You dont have javascript enabled! Please enable it!

আকাশবাণী

আকাশবাণী (প্রতিষ্ঠা ১৯৫৬) ভারতের সরকারি রেডিও আকাশবাণী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন, মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করা, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের খবর বিশ্ববাসীকে জানানাে এবং রণাঙ্গনের খবর প্রচারে অনন্যসাধারণ ভূমিকা পালন করে। ১৯৭১ সালে ভারতসহ সারা বিশ্বে এবং অবরুদ্ধ বাংলাদেশে থাকা বাঙালিরা দেশের ও মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ খবর, খবরের বিশ্লেষণ এবং যুদ্ধ সম্পর্কে দেশী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিক্রিয়া শােনার জন্য যেসব গণমাধ্যমের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল ছিল, সেগুলাের মধ্যে আকাশবাণী অন্যতম। আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে প্রচারিত সংবাদ, কথিকা, সংবাদ-বিশ্লেষণ, সঙ্গীত ও অন্যান্য অনুষ্ঠান বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য আকাশবাণী Friends of Liberaton War সম্মাননা লাভ করে।
ভারতের সরকারি বেতারযন্ত্র ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৬ সালে। তখন অল ইন্ডিয়া রেডিও-র সর্বভারতে যেসব কেন্দ্র ছিল, সেগুলাের একটি পূর্বভারতীয় শহর ঢাকায় ১৯৩৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারতের স্বাধীনতার পর ১৯৫৬ সালে ভারতের অল ইন্ডিয়া রেডিও-র আনুষ্ঠানিক নাম হয় আকাশবাণী। আকাশবাণী কলকাতা ও আগরতলা কেন্দ্র থেকে প্রধানত বাংলা ভাষায় সংবাদ ও অন্যান্য অনুষ্ঠান প্রচারিত হতাে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় ও দেশের অন্যান্য স্থানে স্বাধীনতার পক্ষের। সকল পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যম কোথাও পুড়িয়ে, কোথাও ভাংচুরের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়। ফলে মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ ও তা প্রচার এবং জনমত তৈরির জন্য স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ বেতার কেন্দ্রের পর বাংলাদেশের পক্ষে বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সংবাদ প্রচার ও অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যে প্রচার মাধ্যম বিশেষ ভূমিকা পালন করে সেটি হলাে আকাশবাণী, বিশেষ করে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র। ১৯৭১ সালে কেবল বাংলা নয়, আকাশবাণী কলকাতার বাইরের অন্যান্য কেন্দ্র থেকেও ভারতের অন্যান্য ভাষায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংবাদ ও অনুষ্ঠান তৈরি ও প্রচার করা হতাে।
আকাশবাণী ষাটের দশক থেকে পাকিস্তানে ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করা শুরু করে। ১৯৬৬ সালে ৬-দফা কেন্দ্রিক আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান ও আইয়ুব। সরকারের পতন ইত্যাদি বিষয় প্রচারের মাধ্যমে আকাশবাণী বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পক্ষে এক ধরনের ইতিবাচক অবস্থান নেয় বলে প্রতীয়মান হয়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর খবর আকাশবাণী গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। সেদিন বিকেলে আকাশবাণীর অফিসে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথা, দীনেন গুপ্তের সুর, বাংলাদেশের শিল্পী কামরুল হাসান ও ভারতের শিল্পী অংশুমান রায়ের কণ্ঠ নিয়ে তৈরি করা হয় বিখ্যাত গান শােন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনিপ্রতিধ্বনি’। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের নিজস্ব ও তাবেদার সংবাদ মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে ভারতের উস্কানি ও প্ররােচনা, মুক্তিযােদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী, ‘রাষ্ট্রবিরােধী’, ‘অনুপ্রবেশকারী’, ‘ভারতের চর ও এজেন্ট হিসেবে প্রচারণা করতে থাকে। পাকিস্তানিদের এসব প্রচারণার জবাব দেয়ার জন্য আকাশবাণী যাতে বিশেষ উদ্যোগ নেয় ও বিশেষ বুলেটিন প্রচার করে, সেজন্য ভারতের জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে। এ দাবি অনুযায়ী আকাশবাণী কার্যক্রম গ্রহণ করে। ১৭ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার-এর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আকাশবাণীর রিপাের্টাররা সরাসরি কভার করেন। অনুষ্ঠানের খবর গুরুত্বের সঙ্গে প্রচারিত হয়। আকাশবাণীর সকল কার্যক্রমের লক্ষ্য ছিল, অবরুদ্ধ বাংলাদেশ এবং ভারত ও পৃথিবীর অন্যান্য স্থানে যত বাঙালি ছিল তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করা, যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। তাঁদের মনােবল ও সাহস অক্ষুন্ন রাখা; বাংলাদেশ ও ভারতসহ বিশ্বব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন করা; পাকিস্তানি হানাদাররা বাংলাদেশে যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছিল সে-সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে জানানাে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে হানাদাররা কীভাবে পর্যুদস্ত ও পরাজিত হচ্ছিল, সে-চিত্র তুলে ধরা। আকাশবাণী এসব লক্ষ্য অর্জনে কেবল সফলই হয়নি, শরণার্থী-মুক্তিযােদ্ধা-সমগ্র বাঙালি জাতি ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিশ্ববাসীর কাছে এক অপরিসীম বন্ধুত্বের বাহনেও পরিণত হয়েছিল। আকাশবাণীর রিপাের্টাররা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রণাঙ্গন থেকে সংবাদ সংগ্রহ করতেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরােধ পর্যায় থেকে বিজয় অর্জন পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে তাঁরা যুদ্ধের সর্বশেষ সংবাদ সংগ্রহ করে প্রচার করতেন। আকাশবাণীর রিপাের্টাররা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে স্থাপিত বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল থেকে সর্বশেষ তথ্য নিয়ে প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ তৈরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় আকাশবাণীর সংবাদদাতাদের সংগৃহীত খবর কেবল তাদের বেতারে নয়, আকাশবাণীর টেলিভিশন, সংবাদপত্র ও অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমেও প্রেরিত ও প্রচারিত হতাে। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর পরিচালিত সকল গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন ও যুদ্ধ, বাংলাদেশ সরকার-এর মন্ত্রী ও সকল গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, বিভিন্ন সেক্টরের সেনাধিনায়ক, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর মন্ত্রীসভার প্রায় সকল সদস্যের বক্তব্য-বিবৃতি ও কার্যক্রম, শরণার্থীদের অবর্ণনীয় কষ্টকর জীবন, বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা-লুণ্ঠন-অগ্নিসংযােগনারীনির্যাতন, মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ঘটনাপ্রবাহ ইত্যাদি নিয়ে আকাশবাণী বিশেষ সংবাদ, বুলেটিন ও অনুষ্ঠান প্রচার করে। আকাশবাণী তখন এক ঘণ্টা পরপর সংবাদ পরিবেশন করত। এছাড়া কথিকা, কবিতা, সঙ্গীতানুষ্ঠান, নাটক, সাক্ষাৎকার, বক্তৃতা, শরণার্থী-সাধারণ মানুষের কথা ও যুদ্ধের সর্বশেষ খবর প্রচারিত হতাে। বিশেষ করে জনপ্রিয় ছিল রাত ১০টার খবর। আধ ঘণ্টার এ সংবাদ অনুষ্ঠান ৩টি ভাগে বিভক্ত ছিল। সংবাদ ছাড়া আকাশবাণীর সংবাদ পরিক্রমা’, ‘সংবাদ বিচিত্রা’, ‘দুই বাংলার মনের কথা’, ‘রেডিও কার্টুন ইত্যাদি অসম্ভব জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে আকাশবাণীর সংবাদ ও অনুষ্ঠান শােনার জন্য মানুষ উদ্গ্রীব হয়ে থাকত। প্রত্যেক ঘরে আকাশবাণীর সংবাদ ও বুলেটিন কখন প্রচারিত হয় সেই তালিকা গােপন স্থানে টানানাে থাকত। পাকবাহিনী বাংলাদেশে আকাশবাণীর প্রচার নিষিদ্ধ করে। কেবল নিষিদ্ধ করেই তারা ক্ষান্ত থাকেনি, সব সময় নজর রাখত মানুষ যাতে আকাশবাণী শুনতে না পারে। এজন্য লুকিয়ে-লুকিয়ে কাপড়ের নিচে রেডিও রেখে কিংবা নিম্ন ভলিউমে সে-সময় বাংলাদেশের সর্বত্র আকাশবাণী শােনা হতাে। আকাশবাণী শােনার কারণে অবরুদ্ধ বাংলাদেশে অনেক মানুষ বিভিন্ন স্থানে পাকসেনা ও রাজাকারদের হাতে নির্যাতন ভােগ করেছেন, অনেকে প্রাণও হারিয়েছেন। ১৯৭১ সালের আকাশবাণীর সংবাদদাতা, রিপাের্টার, সংবাদপাঠক ও সংবাদ বিশ্লেষকদের নাম বাংলাদেশের ঘরে-ঘরে পরিচিত ছিল। সংবাদপাঠক ও অনুষ্ঠান উপস্থাপক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, নিলীমা স্যানাল, উপেন তরফদার, জগন্নাথ বসু কিংবা সংবাদদাতা পঙ্কজ সাহা, সন্যাথ মুখার্জী, প্রণবেশ সেন প্রমুখ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষের কাছে অতিপ্রিয় এক একটি নাম ও আপনজন। আকাশবাণীর বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানে ‘শােনাে একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি, ‘বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে, ‘একটি ফুলকে বাঁচাবাে বলে’, ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই চলবে’, ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’, ‘পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে’ ইত্যাদি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অসংখ্য দেশাত্মবােধক গান নিয়মিত প্রচারিত হতাে। এসব দেশাত্মবােধক গান ও উদ্দীপনামূলক অন্যান্য আয়ােজন রণাঙ্গনের মুক্তিযােদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করত।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে আকাশবাণী পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের মনােবল ধ্বংস করতে বিশেষ বুলেটিন প্রচার করে। তারা যাতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ না করে আত্মসমর্পণ করে, সে আহ্বান জানায়। পাকিস্তানি সেনাদের ভীত-সন্ত্রস্ত করতে এও প্রচার করা হয় যে, মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিশােধপরায়ণ হবে, অতএব পাকিস্তানি সৈন্যদের অস্ত্র সমর্পণ করা উচিত। তাদের উদ্দেশে জেনারেল মানেক শ-র আত্মসমর্পণের একটি আহ্বান আকাশবাণী বারবার প্রচার করে। তাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের উদ্দেশে বলা হয়, অনেক দেরী হওয়ার আগেই আত্মসমর্পণ কর। আমাদের সৈন্যরা তােমাদের চারদিকে ঘিরে ধরেছে। তােমাদের যুদ্ধযন্ত্রের শক্তি অকেজো হয়ে গেছে। তার কাছ থেকে তােমাদের সাহায্য লাভের কোন আশাই আর নেই। এমনকি বাইরে থেকে বিমান সাহায্য আসার সম্ভাবনা নেই। অতএব তােমরা অস্ত্র ত্যাগ কর। তােমাদের বাঁচার কোন পথ নেই। মুক্তিবাহিনী এবং অন্যান্য যারা মুক্তির জন্য সংগ্রাম করছে তারা তােমাদের ঘিরে ধরেছে। তােমরা যে নিষ্ঠুর আচরণ করছ তারা তার প্রতিশােধ নেবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এখন তােমাদের একমাত্র পথ হল ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা। মিছি মিছি জীবন দানের দরকার নেই। বাড়িতে স্ত্রীপুত্র পরিবারের সঙ্গে আবার মিলিত হতে চাইলে সময় নষ্ট কর না, সময় বেশী নেই।’ এ আহ্বান আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্র থেকে উর্দু, হিন্দি ও পশতু ভাষায় প্রচার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য নিশ্চিত করতে আকাশবাণীর এ ভূমিকা তখন প্রশংসিত হয়। অস্ত্রহাতে সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলেও আকাশবাণী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে তরঙ্গযুদ্ধ চালিয়েছে, তার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ আকাশবাণীকে Friends of Liberaton War সম্মাননা প্রদান করে। [জালাল আহমেদ]
তথ্যসূত্র: Harun-or-Rashid, British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971, Contemporary South Asia, 1995, Journal Oxford Ltd., 4(2), pp. 139-149; মুনতাসীর মামুন ও হাসিনা আহমেদ, গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পঞ্চদশ খণ্ড, অনন্যা, ঢাকা, ২০১৩

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!