You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুক্তিযুদ্ধে অভয়নগর উপজেলা

অভয়নগর উপজেলা (যশাের) ১৯৭১ সালের মার্চের শুরুতে এ উপজেলায় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শাহ্ হাদিউজ্জামান এবং আগরতলা মামলার অন্যতম আসামি ও রাজঘাট কার্পেটিং জুট মিলসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (অব.) শওকত আলীর (পরবর্তীতে কর্নেল) নেতৃত্বে গঠিত হয় জয়বাংলা সশস্ত্র রেজিমেন্ট। ২রা মার্চ নওয়াপাড়া শংকরপাশা হাইস্কুল মাঠে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন নওয়াপাড়া কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি স ম মােশারফ হােসেন ও জিএস আব্দুল মালেক। ৭ই মার্চ একই স্থানে জয়বাংলা সশস্ত্র রেজিমেন্টের ডাকে হাজার-হাজার লােকের সমাবেশ ঘটে। এদিন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ পরের দিন শুনে তারা উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ১৪ই মার্চ আওয়ামী লীগ অফিসের সামনে অসংখ্য মানুষের উপস্থিতিতে থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মােকছেদ আলী ফারাজী পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে দেন। এভাবেই অভয়নগর উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু হয়। ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকসেনাদের নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার পর উপজেলার নেতৃবৃন্দ সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণে উদ্যোগী হন। ২৭শে মার্চ সকালে সাত ট্রাক পাকসেনা যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে খুলনার উদ্দেশে রওনা হয়। অভয়নগরের নেতৃবৃন্দ এ খবর জানতে পারেন। তাই পাকসেনারা যাতে অভয়নগরে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য পূর্বাচল জুট মিলসের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মাে. কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে শতশত লােক উপজেলার ভাঙ্গাগেট ও বেঙ্গল টেক্সটাইল মিলস সংলগ্ন রেলক্রসিংয়ে রেলের ওয়াগন ও ইঞ্জিন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ভাঙ্গাগেট থেকে রেলক্রসিং পর্যন্ত যশাের-খুলনা মহাসড়কের প্রায় তিন কিলােমিটার জুড়েও কাঠের গুঁড়ি দিয়ে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করা হয়। এরপর পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য সকাল ১০টায় একটি সভার আয়ােজন করা হয়। সভা চলাকালে ট্রাকভর্তি পাকসেনারা ভাঙ্গাগেটে এসে বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তারা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির অভিযােগে মাে. কামরুজ্জামানকে বেদম প্রহার করে এবং পার্শ্ববর্তী গ্রাম থেকে লােকজনদের ধরে এনে প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে নিতে বাধ্য করে। সকাল ১১টার দিকে রেলক্রসিং পার হয়ে পাকসেনারা নওয়াপাড়া রেলস্টেশনে প্রবেশ করে এবং রেলের ওয়াগন ও ইঞ্জিন দিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করায় ৯ জন রেলকর্মীকে হত্যা করে। এ ঘটনা ‘নওয়াপাড়া রেলস্টেশন গণহত্যা’ নামে পরিচিত। এরপর পাকসেনারা নওয়াপাড়া বাজারে প্রবেশ করতে গেলে তাদের বাধা দেয়া হয়। তখন তাদের গুলিতে থানা আওয়ামী লীগের সহ-সম্পাদক নজিবর রহমান ও শ্রমিক নেতা বাবর আলী বিশ্বাসসহ ১৬ জন মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষ শহীদ হন। অভয়নগরের ইতিহাসে এ ঘটনা নওয়াপাড়া বাজার গণহত্যা নামে পরিচিত। হত্যার পাশাপাশি পাকসেনারা নওয়াপাড়া বাজারে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং নওয়াপাড়া টেলিফোন এক্সচেঞ্জটি দখল করে নেয়। এরপর তারা খুলনা চলে যায়। পরের দিন ২৮শে মার্চ খুলনা থেকে ফিরে এসে অভয়নগরের শিল্পাঞ্চল নওয়াপাড়ায় পুরােপুরি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু কোনাে ক্যাম্প স্থাপন না করে তারা যশাের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যায়। নভেম্বরে তারা কার্পেটিং জুট মিলসে ক্যাম্প স্থাপন করে।
এপ্রিলের প্রথম দিকে যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়। এজন্য নেতৃবৃন্দ বেশ কয়েকটি সভাও করেন। সভায় যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য ছাত্র-যুবকদের ভারতে পাঠানাের সিদ্ধান্ত হয় এবং ১১ই এপ্রিল ৬৯ জনের একটি দল ভারতে যায়। তারা ভারতের বিভিন্ন সামরিক ঘাঁটিতে প্রশিক্ষণ নেয়। এছাড়া তারা গেরিলা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে ভারতের উত্তরখণ্ডের রাজধানী দেরাদুনের টান্দুয়া, আসামের হাফলং, বিহারের চাকুলিয়া ক্যাম্পে এবং দেশের অভ্যন্তরেও অনেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এ উপজেলায় মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকের দায়িত্ব পালন করেন কর্নেল শওকত আলী, শাহ্ হাদিউজ্জামান, মােকছেদ আলী ফারাজী, আব্দুল মালেক, স ম মােশারফ হােসেন, ছাদেক আলী, নুরুল হক মােল্যা, এম এম আমিন উদ্দিন, প্রণব। কুমার সুর, আব্দুল ওয়াদুদ মােল্যা প্রমুখ। উপজেলায় স্বাধীনতাবিরােধী দল ও সংগঠন হিসেবে মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী, শান্তি কমিটি, আলবদর বাহিনী ও রাজাকার বাহিনী সক্রিয় ছিল। মুসলিম লীগের নেতা ছিল মকবুল হােসেন মােল্যা, খােরশেদ আলী সরদার, মহর আলী মােল্যা, নওশের আলী মােল্যা ও ছবেদ আলী এবং নেজামে ইসলামীর নেতা খাজা আব্দুল সাঈদ শাহ্ (মেঝ হুজুর)-এর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি গঠিত হয়। আলবদর বাহিনীর নেতা ছিল কবির হােসেন। রাজাকার বাহিনীর নেতা ছিল কবির মােড়ল, ছবদুল হােসেন, জাফর আহমেদ, হাসান আলী মােড়ল, কসাই জাফর আহমেদ, আক্কাস বিশ্বাস, আকাম আলী মােল্যা ও হাসেম আলী মােল্যা। এরা প্রথমে ছাত্রলীগ অফিস দখল করে রাজাকার বাহিনীর ক্যাম্প তৈরি করে। পরে ওয়াপদা ভবন এবং নওয়াপাড়া বাজারের নূরবাগে রহমান মােল্যার বাসভবনে আস্তানা গড়ে তােলে। এসব জায়গা থেকে তারা উপজেলার স্বাধীনতাবিরােধীদের সংগঠিত করে।
নওয়াপাড়ায় ভৈরব নদের তীরে অবস্থিত ওয়াপদা ভবন ছিল। রাজাকার – আলবদরদের নির্যাতনকেন্দ্র ও বন্দিশিবির। উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে এখানে নির্যাতন করা হতাে। তারপর তাদের চোখ বেঁধে ভৈরব নদের পাড়ে নিয়ে গুলি ও জবাই করে হত্যা করা হতাে। হত্যার স্থানটি ভৈরব নদের পাড় বধ্যভূমি নামে পরিচিত। স্বাধীনতাবিরােধীরা উপজেলার বিশেষত হিন্দুদের বাড়ি-ঘরে ব্যাপক লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযােগ করে।
মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ৭ই ডিসেম্বর পাকসেনারা যশাের ছেড়ে অভয়নগরের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় নেয়। একথা জানতে পেরে ৮ই ডিসেম্বর কমান্ডার আব্দুল মালেক ও স ম মােশারফ হােসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি দল ভৈরব নদের উত্তর-পূর্ব পাশ দিয়ে এবং মেজর এম এ জলিলের নেতৃত্বে আরেকটি দল টেকা নদী পার হয়ে তাদের আক্রমণ করে। আক্রমণের মুখে পাকসেনা ও তাদের দোসররা পিছু হটে এবং খুলনা অভিমুখে পালিয়ে যায়। পরের দিন ৯ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তিযােদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে-দিতে নওয়াপাড়া শংকরপাশা মাধ্যমিক বিদ্যালয় মাঠে সমবেত হন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। এভাবেই শত্রুমুক্ত হয় অভয়নগর উপজেলা।
অভয়নগর উপজেলার শহীদ মুক্তিযােদ্ধারা হলেন- আব্দুল বারিক শেখ (পিতা সৈয়দ আলী শেখ, গুয়াখােলা; কৃষক), ফজলুল করিম (মাগুরা, কৃষক), বাবর আলী বিশ্বাস (পিতা গােলাম আলী বিশ্বাস, রাজঘাট; কার্পেটিং জুট মিলসের শ্রমিকনেতা), নজিবর রহমান (পিতা বাসেদ আলী, নওয়াপাড়া; পূর্বাচল জুট মিলসের শ্রমিক), ইশারত আলী (পিতা হাজী খােশাল শেখ, ধুলগ্রাম; মৎস্যজীবী), নিজাম উদ্দিন খান (পিতা মােহাম্মদ নূর খান, দেয়াপাড়া; কৃষক), নিতাই চন্দ্র মল্লিক (আড়াপাড়া, কৃষক) ও মহসিন আলী (জিয়াডাঙ্গা, কৃষক)। উপজেলায় মুক্তিযােদ্ধাদের স্মরণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নওয়াপাড়া রেলস্টেশনের দক্ষিণ পাশে নির্মিত হয়েছে একটি স্মৃতিসৌধ। নওয়াপাড়া গ্রামে অবস্থিত প্রাথমিক বিদ্যালয়টির নতুন নামকরণ করা হয়েছে শহীদ নজিবর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এছাড়া অভয়নগর পৌরসভার একটি সড়কের নাম ‘শহীদ নজিবর সড়ক’ এবং অপর একটি সড়কের নাম ‘শহীদ আব্দুল বারিক সড়ক’ রাখা হয়েছে। (মাসুদ আলম)

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!