You dont have javascript enabled! Please enable it!

আংড়ার ব্রিজ যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর)

আংড়ার ব্রিজ যুদ্ধ (পীরগঞ্জ, রংপুর) সংঘটিত হয় ১৬ই এপ্রিল। যুদ্ধে ২১ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৭টি রাইফেল ও একটি এলএমজি মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা পিছিয়ে গাইবান্ধায় যায়।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ ত্যাগকারী ইপিআর সদস্য আফতাব আলী (সুবেদার আলতাফ নামেও পরিচিত)-এর নেতৃত্বে প্রতিরােধযােদ্ধা এবং পাকবাহিনীর মধ্যে এ যুদ্ধ হয়। পলাশবাড়ী উপজেলার জসীম উদ্দিন, আবুল হােসেন, মতিয়ার রহমান, হাফিজার রহমান প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধা সরাসরি এ-যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ। সরকারের বিশেষ দূত এবং নর্থ জোনের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমানের নির্দেশনামূলক পরামর্শে এ-যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
৮ই মার্চ পলাশবাড়ী পিয়ারী উচ্চ বিদ্যালয়ে এক সর্বদলীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসান আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় তােফাজ্জল হােসেনকে আহ্বায়ক এবং ওমর ফারুক চৌধুরীকে সদস্য-সচিব করে হানাদার প্রতিরােধ কমিটি গঠন করা হয়।
এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরােধযােদ্ধারা পলাশবাড়ী আমবাগানে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এ রেজিমেন্ট এবং ছাত্র-জনতার প্রতিরােধে ১২ই এপ্রিল পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্ত হয় এবং তারা রংপুরে ফিরে যায়। ফিরে গিয়ে পাকসেনারা বাঙালি ক্যাপ্টেন রফিককে হত্যা করে। এর পরপরই সুবেদার আলতাফ তার অধীনস্থ বাঙালি সেনাদের নিয়ে পলাশবাড়ী হয়ে পীরগঞ্জ চলে আসেন। তাঁর নেতৃত্বে একটি বিশেষ বাহিনী গঠিত হয়, যা আলতাফ বাহিনী নামে পরিচিত ছিল। এ বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কে পলাশবাড়ী, মাদারহাট প্রভৃতি স্থানে বিভিন্নভাবে প্রতিরােধ সৃষ্টি করে পাকবাহিনীকে বাধাগ্রস্ত করে।
সুবেদার আলতাব পলাশবাড়ী-গাইবান্ধা-সাঘাটা অঞ্চলের বেশকিছু মুক্তিযােদ্ধাকে সঙ্গে নিয়ে রংপুর-বগুড়া মহাসড়কে পীরগঞ্জের আংড়ার ব্রিজ নামক স্থানে প্রতিরােধ যুদ্ধের স্থান নির্ধারণ করে সেখানে অবস্থান নেন। পশ্চিমে বড়বিলা ও পূর্বে আংড়ার বিলের সংযােগ খালের ওপর নির্মিত সেতু এবং রংপুর-বগুড়া মহাসড়কের বাঁকে শত্রুপক্ষকে সহজেই ঘায়েল করা সম্ভব। ব্রিজের কোল ঘেঁষে পশ্চিম প্রান্তে জেলেপাড়া, পেছনে বিশাল জলাশয়, আর পূর্ব প্রান্তেও বিশাল জলাশয়। জেলেপাড়ার অনিলের বাড়ি এবং পূর্বপাশের আকবর সেকেন্দারের বাড়িতে সুবেদার আলতাবের নেতৃত্বে। মুক্তিবাহিনী ও প্রতিরােধযােদ্ধারা ক্যাম্প স্থাপন করে পাক বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধ পরিচালনা করেন। এ-যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক মুক্তিকামী মানুষও অংশগ্রহণ করে। ১৫ই এপ্রিল সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে আংড়ার ব্রিজ ভেঙ্গে জাতীয় মহাসড়কে যােগাযােগ বিছিন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা না করে ব্রিজের দুপাশ কেটে পাকবাহিনীকে ফাঁদে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। সে অনুযায়ী পীরগঞ্জ, মাদারগঞ্জ, খালাশপীর, রাজারামপুর, রামনাথপুর ও পলাশবাড়ী অঞ্চলের প্রতিরােধযােদ্ধারা পার্শ্ববর্তী সাদুল্লাপুর, গাইবান্ধা ও সাঘাটা অঞ্চলের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সহযােগিতায় ব্রিজের উত্তর পাশ কেটে বিশাল গর্ত করা হয়। এতে বিপুল সংখ্যক মানুষ অংশগ্রহণ করে। এর পূর্বে পীরগঞ্জ বন্দরে ডা. ইদ্রিস আলীর বাসায় প্রস্তুতিমূলক গােপন মিটিং হয়। সার্বিক বিষয়ে আফতাব আলী ওরফে সুবেদার আলতাফ, সৈয়দ আলী, কাজী আ. হালীম, গাজী রহমান, গিয়াস উদ্দীন, কমরেড মােহাম্মদ হােসেন, আলিম মুক্তার, আজিজার রহমান, আ. সােবাহান বাদশা, আকবর হােসেন, সেকেন্দার আলী, আলতাফ মিয়া, বাদশা, অপিল উদ্দিন, জসিজল হক, রমজান আলী তালকুদার, মতিয়ার রহমান, আবুল কাশেম মিয়া, কাঞ্চন মহন্ত, সন্তোষ রায়, ডা. শামসুল হক, আবু হােসেন বিএসসি, কায়েম প্রধান, সােলায়মান সরকার, আবেদ আলী, মজিবর রহমান, বিজয় কুমার বিশু, আফের উদ্দিন, আ. মমিন আকন্দ, আবু তালেব মিয়া (পীরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান) প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৬ই এপ্রিল প্রতিরােধযােদ্ধারা ব্রিজের দুপাশে ১০০ গজ দূরে বাংকার খুন করে অস্ত্র তাক করে পজিশন নেন। রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকবাহিনীর গাড়ি বহর ব্রিজের নিকট পৌঁছামাত্র আলতাফ বাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। বেশ সময় ধরে উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলে। এক পর্যায়ে বিপর্যস্ত পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ-যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বে এমন যুদ্ধ বাঙালি জাতির অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় বহন করে। পাকবাহিনীর সুসজ্জিত পেশাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে এমন আক্রমণ তাদের চিন্তিত করে তােলে। তাই পরদিন ১৭ই এপ্রিল তারা ব্যাপক সেনা ও সাজোয়া যান নিয়ে পুনরায় আংড়ার ব্রিজে আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধযােদ্ধারা কৌশলগত কারণে পূর্বদিকে সরে গিয়ে মাদারগঞ্জ-মীরপুর অঞ্চলে শক্তিশালী প্রতিরােধ ব্যুহ তৈরি করে অবস্থান নেন। পাকবাহিনী আংড়ার ব্রিজের প্রতিরােধ ভেঙ্গে সম্মুখে অগ্রসর হলে মাদারগঞ্জ-মীরপুরে অবস্থানরত প্রতিরােধযােদ্ধাদের প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। প্রায় ২ হাজার জনতা দা, বল্লম ও লাঠি হাতে মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তায় এগিয়ে আসে। এখানকার যুদ্ধে মােট ২১ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৭টি রাইফেল ও একটি এলএমজি মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা পিছিয়ে গাইবান্ধায় যায়।
[লুৎফর রহমান সাজু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!