You dont have javascript enabled! Please enable it!

আক্কেলপুর উপজেলা

আক্কেলপুর উপজেলা (জয়পুরহাট) ব্রিটিশ আমল থেকেই স্বদেশী চেতনার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত। স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্ররা স্থানীয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট তৈরিতে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে এখান থেকে আওয়ামী লীগ প্রার্থী এ কে মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী এমএনএ নির্বাচিত হন। পাকিস্তান সরকার জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে আক্কেলপুরে মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করেন। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ ঐদিন রেডিওতে প্রচার করা না হলে বিবিসি-র সন্ধ্যার খবরের মাধ্যমে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশবাসীর মতাে এই এলাকাবাসীও অবগত হন। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়লে মাড়ােয়ারী ব্যবসায়ী মােহনলাল আগরওয়ালার গদিঘরে এ কে মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী এমএনএ-র সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।
সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পরই এ কে মুজিবর রহমান আক্কেলপুরী এমএনএ-এর তত্ত্বাবধানে কলেজবিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী এবং বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিবর্গের সমন্বয়ে আক্কেলপুর এফ ইউ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণের প্রথমদিকে অবসরপ্রাপ্ত ইপিআর সদস্য ফারাজউদ্দীন (হাস্তাবসন্তপুর)-এর নেতৃত্বে লাঠি-সোটা নিয়ে কুচকাওয়াজ, পিটি-প্যারেড, শারীরিক ব্যায়াম ইত্যাদি চলতে থাকে। এরপর কাজী একরামুল হকের এয়ার গান, খয়ের চৌধুরীর একনলা বন্দুক এবং আব্দুল হাই, আব্দুল গণি ও অগ্রণী ব্যাংকের একজন গার্ডের অস্ত্র ব্যবহার করে আগ্নেয়াস্ত্র প্রশিক্ষণ শুরু হয়। একই সময় উপজেলার চকবিজলি-কেশবপুর ঈদগাহ মাঠে মাে. নবীবুর রহমান (পরবর্তীতে মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার) পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের কিছু লােকজনকে সংগঠিত করে লাঠিসোঁটা দিয়ে পিটি-প্যারেড ও শারীরিক কসরত শুরু করেন। পরে তারা ইউপি সদস্য ঈমান আলীর পুত্রের এবং পুলিশ কনস্টেবল আব্দুল করিম দেওয়ানের বন্দুক ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ কার্য চালিয়ে যান। শীঘ্রই এটি আক্কেলপুর এফ ইউ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠের প্রশিক্ষণার্থীদের সঙ্গে একীভূত হয়। প্রশিক্ষণের এক পর্যায়ে আক্কেলপুর সদরের ব্যবসায়ী ফুলজী বাবুর পাটের গুদামে স্থাপিত অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ির ৫টি রাইফেল নিয়ে এসে সেগুলাে দ্বারা প্রশিক্ষণ চালানাে হয় এবং প্রশিক্ষণ শেষে তা প্রতিদিন ফেরত দিয়ে আসা হতাে। ১৮ই এপ্রিল পাঁচবিবির প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে প্রশিক্ষণরত ১১ জন মুক্তিযােদ্ধা উচ্চ পর্যায়ের প্রশিক্ষণের জন্য ভারত যান। পরবর্তীতে আরাে অনেকেই ভারতের পানিঘাটা (শিলিগুড়ি), পাতিরাম, মালঞ্চা, কুরমাইল, কামারপাড়া, তিয়র, বালুরঘাট ও ডাঙ্গা বিজয়শ্রী কাম্পে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জুন মাসের শেষদিকে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, জয়পুরহাট কলেজের ছাত্রী রাবেয়া বেগম বেলী (পিতা আবদুল বারী সরদার, হস্তাবসন্তপুর) সহ কয়েকজন উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য ভারত যান এবং ভারতে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আক্কেলপুর উপজেলায় বহুসংখ্যক মানুষ মুপ্সিক্তযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে ২০ জন মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপ কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা হলেন- মাে. নবীবুর রহমান, বিএ (পিতা ইব্রাহিম আলী, চকবিজলী), মাে. আজাদ আসাদুজ্জামান (পিতা পিয়ার উদ্দিন, চিয়ারী গ্রাম, কাশিড়া, রায়কালী), মাে. আব্দুর রজ্জাক (পিতা নিজাম উদ্দিন, মালিগ্রাম, রায়কালী), কাজী ফরমুজুল হক পান্না (পিতা কাজী এরফানুল হক, আক্কেলপুর সদর), জাহাঙ্গীর আলম (পিতা আ. রহিম মন্ডল, বেগুনবাড়ী, কানুপুর, রুকিন্দীপুর), মাে. আ. রাজ্জাক দেওয়ান (পিতা হােসেন আলী দেওয়ান, তেমাড়িয়া, কাশিড়া, গােপিনাথপুর), সেকেন্দার আলী (পিতা ঈমান আলী সরদার, মােহাম্মদপুর, কাশিড়া, সােনামুখী), মােশারফ হােসেন (পিতা আলতাফ হােসেন, কোলা গণিপুর, জাফরপুর, সােনামুখী), মইনুর কবির (পিতা ওয়ায়েজ আলী, নওজোড়, তিলকপুর), সােলায়মান আলী (পিতা শুকুর আলী, ভাটকুড়ি, তিলকপুর), আশরাফ আলী (পিতা মােজাহার আলী, তেঁচুরিয়া, মােহনপুর, তিলকপুর), হারেজ উদ্দিন (পিতা ইলিম উদ্দিন, হরিসাদী, বিনাহালী, রায়কালী), আব্দুল জলিল (পিতা ছবেদ তরফদার, কেশবপুর), খন্দকার দেলােয়ার (পিতা হােসেন আলী দেওয়ান, বালুকাপাড়া, পুন্ডুরিয়া, রায়কালী), তুমিজ উদ্দিন (পিতা মফিজ উদ্দিন, শ্যামপুর, তিলকপুর)। এছাড়া ৫ জন গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন। তারা হলেন- নজরুল ইসলাম (পিতা আলাউদ্দীন, কোলা, সােনামুখী), আফজাল হােসেন, (পিতা করিম মন্ডল, গণিপুর, সােনামুখী), নজির উদ্দিন, (পিতা ফয়েজ উদ্দিন, বামনীগ্রাম, তিলকপুর), আজিজুর রহমান (পিতা আফতাব উদ্দিন, চক ইসলামপুর, তিলকপুর), আব্দুল আজিজ (পিতা যদু মন্ডল, নূরনগর, তিলকপুর)।
সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠনের পর আক্কেলপুর রেল স্টেশন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি অফিস ও বাজার এলাকায় পাহারা বসানাে হয়। অন্যদিকে, আক্কেলপুরের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া রেললাইনের দুপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষ সান্তাহারের কাছাকাছি পর্যন্ত রেললাইনের বেশ কিছু অংশ উপড়ে ফেলে পাকসেনাদের প্রতিরােধের চেষ্টা করে। এছাড়া এলাকার সাধারণ মানুষ পূর্বদিক থেকে আক্কেলপুর সদরে আসার প্রবেশ পথ নবাবগঞ্জ ঘাটের বাঁশ ও কাঠের তৈরি সাঁকো ধ্বংস করে দেয়। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা হলহলিয়া রেলওয়ে ব্রিজের দক্ষিণ অংশ ধ্বংস করে পাকবাহিনীর যােগাযােগ ব্যাহত করার চেষ্টা করেন।
২২শে এপ্রিল সান্তাহার থেকে ট্রেনযােগে পাকবাহিনী আক্কেলপুরে অনুপ্রবেশ করে। স্থানীয় শান্তি কমিটি এবং রাজাকারদের সহায়তায় তারা আক্কেলপুর উপজেলার সদরে আক্কেলপুর জিন্না জুনিয়র ওল্ড স্কীম মাদ্রাসা, আক্কেলপুর রেল স্টেশনের পাশে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী দুর্গা দত্ত আগরওয়ালার পাকা ভবন, রেল স্টেশনের ওয়েটিং রুম এবং আক্কেলপুর উপজেলা পরিষদের পূর্বদিকে তুলশীগঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে নবাবগঞ্জ ঘাটে ক্যাম্প স্থাপন করে।
আক্কেলপুর রেল স্টেশন থেকে সাড়ে তিন কিলােমিটার দক্ষিণে হলহলিয়া রেলওয়ে ব্রিজের দুই পাশে তারা চৌকি স্থাপন করে। এছাড়া জাফরপুর, জামালগঞ্জ ও তিলকপুর রেল স্টেশনেও তাদের তৎপরতা ছিল। এখানকার সার্বক্ষণিক দায়িত্বে ছিল পাকবাহিনীর ক্যাপ্টেন হারুন। জয়পুরহাট মহকুমার দায়িত্বে থাকা মেজর আজাল বেগ প্রায়ই এখানে এসে অবস্থান করে দিকনির্দেশনা দিত। পাকবাহিনীর অনুপ্রবেশের পরপরই মুসলিম লীগ নেতা মকবুল হােসেন কবিরাজ (পিতা হাকিম কবিরাজ)-কে সভাপতি ও সােনামুখী ইউপি চেয়ারম্যান মতিউর রহমান (পিতা মকবুল মন্ডল)-কে সেক্রেটারি এবং ইয়াকুব আলী কবিরাজ (পিতা আলী হায়দার কবিরাজ)-কে কোষাধ্যক্ষ করে আক্কেলপুর থানা শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটির অন্য সদস্যরা হলাে- আবুল কাশেম, ডা. ছােলাইমান আলী, আবদুল গণি কবিরাজ, ফরেজ উদ্দিন, আফজাল হােসেন, নূরবক্ত সরদার, মাে. মমতাজ উদ্দীন, নূর মােহাম্মদ গােল্লা, খলিলুর রহমান, লাল বিহারী প্রমুখ। আমজাদ হােসেন (পিতা ভুরুঙ্গা মন্ডল, হাস্তাবসন্তপুর)-কে কমান্ডার করে আক্কেলপুর থানা রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এ থানার উল্লেখযােগ্য রাজাকাররা হলাে- মােহাম্মদ আলী, মঞ্জুর হােসেন, ওসমান কাজী, মজিবর মাস্টার, গােলাম মােস্তফা, আবুল হােসেন, সজন সরদার, জবির মন্ডল, মতিউর রহমান, আমজাদ মন্ডল, ছলিম মন্ডল, আফজাল মন্ডল, ভােলা মন্ডল, সােলেমান মন্ডল, শুক্টা মৃধা প্রমুখ। এছাড়া রুকিন্দীপুর ইউনিয়নে নূর বক্ত সরদার (পিতা ওসমান সরদার, রােয়াইর)-কে সভাপতি ও আজিমুদ্দিন (পিতা মফেজ সরদার, রােয়াইর)-কে সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি এবং নাসির উদ্দীন বানা (পিতা কাঞ্চা ফকির, রােয়াইর)-কে কমান্ডার করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। সােনামুখী ইউনিয়নে মতিউর রহমান (পিতা মজিবর রহমান, মানিকপাড়া)-কে সভাপতি ও আবুল হােসেন (পিতা আহম্মেদ আলী, চক্রপাড়া)-কে সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি এবং খাজামুদ্দিন (পিতা অজ মন্ডল, চকরঘুনাথপুর)-কে কমান্ডার করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। গােপীনাথপুর ইউনিয়নে নজির আহমেদ (পিতা অলি মন্ডল, গােপীনাথপুর)-কে সভাপতি ও গহের মন্ডল (পিতা ছায়ের আলী মন্ডল, গােপীনাথপুর)-কে সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি এবং মােকছেদ আলী (পিতা জাফর আকন্দ, চকশান্তি)-কে কমান্ডার করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। তিলকপুর ইউনিয়নে ফিরােজ উদ্দীন খান (পিতা ইমান উদ্দীন, নূরনগর)-কে সভাপতি ও লাল বিহারী (পিতা মুমনি বিহারী, নূরনগর)-কে সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি এবং খলিলুর রহমান (পিতা সাহেব আলী মন্ডল, রায়নগর)-কে কমান্ডার করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রায়কালী ইউনিয়নে বছিরউদ্দীন হাজী (পিতা বয় প্রামাণিক, দেবী শাউল)-কে সভাপতি ও আবুল তালুকদার (পিতা বিরাজ তালুকদার, গুডুম্বা)-কে সেক্রেটারি করে শান্তি কমিটি এবং খলিলুর রহমান (পিতা রওশন খন্দকার, গুডুম্বা)-কে কমান্ডার করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। এরা সকলেই মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং বিহারী নেতা।
২২শে এপ্রিল সান্তাহার থেকে পাকবাহিনী ট্রেনযােগে আক্কেলপুরে আসার সময় গুলিবর্ষণ ও গােলা নিক্ষেপ করে রেললাইনের দুপাশের ভদ্রখালীসহ কয়েকটি গ্রামে অগ্নিসংযােগ করে। এসময় পাকবাহিনীর গুলিতে খাদইল গ্রামের আব্দুল মজিদ শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা দুর্গাদত্ত আগরওয়ালার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ অধিকাংশ মাড়ােয়ারি ও হিন্দুদের দোকানপাট-বাড়িঘর লুটপাট, অগ্নিসংযােগ ও দখল করে নেয়। এছাড়া পৌর সদরের হাস্তাবসন্তপুর, দেওকরণ, রেলস্টেশন, বিহারপুর, পশ্চিম আমুট্ট, বিলাসবাড়ি ও মানিকপাড়া গ্রামে নির্যাতন, লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ করে। গােপীনাথপুর ইউনিয়নের আবাদপুর, কাশিড়া, হােসেন নগর, রুকিন্দীপুর ইউনিয়নের বেগুনবাড়ি, ইসমাইলপুর, সােনামুখী ইউনিয়নের গণিপুর, হলহলিয়া, অনন্তপুর, চক রঘুনা, তিলকপুর ইউনিয়নের নূরনগর, কয়া শােবলা এবং রায়কালী ইউনিয়নের গুডুম্বা, চিয়ারিগ্রাম, বালুকাপাড়া, আমবাড়ি, সুজালদীঘি গ্রামে নির্যাতন, অগ্নিসংযােগ ও লুণ্ঠন করে। এ-সময় আক্কেলপুর সদরের মানিকপাড়া গ্রামের খুকী বালা (পিতা ঝড় মাঝি) এবং শান্তিবালা (পিতা গােপীনাথ চন্দ্র) সহ বেশ কিছু নারী ধর্ষণের শিকার হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে আক্কেলপুর স্টেশন বিশ্রামাগার ক্যাম্পও ছিল পাকবাহিনীর নির্যাতন কেন্দ্র। তবে আক্কেলপুর জিন্না জুনিয়র ওল্ড স্কীম মাদ্রাসা নির্যাতনকেন্দ্র ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এখানের ক্যাম্পে থাকা পাকবাহিনী ও তাদের দোসররা বিশেষ করে জয়পুরহাটের আব্দুল আলিম (যুদ্ধাপরাধের দায়ে গ্রেপ্তার হয়ে বিচারাধীন অবস্থায় ৩০শে আগস্ট ২০১৪ তারিখে মৃত্যু) ও আক্কেলপুর উপজেলার স্থানীয় দালালরা সেখানে বিভিন্ন অপারেশনের নীল নকশা করত। নির্যাতন শেষে অনেককে হত্যা করে মাদ্রাসা মাঠের একটি কূপে ফেলে দিত।
উপজেলা সদর থেকে ১ কিলােমিটার উত্তরে আমুট্ট মৌজায় আক্কেলপুর মহিলা কলেজের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে বেলাই মাঠ বধ্যভূমি ও গণকবর- অবস্থিত। এখানে শতাধিক। মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষের গণকবর রয়েছে। এ বধ্যভূমি ও গণকবরে স্থাপিত শ্বেতপাথরে গােপীনাথপুর গ্রামের আবের জোয়ার্দার ও মকলেছ জোয়ার্দার, বানদীঘি গ্রামের নবীর উদ্দীন, মাটিহাঁস গ্রামের নজের প্রামাণিক, নছির প্রামাণিক, আছের প্রামাণিক, ডা. বুলচান, তােফাজ্জল হােসেন (তােফা)সহ আরাে ৩ জন মুক্তিযােদ্ধা (পরিচয় অজ্ঞাত) ও ৬ জন গাড়ােয়ানের নাম লিপিবদ্ধ আছে। উপজেলার প্রধান ও বৃহত্তম ক্যাম্প আক্কেলপুর সিনিয়র। মাদ্রাসার কয়েকশ গজ উত্তর-পশ্চিম দিকে জয়পুরহাটবদলগাছি সড়কের দক্ষিণ পাশে (পশ্চিম আমুট্ট গ্রাম) আমুট গণকবর অবস্থিত। এখানে মুক্তিযােদ্ধাসহ অনেককে হত্যা করে মাটিচাপা দেয়া হয়। এছাড়া পশ্চিম আমুট্ট গণকবরের মাত্র কয়েকশ গজ উত্তর পাশে তরুণ। মুক্তিযােদ্ধা গােলাম মােহাম্মদ পাইকার ওরফে খােকন-এর কবর এবং কানুপুরে দুজন মুক্তিযােদ্ধার কবর রয়েছে। আক্কেলপুর উপজেলায় পাকবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের অনেকগুলাে যুদ্ধের ঘটনা ঘটে, যার মধ্যে সুজালদীঘিঅর্জুনগাড়ী মােড় যুদ্ধ এবং কাশিড়া যুদ্ধ” উল্লেখযােগ্য। ১৫ই জুন মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার কাজী ফরমুজুল হক পান্না এবং কমান্ডার জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা জামালগঞ্জ রেল স্টেশনে পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন। ৭ই অক্টোবর কমান্ডার নবীবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার বটতলীতে অবস্থিত পাকসেনা ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এ অভিযানে অস্ত্রসহ দুই রাজাকার মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ৭ই অক্টোবর নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার ঐতিহাসিক পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন আক্কেলপুরের কমান্ডার কাজী ফরমুজুল হক পান্না। যুদ্ধে এ কে এম ফজলুল হক (পিতা হাজী আব্দুর রহিম, আক্কেলপুর) সহ ৫ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। ২২শে অক্টোবর কমান্ডার মইনূর কবীর তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে আদমদীঘি আক্রমণে অংশ নেন। ২৫শে অক্টোবর কমান্ডার সােলায়মান আলী ও সহযােদ্ধারা আক্কেলপুরের তিলকপুর রেলস্টেশন অপারেশন করেন। ২৭শে অক্টোবর কমান্ডার সেকেন্দার আলী ও মােশারফ হােসেন সহযােদ্ধাদের নিয়ে থানা সদর হতে সাড়ে তিন কিলােমিটার দক্ষিণে তুলশীগঙ্গা নদীর ওপরে হলহলিয়া ব্রিজে অপারেশন করেন। ২রা নভেম্বর সুজালদীঘি-অর্জুনগাড়ী মােড় সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। রায়কালী ও তার আশপাশের গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্ত অবস্থান রয়েছে এ সংবাদ পেয়ে আদমদীঘি থেকে গ্রামীণ রাস্তা ধরে পাকবাহিনী রায়কালীর দিকে এগােতে থাকে। এ খবর মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট পৌছলে কমান্ডার নবীবুর রহমান, ফরহাদ হােসেন, আব্দুর রাজ্জাক, খন্দকার দেলােয়ার হােসেন, আজাদ আসাদুজ্জামান এবং তুমিজ উদ্দীনের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা সুজালদীঘি-অর্জুনগাড়ী মােড়ে পাকবাহিনীকে প্রতিহত করেন এবং পাকসেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ-যুদ্ধে ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্যদিকে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন।
১২ই নভেম্বর কমান্ডার নবীবুর রহমান, আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান, আশরাফ আলী ও আব্দুল জলিলের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা তুলশীগঙ্গা নদীর তীরে নবাবগঞ্জ ঘাটে পাকসেনা ক্যাম্প অপারেশন করেন। অপারেশনে দুজন পাকসেনা নিহত হয় এবং ৫টি রাইফেল মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। একইদিন কমান্ডার কাজী ফরমুজুল হক পান্না ও জাহাঙ্গীর হােসেন তাদের অনুগামী মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে নওগাঁর বদলগাছি থানা আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। ১৭ই নভেম্বর দুপচাচিয়ার বেলাহালি ব্রিজ ক্যাম্প আক্রমণে আক্কেলপুরের কমান্ডার হারেজউদ্দীন অংশগ্রহণ করেন। ১লা ডিসেম্বর কমান্ডার মইনূর কবীর দুপচাচিয়ার কালাইকুড়িতে দালাল আব্দুল মজিদের বাড়িতে অবস্থিত পাকবাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করেন।
১৩ই ডিসেম্বর ভাের পাঁচটার দিকে কমান্ডার মাে. নবীবুর রহমান, মাে. আব্দুর রাজ্জাক, মাে. আব্দুল জলিল, মাে. আফজাল হােসেন, মাে. মােশারফ হােসেন ও মাে. নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা পূর্ব-দক্ষিণ দিক থেকে এবং কাজী ফরমুজুল হক পান্না, জাহাঙ্গীর আলমসহ বদলগাছির বেশ কজন গ্রুপ কমান্ডারের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা পশ্চিম দিক থেকে আক্কেলপুরে প্রবেশ করেন এবং আক্কেলপুর থানা আক্রমণ করেন। থানা আক্রমণে ২ জন পাকসেনা ও ৭ জন রাজাকার নিহত হয় এবং আক্কেলপুর থানা হানাদারমুক্ত হয়। এ-যুদ্ধে অনেকগুলাে অস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়।
আক্কেলপুর থানা ১৩ই ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হলেও কাশিড়ার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৪ই ডিসেম্বর সকালে। জয়পুরহাটের দিক থেকে পলায়নপর পাকসেনারা ক্ষেতলাল-আক্কেলপুরের মধ্য দিয়ে আদমদীঘির দিকে যাবার পথে গুলি করে সাধারণ মানুষজনদের হত্যার সংবাদ মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট পৌছলে কমান্ডার নবীবুর রহমান, আব্দুল জলিল, আব্দুর রাজ্জাক দেওয়ান, আফজাল হােসেন, নজরুল ইসলাম, মােশারফ হােসেন ও আজাদ আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা তাদের ধাওয়া করে। কাশিড়া গ্রামের পূর্ব পাশের ফসলী মাঠে উভয়পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। এ-যুদ্ধে ৭ জন পাকসেনা নিহত এবং ৫টি অস্ত্র উদ্ধার হয়। যুদ্ধে আক্কেলপুরের চিয়ারি গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা আইনউদ্দিন শহীদ হন এবং অপর তিনজন মুক্তিযােদ্ধা যথা রামশালা গ্রামের আবুল আজাদ ও নূরুল ইসলাম ও চিয়ারি গ্রামের সেকেন্দার আলী আহত হন।
১৪ই ডিসেম্বর আদমদীঘি থানামুক্ত করার অভিযানে কমান্ডার হারেজউদ্দিন অংশ নেন। ১৫ই ডিসেম্বর সান্তাহার প্রবেশ পথে পাইকপাড়া রেল গেইটের সম্মুখ যুদ্ধে কমান্ডার নবীবুর রহমান অংশ নেন। এ-যুদ্ধে কমান্ডার নবীবুর রহমানের সহযােদ্ধা আব্দুস ছাত্তার (নওগাঁ জেলা) শহীদ হন। আক্কেলপুর উপজেলার মুক্তিযােদ্ধাগণ নিজ এলাকা ছাড়াও দেশের অন্যান্য জেলা যেমন চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নওগাঁ, গাইবান্ধা, বগুড়াসহ বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১৩ই ডিসেম্বর আক্কেলপুর থানা হানাদারমুক্ত হয়।
আক্কেলপুরে শহীদ মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে যাদের নাম জানা যায়, তাঁরা হলেন- আইনউদ্দিন, (পিতা ছহির উদ্দিন, চিয়ারিগ্রাম, রায়কালি; ১৪ই ডিসেম্বর কাশিড়ার যুদ্ধে শহীদ), মােখলেছার রহমান (পিতা শফির উদ্দীন, শিয়ালা, রায়কালি; আদমদিঘীর কোলা যুদ্ধে শহীদ), এ কে এম ফজলুল হক (পিতা হাজী আব্দুর রহিম, আক্কেলপুর সদর; ৭ই অক্টোবর পাহাড়পুর যুদ্ধে শহীদ), আব্দুল বারী সরদার (পিতা সজাব উদ্দিন সরদার, শান্তা; হিলির যুদ্ধে শহীদ) ও আব্দুল জব্বার (পিতা গমিরউদ্দীন মন্ডল, কাঁটালবাড়ি, সােনামুখী; হিলির যুদ্ধে শহীদ)।
শহীদ ছমির মন্ডল (বাম রাজনীতিক) স্মরণে আক্কেলপুর রেলস্টেশনের উত্তর পার্শ্বে নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ ছমির মন্ডল স্মৃতি পার্ক। মুক্তিযােদ্ধা এ কে এম ফজলুল হক স্মরণে আক্কেলপুর উপজেলা সদরের পূর্ব-পশ্চিম দিকের সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ এ কে এম ফজলুল হক সড়ক। গােপীনাথপুর ইউনিয়নের ভানুকান্দা জুনিয়র হাইস্কুল হতে দক্ষিণ দিকে কাশিড়া বাজার হয়ে রায়কালী ইউনিয়নের চন্দনদীঘি মােড় পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ মকবুল হােসেন সড়ক। আক্কেলপুর উপজেলা সদরে নির্মাণ করা হয়েছে মুক্তিযােদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন। চন্দনদীঘি বাজার হয়ে সনাতনপুর মােড় পর্যন্ত সড়কের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ আইনউদ্দীন সড়ক। বেলাই মাঠ বধ্যভূমি ও গণকবরের ওপর স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। আক্কেলপুরের রাজাকারদের হাতে নিহত কনিষ্ঠ মুক্তিযােদ্ধা গােলাম মােহাম্মদ পাইকার ওরফে খােকন (পিতা মােজাম পাইকার, বগুড়া, যিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৪ই জুলাই শহীদ হন)-এর স্মৃতি রক্ষার্থে বগুড়া শহরের সাতমাথার অদূরে প্রধান ডাকঘরের পূর্ব পাশে খােকন পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। রাবেয়া খাতুন বেলীর স্মৃতি রক্ষার্থে চকেশায় শহীদ রাবেয়া নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হলেও পরবর্তীতে সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ব্যক্তির নামে প্রতিষ্ঠানের নামকরণের জন্য প্রয়ােজনীয় অর্থদানের ক্ষেত্রে তা সম্ভব না হওয়ায় বর্তমানে বিদ্যালয়টি চালু থাকলেও রাবেয়া নামটি বাদ পড়ে যায়। [মাে. আব্দুল মজিদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!