You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.01 | আইস ফ্যাক্টরি রােড অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর) - সংগ্রামের নোটবুক

আইস ফ্যাক্টরি রােড অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর)

আইস ফ্যাক্টরি রােড অপারেশন (চট্টগ্রাম মহানগর) পরিচালিত হয় ১লা নভেম্বর। এতে একজন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ, একজন পাকসেনাদের হাতে বন্দি এবং একজন আহত হন। ঘটনার দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আইস ফ্যাক্টরি রােডে মুক্তিযােদ্ধা অমল মিত্র, রফিক, শফিউল বশর ও ফজলুল হক ভূঁইয়ার ওপর আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে ব্যাপক গুলি বিনিময় হয়। ঘটনাস্থলে শহীদ হন মুক্তিযােদ্ধা রফিক, গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত অবস্থায় হানাদারদের হাতে বন্দি হন শফিউল বশর এবং কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন ফজলুল হক ভূঁইয়া। অমল মিত্র অক্ষত অবস্থায় শেল্টারে ফিরে যান।
সেদিন আইস ফ্যাক্টরি রােডে মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশনের কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। তাদের টার্গেট ছিল কাস্টমস কর্মচারীদের বেতনের টাকা বহনকারী একটি ভ্যান গাড়ি। কিন্তু সেটি না পেয়ে তাৎক্ষণিক তাঁরা অপারেশনের সিদ্ধান্ত নেন। অক্টোবরের শেষদিকে এ অপারেশনের পরিকল্পনা করা হয়। শহরের মুক্তিযােদ্ধাদের তখন টাকা-পয়সার সংকট চলছিল। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে বহু মুক্তিযােদ্ধা চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেছেন। স্থানীয়ভাবে সংগঠিত মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাও কম নয়। শহরে মুক্তিযােদ্ধাদের থাকা-খাওয়াসহ বিভিন্ন খরচ মেটাতে অনেক টাকার প্রয়ােজন। চট্টগ্রাম শহরে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা টাকা সংগ্রহের কোনাে উপায় বের করতে না পেরে অবশেষে সরকারি টাকা হস্তগত করার পরিকল্পনা করেন।
মুক্তিযােদ্ধাদের সিটি হাইকমান্ড অনেকদিন গােয়েন্দা লাগিয়ে জানতে পারেন যে, কাস্টমস কর্মচারীদের বেতনের টাকা প্রতিমাসে স্টেট ব্যাংক থেকে একটি ভ্যান গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয়। আগ্রাবাদের পানওয়ালা পাড়ার বেইজ ক্যাম্প (আবদুল হাই সরদারের বাড়ি)-এ বসে সিটি হাইকমান্ডের নেতা মৌলভী সৈয়দ, ডা. মাহবুবুল আলম, ইঞ্জিনিয়ার আবদুল্লাহ আল হারুন, ডা. জাফরুল্লাহ, মােহাম্মদ হারিস, নূরুল ইসলাম, জালাল উদ্দিন, আবু সাইদ সরদার প্রমুখ ১লা নভেম্বর স্টেট ব্যাংকের টাকা। বহনকারী ভ্যান গাড়িটিতে অপারেশন চালিয়ে টাকা হস্তগত করার সিদ্ধান্ত নেন। অপারেশনের সার্বিক দায়িত্ব দেয়া হয় ডা. মাহবুবকে। অপারেশনের জন্য অমল মিত্রসহ ৬ জন। মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে একটি দল গঠন করা হয়। দলনেতা নির্বাচিত হন ডা. জাফরউল্লাহ। দলের সদস্যরা ছিলেনঅমল মিত্র, সৈয়দ রফিক (কমার্স কলেজের ছাত্র, বােয়ালখালী), শফিউল বশর, ফজলুল হক ভূঁইয়া ও ভােলা নাথ। ১লা নভেম্বর সকাল ৯টায় নূরুল ইসলামের পৈতৃক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগ্রবাদ ওসমান কোর্ট থেকে একটি ফিয়েট (নং ১১০০) গাড়ি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা রওনা হন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আরাে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল ২টি এসএমজি, ৪টি ৩৮ রিভলভার ও ২টি গ্রেনেড। কোতােয়ালি থানা, নিউ মার্কেটের মােড় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ছদ্মবেশে অপেক্ষমাণ মুক্তিযােদ্ধারা ভ্যানগাড়িটিকে পর্যবেক্ষণ করছেন কখন গাড়িটি টাকা ভর্তি করে ব্যাংক থেকে বের হয়। ব্যাংক থেকে গাড়ি রওনা হলে মুক্তিযােদ্ধারা গাড়ির পিছু নেবেন এবং নিরাপদ স্থানে গাড়ি থামিয়ে টাকাগুলাে এবং গাড়ির চাবি নিয়ে শেল্টারে চলে যাবেন। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করেন। কিন্তু সেদিন আর টাকা নিয়ে গাড়ি বের হলাে না। তখন মুক্তিযােদ্ধারা কোতােয়ালি ঘুরে নিউমার্কেটের মােড় পার হয়ে সদরঘাট কালীবাড়ির দিকে অগ্রসর হন। দলনেতা ডা. জাফরউল্লাহ গাড়ি থেকে কোতােয়ালির মােড়ে নেমে যান। গাড়িটি নিউমার্কেটের সামনে আইডিয়াল বুক স্টল নামক একটি বইয়ের দোকানের কাছে যখন আসে, তখন সেখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একজন অফিসার একটি বই হাতে নিয়ে পড়ছিল। পাশেই একটি মাংসের দোকানের নিকট গাড়িটি রেখে মুক্তিযােদ্ধারা ঐ অফিসারের সামনে গিয়ে তাকে পরপর কয়েকটি গুলি করলে সে নিহত হয় এবং তার ব্যবহৃত রিভলবারটি নিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা গাড়িতে ওঠেন। মুক্তিযােদ্ধাদের গাড়িটি কলেজের মােড় অতিক্রম করতেই পেছনের দিক থেকে পাকবাহিনীর একটি গাড়ি দ্রুত গতিতে এসে তাঁদের গাড়ি লক্ষ করে বৃষ্টির মতাে গুলি চালাতে থাকে। হানাদারদের গুলিতে মুক্তিযােদ্ধাদের গাড়ির চাকা ফেটে যাওয়ায় গাড়ি থেমে যায়। রফিক গাড়ির দরজা খুলে রাস্তায় লাফিয়ে পড়েন। তখন তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। শফিউল বশর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে উত্তর পাশের আফগারি অফিসে ঢুকে পড়েন। অমল ও ফজলু তখনাে গাড়িতে। তাঁরা দেখেন হানাদাররা খুব কাছে চলে এসেছে। তখন সামনের দিক থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর একটি গাড়ি আসে। মৃত্যু অবধারিত জেনে অমল ফজলুকে সামনের গাড়িতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে বলে নিজে পেছনের গাড়ি লক্ষ করে ফায়ার করেন। শুরু হয় উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময়। মুক্তিযােদ্ধাদের গাড়ির ড্রাইভার ভােলানাথ গুলিবিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ঐ স্থান থেকে সরে পড়তে সক্ষম হন। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের ফলে হানাদার বাহিনীর গাড়িদুটি কিছুটা পিছু হটে। তখন অমল ও ফজলু গাড়ি থেকে দ্রুত লাফিয়ে পড়েন। অমল দৌড়ে রেলওয়ে কলােনিতে মেম্বার ফরিদের বাসায় ঢুকে কাপড়-চোপড় পাল্টে রিভলবারটি কোমরে গুজে মুহূর্তে একটি টেক্সিতে উঠে আগ্রাবাদের পানওয়ালা পাড়ার শেল্টারে চলে যান। ২রা নভেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকায় এ অপারেশনের খবর প্রকাশিত হয়। [জামাল উদ্দিন]।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড