দিয়ে ইস্টার্ন রিফাইনারির ওপর আকাশ থেকে রকেটের সাহায্যে আক্রমণ করেন। বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে মােট চারবার আক্রমণ করে ইস্টার্ন রিফাইনারির সবগুলাে তেলের ডিপাে তাঁরা জ্বালিয়ে দেন। উল্লেখ্য, একই দিনে এ বাহিনীর সাহাবুদ্দিন আহমেদ, বীর উত্তম, সুলতান মাহমুদ, বীর উত্তম ও বদরুল আলম, বীর উত্তম, এলুয়েট হেলিকপ্টার নিয়ে নারায়ণগঞ্জের গােদনাইল তেলের ডিপােগুলাে আক্রমণ করে জ্বালিয়ে দেন। এর ফলে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কার্যক্রম দু-এক দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার আকরাম আহমেদকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করে (গেজেট নং ৭২, খেতাবের সনদ
নং ৬৫)। মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি বাংলাদেশ বিমানে পাইলট হিসেবে যােগদান করেন এবং পরবর্তীতে ক্যাপ্টেন পদে উন্নীত হন। ২০০৬ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। তিনি দুই কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম লায়লা আহমেদ। [সাজাহান মিয়া]।
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড