আখাউড়া, আজমপুর, রামপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া যুদ্ধ
আখাউড়া, আজমপুর, রামপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া যুদ্ধ (ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর) সংঘটিত হয় ৩০শে নভেম্বর থেকে ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতে বহু পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ এবং আহত হন। এ-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরসহ আশপাশের এলাকা হানাদারমুক্ত হয়।
৩০শে নভেম্বর থেকে আখাউড়া সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। এস’ ফোর্স-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শফিউল্লাহর তত্ত্বাবধানে এ লড়াই চলতে থাকে। এসময় তার অধীনে ছিল প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন পদাতিক সৈন্য। পুরাে দুই ব্যাটালিয়নই যাবতীয় সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত। পাকিস্তানি বাহিনীও আর্টিলারি, মর্টার, মেশিনগান ইত্যাদিসহ ছােট-বড় সব অস্ত্রই ব্যবহার করে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
যুদ্ধের মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯শে নভেম্বর দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য নিয়ে মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী আখাউড়ার উত্তর দিকে মেরাসানী, সিঙ্গারবিল, আজমপুর, রাজাপুর প্রভৃতি এলাকা আক্রমরেণর প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। এস’ ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল শফিউল্লাহ তাঁর দ্বিতীয় ও একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সেক্টর ট্রপস-এর দুটি কোম্পানি আখাউড়া, আজমপুর, সিঙ্গারবিল, মেরাসানী, মুকুন্দপুর প্রভৃতি এলাকায় নিয়ােগ করেন। পকিল্পনা অনুযায়ী একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্ট মেজর নাসিমের নেতৃত্বে সিলেট থেকে অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি বাহিনীর গতিপথ রুদ্ধ করার জন্য অবস্থান নেয়। ৩০শে নভেম্বরের মধ্যে মেজর নাসিম মুকুন্দপুরসহ অন্যান্য এলাকা নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলেন। সেক্টর ট্রপস-এর দুটি কোম্পানি মেজর মতিনের কমান্ডে আগরতলা বিমান বন্দরের উত্তর-পশ্চিমাংশে পরিখা খনন করে অবস্থান নেয়। ৩০শে নভেম্বর রাত একটায় মুক্তিবাহিনী দুদিক থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের প্রথম পর্যায়েই সিঙ্গারবিল রেলস্টেশন এবং সিঙ্গারবিল ঘটি এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে এখানে মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। পর্যায়ক্রমে মেরাসানী, আজমপুর, রাজাপুর প্রভৃতি এলাকা মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনী একটার পর একটা যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে থাকে।
৩০শে নভেম্বর ও ১লা ডিসেম্বর মেরাসানী, আজমপুর, রাজাপুর ও সিঙ্গারবিল এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ২০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং একজন বন্দি হয়। হানাদার বাহিনীর প্রচুর পরিমাণ অস্ত্র, রেশন, পােশক-পরিচ্ছদ এবং ডিফেন্স স্টোর (প্রতিরক্ষা সীমানা) মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। হানাদার বাহিনীর হাতে সেদিন ইয়াছিন খাঁ নামে মুক্তিবাহিনীর একজন সিপাহি শহীদ হন। সিঙ্গারবিলে তাঁকে সমাহিত করা হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সিপাহি আবু জাফর, সিপাহি হুমায়ুন কবির, সিপাহি আবদুল লতিফ, হাবিলদার আকতার হােসেন, হাবিলদার মােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী ও হাবিলদার নবীউল্লাহসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। ১লা ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর আজমপুর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। আক্রমণের প্রথম পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী কিছুটা পিছু হটতে বাধ্য হয়। ১লা ও ২রা ডিসেম্বর রাতে এখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। আর্টিলারির সাহায্যে মারাত্মক আক্রমণ চালিয়ে আজমপুর ও রাজাপুর এলাকা শত্রুবাহিনী পুনর্দখল করে নেয়। প্রচুর ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করে মুক্তিবাহিনী সিঙ্গারবিল ঘাটি এলাকায় জমায়েত হয়। এ-যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নায়েক সুবেদার আশরাফ আলী খান শত্রুর হাতে শাহাদত বরণ করেন। এছাড়া সিপাহি আবদুল আওয়াল, হাবিলদার মাজু মিয়া, নায়েক নাসিরুজ্জামান, নায়েক আবদুস সালাম, সিপাহি মিজানুর রহমান প্রমুখ আহত হন।
৩রা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী পুনরায় পূর্ণোদ্যমে পাকিস্তানিদের ওপর আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিন ও রাত প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। উভয় পক্ষ থেকেই অবিরাম গােলাবর্ষণ চলতে থাকে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। আখাউড়া স্টেশন এলাকায় সুদৃঢ় বাংকার সৃষ্টি করে সেখান থেকে তারা মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরােধ করার চেষ্টা চালায়। এযুদ্ধে ১১ জন শত্রুসৈনিক নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর দুজন সিপাই ও একজন নায়েক সুবেদার শহীদ হন। এ-সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সিঙ্গারবিল, আজমপুর, রাজাপুর, মুকুন্দপুরসহ বিভিন্ন এলাকা মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। এসব এলাকায় সুদৃঢ় ঘাঁটি স্থাপন করে মুক্তিবাহিনী আখাউড়া রেলস্টেশন এলাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এস’ ফোর্স-এর প্রায় দুই ব্রিগেড সৈন্য এসব এলাকায় অবস্থান করছিল।
৪ঠা ডিসেম্বর আখাউড়া যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় মিত্রবাহিনী- মিলিত হয়। যৌথবাহিনী অগ্রসর হয়ে আখাউড়া অবরােধ করে। এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষই প্রচুর পরিমাণ কামান ও মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করে। আক্রমণের মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন মতিন এবং লে. সাদেকের নেতৃত্বে ৩ নং সেক্টরের দুই কোম্পানি সৈনিক পূর্ব থেকেই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থায় নিয়ােজিত ছিল। মারাত্মক প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হয়েও তারা তাদের অবস্থান থেকে বিন্দুমাত্র নড়েননি। প্রাণপণ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। ৪ঠা ও৫ই ডিসেম্বর দিনরাত অবিরাম যুদ্ধের পর আখাউড়া এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এ-যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর দুই শতাধিক সৈনিক হতাহত হয়। বাকিরা পালিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আশ্রয় নেয়। মুক্তিবাহিনীর লে. বদিউজ্জামান, সিপাহি রুহুল আমিন, সিপাহি সিদ্দিকুর রহমান, সিপাহি আমির হােসেন, সিপাহি শাহাবউদ্দিন, সিপাহি মুস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ এ-যুদ্ধে শহীদ হন। তাঁদের মরদেহ আখাউড়া এবং আজমপুরে সমাহিত করা হয়। এ-যুদ্ধে যারা আহত হন, তাঁরা হলেন- সুবেদার চান মিয়া, হাবিলদার কামরুজ্জামান, কোম্পানি হাবিলদার মেজর নূরুজ্জামান সহ ১৯ জন। এ লড়াইয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী অপরিসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। শত্রুবাহিনীর ছােটবড় হাতিয়ারসহ ৩২টি রাইফেল মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আখাউড়া যুদ্ধ ছিল খুবই ভয়াবহ। এ-যুদ্ধে উভয় পক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আখাউড়া রেলস্টেশন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী খুবই সুদৃঢ় ঘাঁটি স্থাপন করে অবস্থান করছিল। ফলে এখানে ব্যাপক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানকার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী অসীম সাহসিকতা এবং বীরত্বের পরিচয় দেয়। আখাউড়া থেকে পশ্চাদপসরণের পর পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আর কোথাও ভালােভাবে অবস্থান নিতে পারেনি। মুক্তিবাহিনী একটার পর একটা এলাকা মুক্ত করতে থাকে। এরই মধ্যে ৬ই ডিসেম্বর ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সর্বাত্মক সহযােগিতায় এগিয়ে আসে। ভারতীয় সেনাবাহিনীও মুক্তিবাহিনীর পাশে প্রকাশ্যে মিত্রবাহিনীর ভূমিকায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী সমন্বয়ে গঠিত হয় যৌথবাহিনী। চূড়ান্ত পর্যায়ে আখাউড়া যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ‘এস’ ফোর্স-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল কেএম সফিউল্লাহ। আখাউড়া মুক্ত হবার পর রেলস্টেশন এলাকায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। আখাউড়া দখলের পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের পরিকল্পনা নেয়া হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণ দিক থেকে শহরের দিকে অগ্রসর হয়। অন্য একটি কোম্পানি উত্তর দিক থেকে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক দিয়ে অগ্রসর হয়। মিত্রবাহিনীর ৫৭তম মাউন্টেন ডিভিশন আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেললাইন এবং আখাউড়া-উজানিসার সড়ক ধরে অগ্রসর হতে থাকে। এস’ ফোর্স-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল সফিউল্লাহ মাধবপুর-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক দিয়ে অগ্রসর হন। মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি চান্দুরার উত্তর-পূর্বাংশে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পাশে অবস্থান নেয়। সিলেট থেকে পলায়নরত পাকিস্তানিরা অগ্রসর হলে তাদের বাধা দেয়াই ছিল এ অবস্থানের মূল লক্ষ্য। এস’ ফোর্স-এর অন্য একটি কোম্পানি চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা শত্রুমুক্ত করার দায়িত্ব পালন করে। ব্যাটালিয়নের অবশিষ্ট সৈন্য হরষপুর দিয়ে চান্দুরার দিকে অগ্রসর হয়। হরষপুরের পাইকপাড়া পর্যন্ত পৌঁছার পর মেজর নাসিম এ দলটিকে চান্দুরা হয়ে শাহবাজপুর, সরাইল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেন। দেশের অভ্যন্তরে পূর্ব থেকে অবস্থানরত বিভিন্ন এলাকার গেরিলা ও গণবাহিনীর সদস্যরাও তাঁদের সঙ্গে যােগ দেন। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার্স বাহিনী (অর্ডার গ্রুপ) সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক দিয়ে শাহবাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। হেডকোয়ার্টার্স গ্রুপে তখন ‘এস ফোর্স কমান্ডার লে. কর্নেল কে এম সফিউল্লাহ এবং একাদশ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার মেজর নাসিমসহ মাত্র ৮ জন সৈনিক ছিলেন। এসময় চান্দুরা-শাহবাজপুরের মাঝামাঝি রামপুরের কাছে অপ্রত্যাশিত একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত আক্রমণে পাকিস্তানিরা ক্রমশ পিছু হটতে থাকে। যদিও মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়া তাঁর বাহিনী নিয়ে ৬ই ডিসেম্বর চান্দুরা-মাধবপুরের মাঝামাঝি সড়কে অবস্থান করছিলেন, তথাপি পাকিস্তানিদের একটি গাড়ি সিলেট থেকে মেজর সুবেদ আলী ভূঁইয়ার বাহিনীকে অতিক্রম করে চলে আসে। এ গাড়িটির খবর মেজর ভূঁইয়া কিংবা লে. কর্নেল সফিউল্লাহ কেউই জানতেন না। পাকিস্তানিদের গাড়িকে লে. কর্নেল সফিউল্লাহ নিজেদের গাড়ি মনে করে থামান। গাড়ি থামলে দেখা যায়, গাড়িতে পাকিস্তানি সৈনিক। লে. কর্নেল সফিউল্লাহ সবাইকে সারেন্ডার করতে বললে কেউ-কেউ হাত ওঠায়। অন্যরা আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। গাড়ির সামনে বসা পাঠান সুবেদার হঠাৎ লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সফিউল্লাকে জাপটে ধরে। এই সুযােগে পাকিস্তানি অন্য সৈন্যরাও দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে গুলি চালানাে শুরু করে। মুক্তিবাহিনীর উপস্থিত ৮ জন সৈনিকও সঙ্গে-সঙ্গে প্রতিউত্তর দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে বেঁধে যায় তুমুল যুদ্ধ। এ-সময় পাঠান সুবেদারের সঙ্গে লে. কর্নেল সফিউল্লাহর মল্লযুদ্ধ শুরু হয়। সফিউল্লাহর দেহরক্ষী তাঁকে মুক্ত করার চেষ্টা করেও বারবার ব্যর্থ হন। শত্রুকে গুলি করার সুযােগ পাচ্ছিলেন না। এরই মধ্যে শত্রুর গুলিতে আহত হয়ে সফিউল্লাহর দেহরক্ষী মাটিতে পড়ে যান। সফিউল্লাহর সঙ্গে পাঠান সুবেদারের মুল্লযুদ্ধ চলতেই থাকে। কোমর থেকে পিস্তল বের করার সুযােগও তিনি পাচ্ছিলেন না। অসীম সাহসিকতার সঙ্গে মল্লযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। এক পর্যায়ে পাঠান সুবেদারকে প্রচণ্ড ঘুষি মেরে মাটিতে ফেলে দেন। কিন্তু মাটিতে পড়ে গিয়েই পাঠান সুবেদার পরিত্যক্ত একটি স্টেনগান নিয়ে লে. কর্নেল সফিউল্লাহর ওপর গুলি চালায়। গুলিটি সফিউল্লাহর কোমরে রক্ষিত পিস্তলে এসে লাগে। পিস্তলটি গুলিতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। তবে লে. কর্নেল সফিউল্লাহ অক্ষত থেকে যান। ত্বড়িৎগতিতে তিনি শক্রদের একজনের হাত থেকে রাইফেল কেড়ে নিয়ে প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এরই মধ্যে শক্রবাহিনীর আরেকটি গাড়ি সিলেটের দিক থেকে এগিয়ে আসে। সফিউল্লাহ তাদের ওপর আক্রমণ করতে গিয়ে দেখেন তার হাতের অস্ত্রটি ভেঙে গেছে। এ অবস্থায় তিনি অস্ত্রশূন্য হয়ে পড়েন। তার সঙ্গের প্রায় সকলেই কমবেশি আহত। অগত্যা তিনি আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হন।
এদিকে গুলির আওয়াজ শুনে মুক্তিবাহিনীর দুটি দল দুদিক থেকে এগিয়ে এসে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। বেশকিছু সময় ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় বরণ করে। এ-যুদ্ধে শত্রুবাহিনীর ২৭ জন নিহত এবং ১৩ জন বন্দি হয়। মুক্তিবাহিনীর হাবিলদার রফিক ও সিপাহি মুজিবুর রহমান শহীদ হন। মেজর নাসিম, ডা. লে. মইনুল, নায়েক মুস্তাফা আলী, নায়েক মুরতজা, নায়েক আবুল কালাম আজাদ, সিপাহি মান্নান ও নায়েক কাদেরসহ ১১ জন আহত হন। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার মেজর নাসিম গুরুতর আহত হওয়ায় মেজর মতিনকে এই ব্যাটালিয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। মেজর নাসিমসহ অন্যান্য আহতদের চিকিৎসার জন্য আগরতলায় হাসপাতালে পাঠানাে হয়। এ-যুদ্ধে শহীদ হাবিলদার রফিককে চান্দুরা ডাকবাংলাের নিকট এবং সিপাহি মুজিবুর রহমানকে রামপুর গ্রামে সিদ্দিক মেম্বারের বাড়ির পুকুরপাড়ে সমাহিত করা হয়।
হরষপুর, চান্দুরা, মাধবপুর প্রভৃতি এলাকার পাকিস্তান বাহিনী পেছন দিকে সরে এসে শাহবাজপুরে তিতাস নদীর সেতুটি ধ্বংস করে দিয়ে নদীর অপর পাশে পাকা ঘাঁটি প্রস্তুত করে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে এখানেও তারা টিকতে পারেনি। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া তাঁর কোম্পানি নিয়ে চান্দুরা থেকে শাহবাজপুরের দিকে এগিয়ে আসে। ক্যাপ্টেন মতিনও তার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। শাহবাজপুর থেকে পরাজয় বরণ করে পাকিস্তানি বাহিনী দ্রুত আশুগঞ্জ ও ভৈরববাজারের দিকে পিছিয়ে যায়। ৮ই ডিসেম্বর সকালে ‘এস’ ফোর্স-এর অগ্রবর্তী দল মিত্রবাহিনীসহ সরাইল মুক্ত করে আশুগঞ্জের দিকে অগ্রহসর হয়।
ইতােমধ্যে আখাউড়া থেকে রেললাইন ও উজানিসার সড়ক দিয়ে অগ্রসরমাণ যৌথবাহিনীও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে পৌঁছে যায়। ভারতীয় বিমানবাহিনীও মিত্রবাহিনীর ভূমিকায় এগিয়ে আসে। পাকিস্তানিরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও সরাইল ছেড়ে আশুগঞ্জ এবং ভৈরববাজারে একত্র হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যাবার পূর্বে ৬ই ডিসম্বের রাতে পাকিস্তানি বাহিনী এখানে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটায়। অর্ধশতাধিক বন্দি মুক্তিযােদ্ধা, সাধারণ নিরপরাধ মানুষ এবং বুদ্ধিজীবীকে শহরের দক্ষিণ পাশে কুরুলিয়া খালপাড়ে নির্মমভাবে হত্যা করে ফেলে রেখে যায়, যা কুরুলিয়া খালপাড় গণহত্যা নামে পরিচিত। এখানে শহীদ হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক লুৎফর রহমান, সরাইলের আওয়ামী লীগ নেতা এডভােকেট সৈয়দ আকবর হােসেন ওরফে বুকুল মিয়া, তার ছােটভাই সৈয়দ আফজাল হােসেনসহ অর্ধশতাধিক বন্দি মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ নিরপরাধ মানুষ। তাদের সকলের পরিচয় পাওয়া যায়নি। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে এসে তারা এখানে বন্দি হয়েছিলেন। অনেক নিরপরাধ সাধারণ মানুষও এখানে বন্দি ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কারাগারে তাদের বন্দি রাখা হয়েছিল। দিনের পর দিন নির্যাতনের পর তাদের হত্যা করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ছেড়ে যাবার সময় পাকিস্তান বাহিনী কলেজের হােস্টেল ও অন্নদা স্কুলের বাের্ডিংসহ তাদের বিভিন্ন রেশন-গুদামে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। এই ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর ত্যাগ করে এবং ৮ই ডিসেম্বর সকালে যৌথবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে প্রবেশ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ মানুষ ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তাদের অভিনন্দন জানায়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ভয়ে এতদিন যারা বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে ছিল, তারাও নির্ভয়ে শহরে ফিরে আসে। ৮ই ডিসেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। [জয়দুল হােসেন]
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড