You dont have javascript enabled! Please enable it!

আঁদ্রে মারলাে (১৯০১-১৯৭৬) আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন ফরাসি দার্শনিক, ঔপন্যাসিক, শিল্প সমালােচক ও ফ্রান্সের সাবেক মন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। তিনি ১৯০১ সালের ৩রা নভেম্বর প্যারিসে জন্মগ্রহণ করেন। অল্প বয়সে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সমাপ্তি ঘটলেও মারলাে প্যারিসের বিখ্যাত সব গ্রন্থাগার, জাদুঘর ও শিল্পাঙ্গন থেকে নিজের সকল কৌতূহল ও জ্ঞানাকাঙ্ক্ষা নিবৃত করেন। বিদ্যায়তনের সনাতনী ব্যবস্থা নয়, বরং বৃহত্তর জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজস্ব চিন্তা ও দর্শনের ভিত্তি গড়ে তােলেন। সাহিত্য ও দর্শন চর্চায় যেমন তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন, তেমনি সমসাময়িক জাতীয় ও বৈশ্বিক রাজনীতি এবং সাম্রাজ্যবাদবিরােধী যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে আঁন্দ্রে মারলাে প্রাচীন শিল্পকর্মের সন্ধানে ইন্দোচিনের জঙ্গলে ঘুরে বেড়ান। ত্রিশের দশকে কিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কালে তিনি ফরাসি সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে জার্মানি-ইটালি-জাপান বা অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। এজন্য তিনি ব্রিটিশ ও ফরাসি উভয় সরকার কর্তৃক সম্মানিত হন। যুদ্ধের পর মারলাে প্রথমে দ্য গল সরকারের তথ্যমন্ত্রী এবং পরে সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭১ সালে আঁদ্রে মারলাে বাংলাদেশের পক্ষে স্পষ্ট ও সক্রিয় অবস্থান গ্রহণ করেন। তিনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে বাংলাদেশে আসার ইচ্ছা ব্যক্ত করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে পত্র লেখেন। তাঁর এ অবস্থান সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্যাপক আলােড়ন সৃষ্টি করে। যুদ্ধে অংশ নেয়ার অনুমতি না পেলেও তিনি নিজের লেখা, বক্তৃতা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ ও স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে নিজের দৃঢ় অবস্থান অব্যাহত রাখেন।
১৯৭১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকে লেখা এক চিঠির মাধ্যমে মারলাে বাংলাদেশের পক্ষে ও পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান তুলে ধরেন। একই চিঠিতে তিনি বিশ্বব্যাপী মুক্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে তাঁর অকুণ্ঠ ও দৃঢ় সমর্থন ব্যক্ত করেন। ঐ চিঠিতে মারলাে লেখেন: মি. নিক্সন, পাকিস্তানি বর্বর সামরিক জান্তাকে রক্ষা করতে এবং মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে খতম করতে আপনার পাঠানাে মার্কিন বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘এন্টারপ্রাইজ’ কোলকাতাকে বিপন্ন করতে পারলেও এখানে অবস্থানরত এক কোটি বাঙালি শরণার্থীর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারবে না। নিঃসন্দেহে আপনারা বিশ্বের পরাক্রমশালী রাষ্ট্র। কিন্তু মনে রাখবেন, আপনার এ অমিত শক্তি নগ্নপদ ভিয়েতনামীদের পরাস্ত করতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষকেও পারবে না। দুনিয়ার কোনাে মুক্তিপাগল জাতিকে কোনাে শক্তিই পরাজিত করতে পারে না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের পক্ষে আঁদ্রে মারলাের সুদৃঢ় অবস্থান আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক ইতিবাচক সাড়া জাগায়। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালে তাঁকে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ (মরণােত্তর) প্রদান করে। ১৯৭৬ সালের ২৩শে নভেম্বর তিনি প্যারিসে মৃত্যুবরণ করেন। [জালাল আহমেদ]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!