You dont have javascript enabled! Please enable it!

আওয়ামী লীগ

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের পুরনাে ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল। এ দলটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দান করে। এটি পাকিস্তানের প্রথম কার্যকর বিরােধী দল। আওয়ামী লীগ কল্যাণমূলক অর্থনীতি ও অসাম্প্রদায়িকতার আদর্শে বিশ্বাসী।
১৯৪৭ সালের পূর্বে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ অভ্যন্তরীণভাবে দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। একটি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের সমর্থক বা প্রগতিশীল অংশ এবং অপরটি খাজা নাজিমুদ্দীন ও মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বাধীন জিন্নাহ-লিয়াকত সমর্থক রক্ষণশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল অংশ হিসেবে পরিচিত ছিল। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আগত, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ নেতা-কর্মীরা সােহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আর খাজা গ্রুপ নামে পরিচিত নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপে ছিল প্রধানত জমিদারি স্বার্থ এবং কলকাতা-ভিত্তিক অবাঙালি ব্যবসায়ী গােষ্ঠী-স্বার্থের অনুসারীরা। ১৯৪৪ সাল থেকে টাঙ্গাইলের শামসুল হকের নেতৃত্বে ১৫০ নম্বর মােগলটুলী (শওকত আলীর বাড়ি) পার্টি হাউজকে কেন্দ্র করে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের প্রগতিশীল অংশের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ থেকে রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছিলেন।
পাকিস্তান আন্দোলনকে ঘিরে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সােহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের যে স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা ছিল, ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র সেটি ছিল না। শুরুতেই বাঙালিদের ওপর নেমে আসে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর শাসন-বৈষম্য ও জাতি-নিপীড়ন। পাকিস্তান আন্দোলনে অসামান্য ভূমিকা সত্ত্বেও নতুন রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে তারা হয় উপেক্ষিত। ১৯৪৮ সালের ভাষা-আন্দোলনছিল এর বিরুদ্ধে তাদের প্রথম বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। এমনি এক পটভূমিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর দশ মাসের মধ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন পুরনাে ঢাকার কে এম দাস লেনের রােজ গার্ডেনে সােহ্রাওয়ার্দী-হাশিম সমর্থক নেতা-কর্মীদের এক কনভেনশনে নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। প্রতিষ্ঠাকালে এর নামকরণ হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী-কে সভাপতি, আতাউর রহমান খান, আলী আহমদ খান, আলী আমজাদ খান, সাখাওয়াত হােসেন ও আব্দুস সালাম খানকে সহ-সভাপতি, শামসুল হককে (টাঙ্গাইল) সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (তখন কারাবন্দি) যুগ্ম-সম্পাদক, খন্দকার মােশতাক আহমদ ও এ কে এম রফিকুল হােসেনকে সহসম্পাদক এবং ইয়ার মােহাম্মদ খানকে কোষাধ্যক্ষ করে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতাগণ শুরু থেকেই চিন্তা-চেতনায় ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। কিন্তু সে-সময়ে পাকিস্তানে বিরােধী দল গঠন ছিল খুবই কঠিন। শাসকগােষ্ঠীর নির্যাতন-নিপীড়ন ও অপপ্রচারের বিরুদ্ধে ঢাল হিসেবে দলের নামের সঙ্গে ‘মুসলিম’ শব্দ যুক্ত করা হয়েছিল। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনােত্তর রাজনৈতিক পরিবেশে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩শে অক্টোবর ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত তৃতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দ বাদ দিয়ে সবার জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর এর সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্তমানে ছাত্র ছাড়াও শ্রমিক, কৃষক, যুবক ও মহিলাদের মধ্যেও দলের সহযােগী সংগঠন রয়েছে।
বাঙালির স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবেই আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা। পরবর্তীকালে সর্ব পাকিস্তান পর্যায়ে এর একটি কমিটি ছিল বটে, কিন্তু তা ছিল কার্যত নামসর্বস্ব। শুরুতে আওয়ামী লীগ ৪২-দফাবিশিষ্ট একটি খসড়া ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করে, যার মূল দাবি ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইউনিট বা প্রদেশসমূহের জন্য পূর্ণ আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার। পাকিস্তান রাষ্ট্রের ২৩ বছরে এ দল যেসব দাবি নিয়ে অগ্রসর হয়, তার মধ্যে ছিল বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি, শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, সর্বজনীন ভােটাধিকার, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্ব, দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ ইত্যাদি। এসব দাবিতে আন্দোলন-সংগ্রামের ধারায় বড় ধরনের ঘটনার মধ্যে ছিল ‘৫২-র ভাষা-আন্দোলন, ‘৫৪-র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৬২-র আইয়ুব সরকারের শিক্ষানীতি বিরােধী আন্দোলন, ‘৬৬-র ৬-দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন, ‘৭১-এর মার্চের অসহযােগ আন্দোলন, পরিশেষে ‘৭১-এর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা। এ-সবের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন পাকিস্তান রাষ্ট্রের আসল চেহারা, বাঙালিদের প্রতি চরম বৈষম্য ও নির্যাতনমূলক আচরণ বা জাতিনিপীড়নের চিত্র প্রকাশ পায়, অপরদিকে তেমনি বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিসত্তার বিকাশ ও জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও ক্রমশ তীব্র হয়ে ওঠে।
বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনে ‘৪৮ ও ‘৫২-র ভাষা-আন্দোলন ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তানি শাসনপর্বে তা ধর্মভিত্তিক জাতীয় চেতনা বা দ্বিজাতিতত্ত্বের বিপরীতে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনার ভিত্তিভূমি রচনা করে। এই ভাষা-আন্দোলনের প্রথম পর্বে (১৯৪৮) পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের এবং দ্বিতীয় পর্বে (১৯৬২) ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। তাদের অনেকে কারারুদ্ধ হয়। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ছাত্র হত্যার পূর্বে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনে আওয়ামী লীগ মুখ্য ভূমিকা রাখে।
১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের কাছে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয় ঘটে। চারটি দল (আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলামী ও গণতন্ত্রী দল) নিয়ে গঠিত সরকারবিরােধী নির্বাচনি জোটের প্রধান শরিক ছিল আওয়ামী লীগ। এ দলের নেতৃত্বে ঐ জোট গঠিত হয়। একমাত্র আওয়ামী লীগ ছিল তখন সবচেয়ে সংগঠিত ও গণসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল। সরকারি দল মুসলিম লীগ-এর বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট (একুশদফা কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। এর মধ্যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ও পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ছিল মুখ্য। নির্বাচনে ২৩৭টি মুসলিম আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২৩ টি আসন লাভ করে। আওয়ামী লীগ এককভাবে লাভ করে ১৪৩টি আসন। মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন অর্জন করে। কিন্তু নির্বাচনােত্তর এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্ট সরকারকে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বেশিদিন ক্ষমতায় থাকতে দেয়নি। মাত্র ৫৬ দিনের মধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার ঐ সরকারকে বরখাস্ত করে। এরপর দেখা দেয় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঘন-ঘন সরকার পরিবর্তন। এরই এক পর্যায়ে ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে দুই বছরের মতাে ক্ষমতায় থাকার সুযােগ পেলে প্রথমেই ভাষাশহীদ পরিবারের জন্য আর্থিক অনুদান, ২১শে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি এবং পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ সরকারিভাবে উদ্যাপনের মতাে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রায় একই সময়ে বাঙালির প্রিয় নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ-রিপাবলিকান পার্টির কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। কিন্তু শাসকগােষ্ঠীর ষড়যন্ত্রের ফলে ১৩ মাসের ব্যবধানে ঐ মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। সােহরাওয়ার্দীর ঐ সরকার ছিল পাকিস্তানের ২৩ বছরের মধ্যে বাঙালিদের প্রতিনিধিত্বকারী একমাত্র সরকার। দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাঁর ঘােষণা কায়েমি স্বার্থান্বেষী মহলকে শঙ্কিত করেছিল এবং তা-ই ছিল তাঁর সরকারের পতনের প্রধান কারণ। এর ফলে বাঙালিদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।
সাংগঠনিকভাবে ১৯৫৭ সাল ছিল আওয়ামী লীগের জন্য বিপর্যয়ের কাল। বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে দলের মূলনেতা সােহরাওয়ার্দী ও সভাপতি মওলানা ভাসানীর মধ্যে মতবিরােধ দেখা দেয়। ১৯৫৭ সালের ৭-৮ই ফেব্রুয়ারি টাঙ্গাইলে ভাসানী আহুত দলের কাগমারি সাংস্কৃতিক সম্মেলনে তা প্রকাশ্য রূপ নেয়। সােহরাওয়ার্দী তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। তিনি পাশ্চাত্যের শক্তিশালী রাষ্ট্র বিশেষ করে আমেরিকার সঙ্গে জোটবদ্ধ বৈদেশিক নীতির পক্ষে ছিলেন। অপরদিকে মওলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে তাঁর বামঘেঁষা অনুসারিগণ ছিলেন জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে। সম্মেলন শেষে ১৮ই মার্চ মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ ও এর সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করেন। দলের ওয়ার্কিং কমিটির ৩৭ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জন তাঁকে সমর্থন করেন। পরিণামে ১৯৫৭ সালের ২৫-২৬শে জুলাই ঢাকার রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত এক কর্মী সম্মেলনে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের ঘােষণা দেন। তিনি এ দলের সভাপতি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এভাবে আওয়ামী লীগে আনুষ্ঠানিক ভাঙ্গন ঘটে। দলের ৩০ জন নির্বাচিত পরিষদ সদস্য ভাসানীর নতুন দলের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেন। দলের জন্য এটি ছিল একটি বড় ধরনের ধাক্কা। দলের এই সংকটময় মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। মাত্র নয় মাস মন্ত্রিত্ব করার পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কাজে পূর্ণকালীন সময় দেয়ার জন্য তিনি আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন (৩১শে মে ১৯৫৭)। মওলানা ভাসানীর শূন্যস্থানে মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশকে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নির্বাচিত করা হয়।
জেনারেল আইয়ুব খানের এক দশকের (১৯৫৮-১৯৬৯) শাসন আমলটি বাঙালিদের মধ্যে জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলে একে আরাে তীব্র করার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। প্রথমে একটানা প্রায় চারবছর সামরিক শাসন, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার ও নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্রে অযােগ্য ঘােষণা, তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের নামে জনগণের ভােটাধিকার হরণ, প্রকৃত গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি, ‘৬২-র আইয়ুবি শাসনতন্ত্রে বাঙালিদের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক সেনা-আমলা প্রভাবিত স্বৈরশাসন কায়েম, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে বৈষম্য আরাে বৃদ্ধি, বাংলা ভাষা-সংস্কৃতি বিরােধী ও বিদ্বেষী শাসকগােষ্ঠীর নতুন তৎপরতা ইত্যাদি বাঙালিদের মধ্যে চরম অসন্তোষ ছড়িয়ে দেয়। নানা ইস্যু ও দাবিতে আইয়ুববিরােধী নিরবচ্ছিন্ন কঠিন আন্দোলন গড়ে তােলার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে পেছনে ফেলে এ সময় রাজনীতির শীর্ষবিন্দুতে উঠে আসে এবং বাঙালির স্বার্থের একমাত্র প্ল্যাটফর্মে পরিণত হয়। ১৯৬২ সালের ৩০শে জানুয়ারি আইয়ুব সরকার কর্তৃক বাঙালির জনপ্রিয় নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে আকস্মিকভাবে গ্রেপ্তার আইয়ুবের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম আন্দোলনের সূচনা করে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় গণবিরােধী শরীফ শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট (১৯৬২) বিরােধী ছাত্র আন্দোলন। তীব্র ছাত্র আন্দোলনের কারণে সরকার সােহরাওয়ার্দীকে মুক্তি (আগস্ট ১৯৬২) দিতে এবং শিক্ষা কমিশন রিপাের্ট স্থগিত করতে বাধ্য হয়। ১৯৬২ সালে জেনারেল আইয়ুব পাকিস্তানের জন্য তাঁর ধ্যানধারণাপ্রসূত তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রভিত্তিক একটি শাসনতন্ত্র জারি করেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন দলের নয়জন শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা তাৎক্ষণিক সেটি প্রত্যাখ্যান করে একটি বিবৃতি দেন (২৪শে জুন), যা নয় নেতার বিবৃতি’ নামে পরিচিত। বিবৃতিদানকারী নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সহ-সভাপতি আতাউর রহমান খান। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তখনাে কারাগারে বন্দি। ১৯৬২ সালের ১৫ই জুলাই আইয়ুব সরকার রাজনৈতিক দল বিধির’ (Political Parties Act, 1962) আওতায় কতিপয় শর্তসাপেক্ষে রাজনৈতিক দল গঠন বা পুনরুজ্জীবনের অনুমতি প্রদান করে। কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর সােহরাওয়ার্দী রাজনৈতিক দলের পুনরুজ্জীবন না করে একটি গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের একদফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তােলার ব্যাপারে নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দের সমন্বয়ে আইয়ুববিরােধী রাজনৈতিক মঞ্চ ন্যাশনাল ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট (এনডিএফ) গঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে করতেন, এরূপ পাঁচমেশালি দলের ঢিলেঢালা জোট দিয়ে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন আদৌ সম্ভব নয়। ১৯৬৩ সালের ৫ই ডিসেম্বর সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য নতুন উদ্যোগ গ্রহণের সুযােগ এনে দেয়। মাত্র সাত সপ্তাহের ব্যবধানে ১৯৬৪ সালের ২৫শে জানুয়ারি তাঁর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে অনুষ্ঠিত দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য এবং দলের সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সভায় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৬৪ সালের ৬৮ই মার্চ ঢাকার গ্রিন রােডের আমবাগানে পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ সভাপতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দলের একটি ক্ষুদ্র অংশ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পুনরুজ্জীবনের বিপক্ষে অবস্থান নেয় এবং কিছুদিন এনডিএফ-এর মধ্যে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করে।
১৯৬৪ সালে কাশ্মীরের একটি মসজিদের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথমে ভারতে, তারপর পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। ঐ দাঙ্গা প্রতিরােধ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে নাগরিক সমাজের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরােনামে একটি প্রচারপত্রের লক্ষ-লক্ষ কপি ছাপিয়ে দেশের সর্বত্র বিলি করা হয়। এতে জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগে। ফলে দাঙ্গা আর বিস্তার লাভ করতে পারেনি। পরবর্তী বছর ২রা জানুয়ারি অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আইয়ুবের বিরুদ্ধে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রার্থী করে যে সম্মিলিত বিরােধী দল বা কপ গঠিত হয়েছিল, আওয়ামী লীগ ছিল তার অন্যতম শরিক। কপের দাবি অনুযায়ী নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর অঙ্গীকার ছিল রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থার স্থলে সংসদীয় গণতন্ত্র এবং আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের পরােক্ষ ভােটের স্থলে জনগণের সর্বজনীন ভােটাধিকার প্রতিষ্ঠা। প্রকাশ্য জনসভায় কপের প্রার্থীর পক্ষে বিপুল জনসমাগম হলেও পরােক্ষ পদ্ধতির নির্বাচন ব্যবস্থার কারণে ফাতেমা জিন্নাহ হেরে যান।
১৯৬৫ সালে ১৭ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাঙালিদের সম্পূর্ণ অরক্ষিত অবস্থা এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে সে রাষ্ট্রে ১৮ বছরের নানা অভিজ্ঞতা সম্মুখে রেখে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক আমাদের বাঁচার দাবী’ : ৬-দফা কর্মসূচি ঘােষণা করেন। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামাের মূলে কুঠারাঘাত হেনে বাঙালির জাতীয় মুক্তির আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তােলা। অন্য কথায়, এটি ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তিসনদ। ১৮-২০শে মার্চ ঢাকার ইডেন হােটেলে অনুষ্ঠিত দলের কাউন্সিল অধিবেশনে ছয়দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়। বঙ্গবন্ধু দলের সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ যেন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বের অগ্রিম প্রস্তুতি। স্মর্তব্য যে, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য গঠিত সরকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
১৯৬৬ সালের ৭ই জুন ৬-দফা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির (৬-দফা কর্মসূচি প্রচারকালে ৮ই মে তিনি গ্রেপ্তার হন) দাবিতে আওয়ামী লীগের আহ্বানে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। অনেকে পুলিশের গুলিতে হতাহত হন। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গণহারে গ্রেপ্তার করা হয়। সে সময়ে সৈয়দ নজরুল ইসলাম দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এবং আমেনা বেগম ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ৬-দফা কর্মসূচিভিত্তিক বাঙালিদের আন্দোলন দমনে আইয়ুব সরকারের নির্যাতন-নিপীড়নের আশ্রয় গ্রহণ এবং এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ৩৫ জন বাঙালি সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক আগরতলা মামলা” (১৯৬৮) দায়ের করলে দেশজুড়ে এক বিস্ফোরণােন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বাঙালির জাতীয় মুক্তির চেতনায় আসে গণজোয়ার। সংঘটিত হয় উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। আওয়ামী লীগ বাঙালির জাতীয় মুক্তির একক প্ল্যাটফরম বা মঞ্চে পরিণত হয়, আর আওয়ামী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থান ঘটে বাঙালির একমাত্র মুখপাত্র হিসেবে। নতুন সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অধীনে ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ৬-দফা কর্মসূচি নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়। আওয়ামী লীগের জন্য এই নির্বাচন ছিল ৬-দফার প্রশ্নে গণভােটতুল্য। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব বিজয় অর্জন করে। কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ১৬২টি আঞ্চলিক আসনের মধ্যে ১৬০টি (মহিলা আসন নিয়ে ১৬৯ টির মধ্যে ১৬৭ টি) আসন লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি (মহিলা আসনসহ ৩১০টির মধ্যে ২৯৮টি) আসনে বিজয়ী হয়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মােট ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ ও এর প্রধান বঙ্গবন্ধুকে সরকার গঠনের আমন্ত্রণের পরিবর্তে ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা নির্বাচনের রায় বাতিল ও বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করতে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেয়। আলােচনার নামে কালক্ষেপণ করে অস্ত্র ও সেনা-সদস্যদের পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসতে থাকে। এর প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান ও নির্বাচিত মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক অসহযােগ পালিত হয়। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) জাতির উদ্দেশে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র প্রতিরােধ সংগ্রামের আহ্বান জানিয়ে ভাষণের শেষে তিনি ঘােষণা করেন: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
এ-সময় পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার কার্যত আওয়ামী লীগের হাতে চলে আসে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশমতাে সবকিছু চলে বা বন্ধ হয়। এমনি এক অবস্থায় ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর সশস্ত্র আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে প্রেপ্তার হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু সরাসরি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। অতঃপর ১৯৭১ সালের ১০ই এপ্রিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ মিলিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি (বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি) এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে ৬-সদস্য বিশিষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠন করেন। তারা স্বাধীনতার একটি সাংবিধানিক ঘােষণাপত্রও প্রণয়ন ও প্রচার করেন। ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমা (বর্তমানে জেলা)-র বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রকাশ্য সভায় দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গঠিত এ সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা লাভ করে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
মুক্তিযুদ্ধোত্তরকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠন, ভারতে আশ্রয় নেয়া ১ কোটি বাঙালি শরণার্থীর পুনর্বাসন, মাত্র ১০ মাসের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর আড়াই মাসের ব্যবধানে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের ৪ শীর্ষ তথা জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হয়। ক্ষমতা দখলকারীদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ওপর নেমে আসে হত্যা, গ্রেপ্তার ও চরম নির্যাতন। এর ভেতরই ১৯৭৬ সালে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হয়। তবে কোনাে-কোনাে নেতা বের হয়ে পাল্টা দল গঠনের চেষ্টা করেন। ১৯৮১ সালে প্রবাসে থাকা অবস্থায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়া ও স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করার দিন থেকেই জাতির পিতার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয় জেনারেল জিয়া ও এরশাদের সেনা শাসন-নিয়ন্ত্রণ থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে তাঁর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠনে সক্ষম হয়। এরপর আরাে ৩ বার আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সুযােগ পায়। এসময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শের ধারায় ফিরিয়ে নেয়াসহ নানান ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার করা, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও রায় কার্যকর করা, নারীর ক্ষমতায়ন, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা, উগ্র জঙ্গিগােষ্ঠীকে কঠোর হস্তে দমন করা ও বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। আওয়ামী লীগ দেশের সবচেয়ে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী রাজনৈতিক দল। সারা দেশে এর রয়েছে অগণিত নেতা, কর্মী ও সমর্থক। ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, মহিলা এদের মধ্যে দলটির সহযােগী সংগঠন বা ইউনিট রয়েছে। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং অন্যান্য সম্পাদক ও সদস্য নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি ছাড়াও এর একটি প্রেসিডিয়াম ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি উপদেষ্টা মণ্ডলী রয়েছে। এ পর্যন্ত এ দলের ২১টি নিয়মিত কাউন্সিল ও ৬টি বিশেষ কাউন্সিল মােট ২৭টি কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে, অর্থাৎ গড়ে প্রায় ৩ বছরে একটি নিয়মিত কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। সময়ের পরিসরে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বহুলাংশে প্রতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে।
আওয়ামী লীগ এ দেশের রাজনীতিতে ৪টি মৌলিক আদর্শ (Core values) (বাঙালি) জাতীয়তাবাদ, শােষণমুক্তি, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে সৃষ্ট মূলধারার প্রতিনিধিত্বকারী দল। ফলে কোনােরূপ বিভাজন দলকে দুর্বল করতে পারেনি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাসহ এ দেশের জাতীয় জীবনে যা কিছুই শ্রেষ্ঠ অর্জন, তার সিংহভাগ কৃতিত্ব আওয়ামী লীগের। সমন্বয়, সমতা ও সম্প্রীতির নীতি ধারণ করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্রমাগত উদ্ভাবন ও রূপান্তর সাধন করে চলছে। [হারুন-অর-রশিদ]।
তথ্যসূত্র: হারুন-অর-রশিদ, মূলধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬, বাংলা একাডেমি ২০১৩; হারুন-অররশিদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’, সিরাজুল ইসলাম (সম্পাদিত) বাংলাপিডিয়া, ৯ম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, এশিয়াটিক সােসাইটি অব বাংলাদেশ, ঢাকা; Shyamali Ghosh, The Awami League 1949-1971, Dhaka 1990; আবু আল সাঈদ, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, ঢাকা ১৯৯৬

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!