You dont have javascript enabled! Please enable it!

অসহযােগ আন্দোলন

অসহযােগ আন্দোলন- পাকিস্তানি শাসন ও শাসক-গােষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর নির্দেশে ১৯৭১ সালের ২রা-২৫শে মার্চ পর্যন্ত পালিত বাঙালির প্রতিবাদ কর্মসূচি। এ আন্দোলনের মূল আলােচনায় যাওয়ার পূর্বে সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল ও পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ জানা আবশ্যক। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ- ৬-দফার ভিত্তিতে পাকিস্তান জাতীয় ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন (৭টি মহিলা আসনসহ) এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন (১০টি মহিলা আসনসহ) লাভ করে। অপরদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) জাতীয় পরিষদের সেখানকার ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮৮টি আসন (৫টি মহিলা আসনসহ) লাভ করে।
নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৭১ সালের ৩রা জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) আওয়ামী লীগের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান। অনুষ্ঠানে তিনি ঘােষণা দেন, ৬-দফা ও ১১-দফার প্রশ্নে কোনাে আপােস হবে। না। পরের দিন ৪ঠা জানুয়ারি ছাত্রলীগ-এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু ছাত্রদের যে-কোনাে ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেন। ১১ই জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনায় বসেন এবং ছয়দফা কর্মসূচি ব্যাখ্যা করেন। ইয়াহিয়া খান ১৪ই জানুয়ারি করাচি যাত্রার প্রাক্কালে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথাপ্রসঙ্গে বলেন, ‘শেখ মুজিব পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী … শীঘ্রই তাঁর সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে তার সামরিক জান্তা নির্বাচনি ফলাফল বাতিল এবং সামরিক শক্তি প্রয়ােগে বাঙালিদের দমন করার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে ১৭ই জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান লারকানায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে বৈঠক করেন। ভুট্টো ২৭শে জানুয়ারি ঢাকায় আসেন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলােচনাকালে বাঙালি ও বঙ্গবন্ধুর প্রশংসা করে তিনি বক্তব্য রাখেন। এ-সবই ছিল লােক দেখানাে। তিনদিন ঢাকায় অবস্থানের পর ৩০শে জানুয়ারি তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলােচনা থেকে তিনি নিশ্চিত হন যে, বঙ্গবন্ধু ছয়দফার প্রশ্নে অনমনীয়। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে সরাসরি জানিয়ে দেন, তিনি ছয়দফার প্রশ্নে জনগণের ম্যান্ডেট পেয়েছেন। সুতরাং এর থেকে এক ইঞ্চিও তাঁর পক্ষে সরে আসা সম্ভব নয়। পক্ষান্তরে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেন, ছয়দফার নিশ্চিত ফল হচ্ছে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছয়দফার প্রশ্নে কিছুতেই ছাড় দিতে রাজি ছিলেন না। ভুট্টোর মতে, তিনি তাঁর রণকৌশল নির্ধারণ করে ফেলেছিলেন। আর তা হচ্ছে, কোনােরূপ সময় নষ্ট না করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকা এবং ছয়দফাকে আইনগত স্বীকৃতি দিয়ে দেশকে ছয়দফাভিত্তিক একটি শাসনতন্ত্রের দিকে ঠেলে দেয়া।
১৯৭১ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদ অধিবেশন আহ্বানে বিলম্বের জন্য ইয়াহিয়ার সমালােচনা করেন এবং ১৫ই ফেব্রুয়ারির মধ্যে অধিবেশন আহ্বানের আলটিমেটাম দেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনা করেন। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ইয়াহিয়া ঘােষণা করেন, পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়নের জন্য জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসবে ৩রা মার্চ। স্থান নির্ধারিত হয় ঢাকার প্রাদেশিক পরিষদ ভবন। ১৬ই ফেব্রুয়ারি পিপিপি নেতা ভুট্টো পেশােয়ারে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ঘােষণা করেন, তারা ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদান করবেন না। তিনি আরাে বলেন, আওয়ামী লীগের ছয়দফার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়নে তারা রাজি নন। তাদের বাদ দিয়ে কিছু করা হলে খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত সবকিছু অচল করে দেয়া হবে। ভুট্টো ছয়দফার মধ্যে মাত্র দুটি দফা সমর্থনের কথা বলেন – জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধি নির্বাচন ও প্রদেশের জন্য প্যারামিলিশিয়া গঠন। বাকি চারটি দফার ব্যাপারে তিনি তীব্র বিরােধিতা করেন।
জাতীয় পরিষদের আহূত অধিবেশনে যােগদানে ভুট্টোর অস্বীকৃতির জবাবে বঙ্গবন্ধু ১৬ই ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠকে ‘ফ্যাসিস্ট’ পন্থা পরিহার করে গণতন্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে সংখ্যাগুরুর শাসন মেনে নেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু ১৭ই ফেব্রুয়ারি ভুট্টো করাচিতে সাংবাদিক সম্মেলনে অধিবেশন বর্জনের পুনরাবৃত্তি করে বলেন, আওয়ামী লীগ ছয়দফার ব্যাপারে এতই অনমনীয় যে, তাদের সঙ্গে কোনাে আপােস হতে পারে না। একইদিন একুশের শহীদদের স্মরণে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আয়ােজিত সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনকে কোনাে শক্তিই থামাতে পারবে না। এদিকে জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের দিন এগিয়ে আসতে থাকে। অধিবেশনের জন্য ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ঢাকার প্রাদেশিক পরিষদ ভবন সংস্কার করা হয়। অধিবেশনে যােগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ৩৫ জন সদস্য ঢাকায় আসেন। কিন্তু হঠাৎ করে ১লা মার্চ দুপুর ১:০০টার বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান ৩রা মার্চের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করেন। এজন্য তিনি পিপিপি-র অনাগ্রহ এবং ভারতসৃষ্ট উত্তেজনাকর রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করেন। একইদিন তিনি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে এস এম আহসানকে অপসারণ করে তার স্থলে সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াকুবকে গভর্নরের অতিরিক্ত বেসামরিক দায়িত্ব প্রদান করেন। এ প্রেক্ষাপটে মার্চের শুরু থেকে অসহযােগ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে।
অসহযােগের দিনগুলাে একাত্তরের মার্চে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির মুক্তির নিয়ন্তা। তাঁর নেতৃত্বে ২রা থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযােগ আন্দোলন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলন বিশ্বের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা, কারণ এটি শুধু একটি সফল মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিই তৈরি করেনি, এর মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন কার্যত সরকার প্রধান।
এ বিশেষ আন্দোলনে নির্বাচিত জাতীয় নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে। সিভিল সমাজের প্রতিনিধিবর্গ ও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে কীভাবে একটি স্বাধীন দেশের প্রশাসন পরিচালনা করা যায়, তার একটি মহড়া হয়ে গিয়েছিল। একই সঙ্গে নেতৃবৃন্দ প্রতিপক্ষের সঙ্গে আলােচনাও চালিয়ে যেতে থাকেন। সারা বিশ্ব অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, একটি জাতি সুশৃঙ্খলভাবে গণতান্ত্রিক পথে কীভাবে ধীরে-ধীরে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই আন্দোলন যে কতটা তীব্ররূপ ধারণ করেছিল, জনমনে কী বৈপ্লবিক আবেগ সৃষ্টি করেছিল এবং পরবর্তীতে এর সুদূরপ্রসারী ফল কী দাঁড়িয়েছিল, তার সঠিক তথ্য এখানে তুলে ধরা প্রয়ােজন।
মূলত একাত্তরের মার্চের প্রথমদিন থেকেই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতাে দেশ চলতে শুরু করে। তাঁর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ-এর চেতনায় বাঙালিরা সর্বাত্মকভাবে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ১লা মার্চ বেতারে ইয়াহিয়া খানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা সম্পর্কিত অনাকাক্ষিত ঘােষণায় বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ডাকসু ও ছাত্রলীগ নেতাদের নেতৃত্বে সকল শিক্ষার্থী ক্লাস ও আবাসিক হল থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় জড়াে হয়। নেতৃবৃন্দ বিকেল ৩টায় পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভার ঘােষণা দেন। বিক্ষুব্ধ জনতাও রাস্তায় বেরিয়ে আসে। তাদের মুখে স্লোগান ধ্বনিত হয়, তােমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জয় বাংলা’। মিছিলে-মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে রাজধানীর রাজপথ। ঢাকা স্টেডিয়ামে চলতে থাকা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ পণ্ড হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কল-কারখানা, যানবাহন। হােটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধু পার্লামেন্টারি পার্টির জরুরি বৈঠক ডাকেন। রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে এমএনএ ও এমপিএদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ইয়াহিয়া খান সৈন্য আনছেন। তিনি তার পথে যাচ্ছেন, আমি আমার পথে যাব। এলাকায় যান। প্রস্তুত থাকুন। জনগণকে সংগঠিত করুন চরম ত্যাগের জন্যে। বিকেল ৩টায় মিছিলসহ হাজার-হাজার মানুষ হােটেল পূর্বাণীর সামনে জড়াে হয়। পরে জনাকীর্ণ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক সকল উপায় ব্যর্থ হয়েছে। সংখ্যালঘু দলের মনােভাবের জন্যে অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা। এ অবস্থাকে চ্যালেঞ্জবিহীন ছেড়ে দেয়া হবে না। একই সঙ্গে তিনি ২রা মার্চ ঢাকায় ও ৩রা মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালন এবং চূড়ান্ত কর্মসূচি ঘােষণার জন্য ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা আহ্বান করেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দকে ডেকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করার নির্দেশ দেন। এ নির্দেশ অনুযায়ী ৩রা মার্চ বিকেলে ছাত্রনেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব এবং আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক বৈঠকে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। পল্টন ময়দানের সভায় ছাত্রনেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশাবলি পালন এবং পরদিন ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-জনসভায় যােগদানের আহ্বান জানান।
২রা মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় হাজারাে ছাত্র-জনতার সমাবেশে ছাত্রলীগ ও ডাকসু’র নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত লাল-সবুজের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী অসহযােগ শুরু হয়। হরতাল পালনের সময় জনতার ঢল নামে রাজধানীতে। মিছিলের পর মিছিল। বিক্ষোভকারী জনতার ওপর সেনাবাহিনীর নির্বিচার গুলিবর্ষণে ঢাকায় কমপক্ষে দুজন নিহত ও প্রায় দুশ মানুষ আহত হয়। বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের ওপর সরকারের গুলিবর্ষণের এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান। প্রতিবাদে ঐদিন রাতেই ৭ই মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচি ঘােষণা করেন এবং কয়েকটি নির্দেশ দেন, যার মধ্যে ৩রা থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সর্বত্র হরতাল, ৩রা মার্চ শােকদিবস পালন এবং রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য বা বিবৃতি সঠিকভাবে পরিবেশন না করলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সকল বাঙালিকে সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে অসহযােগিতা করার নির্দেশ ছিল। ৭ই মার্চ বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে গণসমাবেশে ভাষণ দেয়ার কথাও পুনর্ব্যক্ত করেন তিনি।
৩রা মার্চ বিকেলে পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক সমাবেশে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়। এটি পাঠ করেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ। এতে স্পষ্টভাবে বলা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক। সমাবেশে পরিষদের নেতৃবৃন্দ নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর ব ও আব্দুল কুদ্দুস মাখন স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করেন। এদিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেতার মারফত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ পার্লামেন্টারি গ্রুপের ১২ জন নেতাকে ১০ই মার্চ ঢাকায় এক বৈঠকে যােগদানের আমন্ত্রণ জানান। বঙ্গবন্ধু এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে এক বিবৃতিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং অব্যাহত সামরিক প্রস্তুতির কঠোর সমালােচনা করেন। তিনি ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠের জনসভায় যােগ দেন এবং সুসজ্জিত জয় বাংলা বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। পল্টনে সেদিন রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালােবাসি’ গানটিকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত ঘােষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু সামরিক সদস্যদের প্রত্যাহার এবং জনগণের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সকল প্রকার খাজনা-কর না দেয়ার আহ্বান জানান। তিনি কোর্ট-কাচারি, অফিস-আদালত, রেল, স্টিমার ও পিআইএ বিমানে কর্মরতদের কাজে না যাওয়ার নির্দেশ দেন। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মুক্তিকামী মানুষ ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে তােলে। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তান কার্যত অচল হয়ে পড়ে। অসহযােগ আন্দোলনের শুরুতেই রেডিও পাকিস্তান পরিণত হয় বাংলাদেশ বেতার-এ। বেতার ও টেলিভিশনে হরতালের সমর্থনে দেশাত্মবােধক গান পরিবেশিত হতে থাকে। দেশবাসীর এ ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত কর্মকাণ্ডে ভীত হয়ে পাকিস্তান সরকার ঐদিন সন্ধ্যায় ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে কারফিউ জারি করে। এর প্রতিক্রিয়ায় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে জনতা। ৫ই মার্চ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং পাক সরকারের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে ধারণা বিনিময় করতে করাচি থেকে ঢাকায় আসেন। একইদিন জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে ঢাকায় পৌঁছান। ৬ই মার্চ ইয়াহিয়া খান এক বেতার ভাষণে ২৫শে মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন আহ্বান করেন। ইয়াহিয়ার ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে বিকেলে তাঁর বাসভবনে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির জরুরি বৈঠক বসে। বৈঠক চলাকালেই আসগর খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
পরের দিন ৭ই মার্চ। বাঙালিদের জাতীয় জীবনে একটি অবিস্মরণীয় দিন। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শােনার জন্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ধর্ম-বর্ণ-নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ মানুষ দলে-দলে এসে জড়াে হয় রেসকোর্সের বিস্তৃত ময়দানে। হাতে বাঁশের লাঠি আর কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। লক্ষ্য তাদের অভিন্ন – স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তি। তারা সকলে মুক্তির বাণী শুনতে এসেছে। বেলা সােয়া তিনটায় বঙ্গবন্ধু সভামঞ্চে এসে উপস্থিত হন। ততক্ষণে দশ লক্ষাধিক লােকের জনসমুদ্রে পরিণত হয় রেসকোর্স ময়দান। তার সামনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা ও বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন, রক্তের দাগ শুকায় নাই … ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যােগদান করতে পারে না। প্রত্যেক ঘরে-ঘরে দুর্গ গড়ে তােলা, যার যা-কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করা এবং রাস্তাঘাট সব বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দিয়ে ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে ঘােষণা করেন, ‘… রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার এই ভাষণ গােটা জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করে তােলে।
১২ই মার্চ কর্নেল এম এ জি ওসমানীর নেতৃত্বে অবসরপ্রাপ্ত কয়েক হাজার সৈনিক ও সেনা কর্মকর্তার স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার শপথ গ্রহণ এবং ২০শে মার্চ ছাত্র। ইউনিয়নের পাঁচশ ছাত্র-ছাত্রী নিয়ে গঠিত গণবাহিনীর ট্রেনিং শেষে কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করা ছিল বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ-এর প্রতিক্রিয়ারই অংশ। অর্থাৎ সেদিন থেকেই মুক্তির চূড়ান্ত লক্ষ্যে জনগণ যে-কোনাে পরিস্থিতি মােকাবেলায় প্রস্তুতি নিতে থাকে। মূলত মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু হওয়া অসহযােগ আন্দোলন ও ৭ই মার্চের ভাষণ মানুষকে নতুন এক স্বপ্নে আন্দোলিত করে। বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। কিন্তু ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা সে-দাবি মেনে নিতে রাজি না হওয়ায় তিনি সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দেন। তাঁর নির্দেশমতাে পূর্ব পাকিস্তান পরিচালিত হতে থাকে। সাধারণ রিকশাওয়ালা ও পিয়ন থেকে শুরু করে দেশের প্রধান বিচারপতি পর্যন্ত তাঁর নির্দেশ পালন করে চলেন। মার্চ মাসেই পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকার করেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সম্প্রচার করতে না দেয়ায় বেতার-টেলিভিশনের কর্মকর্তাকর্মচারীরা অনুষ্ঠান বন্ধ করে বেতার ও টেলিভিশন ভবন ছেড়ে চলে আসেন। সাতটি সেনানিবাস ছাড়া বঙ্গবন্ধুর শাসন সমগ্র প্রদেশে বিস্তার লাভ করে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে প্রাদেশিক সরকারের কাজ চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশব্যাপী যে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়, পর্যায়ক্রমে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তাতে অংশগ্রহণ করতে থাকে। চারদিক থেকে বিভিন্ন সংগঠন ও সমিতির ব্যানারে তাঁর প্রতি সমর্থন ব্যক্ত হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় ১২ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সিএসপি ও ইপিসিএস কর্মকর্তারা বাংলার সাত কোটি মানুষের জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘােষণা করেন। সেদিন তারা বঙ্গবন্ধুর সকল নির্দেশ মেনে চলার এবং আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে এক দিনের বেতন দানের কথাও ঘােষণা করেন। অন্যসব সরকারি-বেসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একজোট হয়ে বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন অচল হয়ে পড়ে। ব্যতিক্রম শুধু ক্যান্টনমেন্ট। এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির জন্য সরকার গােপনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনাসদস্য আনতে থাকে। অপারেশন সার্চলাইটএর অংশ হিসেবে পর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়। অনেকের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নেয়া হয় এবং নিরস্ত্র অবস্থায় ব্যারাকে ক্লোজও করা হয়। বাতিল করা হয় সামরিক বাহিনীর সব সদস্যের ছুটি।
১২ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রখ্যাত শিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের সভাপতিত্বে চিত্রশিল্পীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশের জাতীয় ফুল হবে ‘শাপলা’। চিত্রশিল্পীরাও বঙ্গবন্ধুর এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদানের দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। এ অবস্থায় সাংবাদিক সমাজও বঙ্গবন্ধুর অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করার ঘােষণা দেয়। তারা দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার ভূমিকার তীব্র নিন্দা জানায়। দৈনিক সংবাদ ও ইত্তেফাক-এর ভূমিকা ছিল খুবই প্রশংসনীয়। আকাশবাণী কলকাতা ও বিবিসিতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের খবরাখবর প্রতিদিন প্রচারিত হতে থাকে। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকদের গতিবিধির ওপর পাকিস্তানি সামরিক সরকার নজরদারি বাড়িয়ে দেয়। তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংবাদ প্রকাশের ওপর সেন্সর আরােপ করা হয়। সরকারের নড়বড়ে অবস্থার সুযােগে দেশের বিভিন্ন কারাগারে শুরু হয় বিদ্রোহ। বাঙালি পুলিশ ও আনসারদের ছুটি নেয়ারও হিড়িক পড়ে যায়। অপরদিকে, সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবন করে অনেক পাকিস্তানি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী গােপনে তাদের পরিবারপরিজন পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাতে থাকেন।
এদিকে টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সেনানিবাসে শক্তি বাড়ানাের নির্দেশ দেন। আকাশপথের পাশাপাশি চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে জলপথেও পাকিস্তান সরকার সামরিক সরঞ্জাম আনতে থাকে। এসব বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে বঙ্গবন্ধু তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে একের পর এক নির্দেশ জারি করে গােটা আন্দোলনকে পরিচালিত করতে থাকেন। মুক্তিবাহিনী গঠন, অস্ত্রসংগ্রহ, প্রশিক্ষণ, পাড়া-মহল্লায় সংগ্রাম কমিটি গঠন, কূটনৈতিক চ্যানেলে ভারত, তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়নসহ সহানুভূতিশীল দেশসমূহের সহায়তা চেয়ে বার্তা পাঠানাে, দেশের আপামর জনসাধারণকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করা, ছাত্র ও যুব সমাজের যুদ্ধের প্রস্তুতি – যাবতীয় কাজই হচ্ছিল ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবন থেকে। এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, সে-সময়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরই ছিল যেন পূর্ব পাকিস্তানের হােয়াইট হাউস কিংবা ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট। ১২ই মার্চ লন্ডনের ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় বলা হয়, জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন শেখ মুজিবকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়। সরকারি অফিসার, রাজনীতিবিদ, ব্যাংকার, শিল্পপতি এবং অন্যান্য মহলের লােকজন তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্যে ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র মিলিটারি ব্যারাক ও সৈন্যবেষ্টিত বিমানবন্দরের ওপর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের কর্তৃত্ব রয়েছে বলে মনে হয়।
১৫ই মার্চ বঙ্গবন্ধু এক বিবৃতির মাধ্যমে হরতাল অব্যাহত রাখাসহ ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। এই নির্দেশের মধ্য দিয়ে তিনি কার্যত বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে অথবা কৌশলগত কারণে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বৈঠকের জন্য ঢাকায় আসেন। ২১শে মার্চ সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে ভুট্টোও ঢাকায় আসেন। ২২শে মার্চ প্রেসিডেন্ট ভবনে মুজিব-ভুট্টো-ইয়াহিয়া বৈঠক হয়। কিন্তু প্রহসনমূলক সে বৈঠকের ফলাফল দাঁড়ায় শূন্য। বাস্তবে বৈঠকের নামে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা সময় ক্ষেপণ করে মাত্র। বাঙালিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনার প্রস্তুতি গ্রহণে তা তাদের দরকার ছিল। বৈঠক শেষে জাতীয় পরিষদের আহূত অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলাপকালে পাকিস্তানের প্রধান অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারক এম এম আহমদ স্বীকার করেন যে, বাঙালিদের ওপর অর্থনৈতিক দিক থেকে বড় ধরনের অবিচার করা হয়েছে। তিনি ৬-দফার অর্থনৈতিক দাবিগুলাে মেনে নিয়ে সংবিধান সংশােধনের উদ্যোগও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ততক্ষণে পরিস্থিতি আর অনুকূলে ছিল না।
২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসে সারা বাংলায় প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। একমাত্র ক্যান্টনমেন্ট ও গভর্নর হাউস ব্যতীত সর্বত্র পাকিস্তানের পতাকার পরিবর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। সর্বস্তরের মানুষ মিছিল সহকারে বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ির দিকে যায়। ঐদিন বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা জনতার উদ্দেশে তুলে ধরেন। এদিকে পাকিস্তানিদের দোসর একটি কুচক্রী মহল অপপ্রচার চালাতে থাকে যে, শেখ মুজিব প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে আপােস করে স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে পিছপা হচ্ছেন। ঐ মহলের এসব গুজবে কান না দেয়ার জন্য বর্ষীয়ান জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান। ভাসানী- দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, গােটা দেশ এখন মুজিবের কথামতাে চলছে। দেশপ্রেমিক সব মানুষ মুক্তির জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে। এখন পিছপা হওয়ার আর কোনাে সুযােগ নেই। যারা মুজিবের কথার বাইরে যাবেন তারা হবেন গাদ্দার। আর গাদ্দারদের স্থান এই দেশে হবে না।
খুব স্বাভাবিক নিয়মেই পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাঙালির এরূপ উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। তাদের সামনে তখন দুটি পথ খােলা ছিল: এক. বাঙালি নেতৃত্বকে নিঃশর্তভাবে মেনে নেয়া; দুই. শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে বাঙালির জাতীয় মুক্তির আন্দোলন নস্যাৎ করা। তারা দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিয়েছিল। কিন্তু তারা এ সত্যটি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয় যে, মুক্তির আকাক্ষা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা এতদিনে বিস্তৃত হয়ে বাংলার ঘরে-ঘরে পৌছে গেছে। সুতরাং বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে ধ্বংস করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। না। এরই মধ্যে সামরিক জান্তা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আরাে সৈন্য ও গােলাবারুদ এনে এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর হামলার প্রস্তুতি গ্রহণ করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের কর্ণধাররা অবশেষে সামরিক শক্তি প্রয়ােগ ও গণহত্যার পথ বেছে নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের কবর রচনা করে। ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া গােপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। রাতে পাকসেনারা হায়েনার মতাে ঝাপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর। অতর্কিত এ হামলায় ঐ রাতে নির্মমভাবে নিহত হয় ঢাকা শহরের কয়েক হাজার ঘুমন্ত মানুষ। এরই প্রেক্ষাপটে ২৬শে মার্চ রাতে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ইতিহাসের গতির প্রতি লক্ষ্য রেখে, জনচাহিদার প্রতি পূর্ণ সম্মান জানিয়ে, বিশ্ব জনমতের বিষয়টি স্মরণে রেখে মােক্ষম এক সময়েই তিনি স্বাধীনতার এ ঘােষণা দেন। পরে অনেকেই তার এ ঘােষণা বেতারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করেন।
আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে প্রস্তুতি চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। তবে মার্চ মাসের প্রথম পঁচিশ দিন ছিল সেই প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ-সময়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর নেয়া পদক্ষেপগুলাে ছিল একেবারেই নির্ভুল। তাঁর স্বাধীনতার ঘােষণার পর থেকেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশের আপামর জনসাধারণ। নয়মাস স্থায়ী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ১৬ই ডিসেম্বর বাঙালিরা বিজয় অর্জন করে, প্রতিষ্ঠা পায় স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর ৩৫টি নির্দেশনা নিম্নরূপ: ১. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধাসরকারি অফিসসমূহ, হাইকোর্ট ও দেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালনকরবে। তবে অতি প্রয়ােজনীয় ও আন্দোলনের স্বার্থে নির্দিষ্ট অফিস, দপ্তর ও সংস্থা হরতালের আওতা বহির্ভূত থাকবে। ২. বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ৩. আইনশৃঙ্খলা রক্ষা- ডেপুটি কমিশনার, সাব-ডিভিশনাল অফিসার আওয়ামী লীগ সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নয়ন কর্মসূচিসহ দায়িত্ব পালন করবে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে। ৪. বন্দরসমূহ- অভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল অব্যাহত থাকবে। তবে সৈন্যদের সহযােগিতা করবে না। বন্দরের কাজ চলবে। ৫. মাল আমদানি- আমদানিকৃত সকল মালামাল খালাস করতে হবে। সংগৃহীত অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবে জমা হবে না। ৬. রেল চলবে- তবে সৈন্য চলাচল বা তাদের রসদ বহন করতে পারবে না। ৭. সড়ক পরিবহন- ইপিআরটিসি’র বাস চলাচল করবে। ৮. অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের কাজ চলবে। ৯, ডাক ও টেলিগ্রাফ বাংলাদেশের মধ্যে কাজ করবে- বিদেশে মেল সার্ভিস ও টেলিগ্রাফ করা যেতে পারে। ১০. টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে। ১১. বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র- এগুলাে চালু থাকবে এবং জনগণের আন্দোলনের সংবাদ প্রচার করতে হবে। ১২. হাসপাতালসমূহ চালু থাকবে। ১৩. বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু থাকবে। ১৪. পানি, গ্যাস সরবরাহ চালু থাকবে। ১৫. কয়লা সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। ১৬. খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। খাদ্য আমদানি চালু থাকবে। ১৭. কৃষি তৎপরতা- ধান ও পাটের বীজ, সার ও কীটনাশক ওষুধ সংগ্রহ ও বণ্টন অব্যাহত থাকবে। পাওয়ার পাম্প ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ চালু থাকবে। কৃষি ব্যাংকের কাজ চালু থাকবে। ১৮. বন্যানিয়ন্ত্রণ ও শহর সংরক্ষণের কাজ অব্যাহত থাকবে। ১৯. উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ চলবে। ২০. সাহায্য ও পুনর্বাসন- ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজসহ পুনর্বাসনের কাজ চলতে থাকবে। ২১. ইপিআইডিসি, ইস্টার্ন রিফাইনারি ও সকল কারখানার কাজ চলবে। ২২. সকল সরকারি ও আধা সরকারি সংস্থার কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন নিয়মিতভাবে প্রদান করতে হবে। ২৩. পেনশন- নিয়মিতভাবে সরকারি-বেসরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের দেয়া হবে। ২৪. এজি ও ট্রেজারি- বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক কর্মচারী কাজ চালিয়ে যাবে। ২৫. ব্যাংক সকাল ৯টা হতে ১২টা পর্যন্ত ব্যাংকিং কাজ করবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে লেনদেন চলবে না। বিদেশের সাথে ব্যবসাবাণিজ্য চলবে। ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশনকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেয়া হবে। ২৬. স্টেট ব্যাংক- অন্যান্য ব্যাংকের মতােই কাজ করবে। ২৭. আমদানি ও রপ্তানি কন্ট্রোলার- আমদানি-রপ্তানি নিশ্চিত করবে এবং কাজ চালিয়ে যাবে। ২৮. ট্রাভেল এজেন্ট ও বিদেশী এয়ারলাইন্স চালু থাকবে। ২৯. ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থা চালু থাকবে। ৩০. পৌরসভার কাজ চালু থাকবে। ৩১. ভূমি রাজস্ব আদায় বন্ধ থাকবে। লবণ ও তামাক কর আদায় হবে না। আয়কর আদায় বন্ধ থাকবে। এ ছাড়া প্রাদেশিক কর আদায় হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের একাউন্টে জমা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর, আবগারী শুল্ক কর, বিক্রয় কর আদায় করে কেন্দ্রীয় সরকারের খাতে জমা না দিয়ে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল বা ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশনে জমা দিতে হবে। ৩২. পাকিস্তান বীমা কর্পোরেশন, পােস্টাল লাইফ ইস্যুরেন্স চালু থাকবে। ৩৩. সব ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সেবাদান নিয়মিতভাবে চলবে। ৩৪. সকল বাড়ির ওপর কালাে পতাকা উড়বে। ৩৫. সংগ্রাম পরিষদগুলাে সর্বস্তরে তাদের কাজ চালু রাখবে এবং এসব নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে যাবে। [আতিউর রহমান]]
সহায়ক গ্রন্থ: Rehman Sobhan, ‘Economic Basis of Bengali Nationalism’ in History of Bangladesh 1704-1971 ed. Sirajul Islam, Vol. II (Economic History), Asiatic Society of Bangladesh, Dhaka 1997; আতিউর রহমান ও অন্যান্য, ভাষা আন্দোলনের আর্থ-সামাজিক পটভূমি, ইউপিএল, ঢাকা ২০০০; আতিউর রহমান, অসহযােগের দিনগুলি : মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্ব, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা ১৯৯৮; হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র (দ্বিতীয় খণ্ড), তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, প্রথম প্রকাশ ১৯৮২, পুনর্মুদ্রণ ২০০৯

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!