অপারেশন ওমেগা
অপারেশন ওমেগা লন্ডনভিত্তিক একটি বেসরকারি সাহায্য সংস্থা। বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানাে, বিপদাপন্ন মানুষের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও তাদের সাহায্যার্থে জনমত গঠনসহ অন্যান্য তৎপরতা চালানাে ছিল তাদের প্রধান কাজ। পল কনেট নামে ব্রিটেনের একজন শিক্ষক, তাঁর আমেরিকান স্ত্রী এলেন কনেট ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী মেরিয়েটা প্রকোপ প্রমুখ ছিলেন এর প্রধান উদ্যোক্তা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু বাঙালির একটি ন্যায়ভিত্তিক গণতান্ত্রিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠা বা জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই-ই ছিল না, তা বিশ্বমানবতার জন্য এক বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী শুধু নির্বিচার গণহত্যাই চালায়নি, তারা ও তাদের এদেশীয় দোসররা শহর-বন্দরগ্রাম, হাট-বাজার সর্বত্র সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি পর্যন্ত লুটপাট শেষে অগ্নিসংযােগ করে তা ভস্মীভূত করে দেয়। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ প্রাণ রক্ষার্থে জলস্রোতের মতাে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে যেতে থাকে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে এদেশের এক কোটি বিপন্ন মানুষ (মােট জনসংখ্যার প্রায় এক-সপ্তমাংশ) সে দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করে। যারা ভারতে যেতে পারেনি, তারা দেশের অভ্যন্তরে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। এরূপ অভ্যন্তরীণ বাস্তুভিটাচ্যুত মানুষের সংখ্যাও ছিল অগণিত। যােগাযােগ ব্যবস্থা ধ্বংস বা বিপর্যস্ত হওয়া এবং জীবনের চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশের অভ্যন্তরে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দেয়। অপরদিকে, ভারতের পক্ষে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয়দান ও তাদের খাদ্যের সংকুলান ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। এর ওপর জুনজুলাই মাসে একদিকে প্রবল বন্যা-বৃষ্টি, অপরদিকে মহামারী আকারে কলেরার প্রাদুর্ভাব শরণার্থী শিবিরগুলােতে চরম মানবেতর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। মৃত্যু ঘটে হাজার-হাজার শিশু, বৃদ্ধ ও অন্যান্য আশ্রিতদের।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর এপ্রিল মাসে লন্ডনের ৭টি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘একশন বাংলাদেশ’ নামে একটি প্লাটফর্ম গঠন করে। এর মধ্যে পিস নিউজ, দ্য ইয়ং লিবারালস, অপারেশন ওমেগা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর কর্মীরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ জনগােষ্ঠী ও ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য ত্রাণ ও মানবিক সাহায্য প্রেরণ, বাংলাদেশ থেকে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী প্রত্যাহার, পাকিস্তান সরকারকে কোনােরূপ সাহায্য-সহায়তা না করা ইত্যাদি। বিষয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্য উপায়ে জনমত গঠন এবং ব্রিটিশ পালিয়ামেন্ট ও পাকিস্তান এইড কনসাের্টিয়ামএর সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ ও সভা-সমাবেশের আয়ােজনের মাধ্যমে একই দাবি তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে অন্তত ছয়বার ওমেগা মিশন পাকিস্তান সামরিক সরকারের কোনােরূপ পূর্বানুমতি না নিয়ে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। তাঁদের বেশ কয়েকজনকে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা গ্রেপ্তার করে ফেরত পাঠায়। অক্টোবর মাসে মিসেস এলেন কনেট ও গর্ডন স্ল্যাভেন নামে অপর একজন ওমেগা কর্মী অনুরূপ মিশন নিয়ে যশাের সীমান্ত দিয়ে পাকিস্তানিদের দখলকৃত এলাকার মধ্যে প্রবেশ করলে তাদের গ্রেপ্তার করে যশাের কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। মুক্তিবাহিনী ও ভারতের মিত্রবাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর হাতে ৭ই ডিসেম্বর যশাের শহরের পতন হলে তারা মুক্তি লাভ করেন। বন্দি হওয়ার সময় মিসেস এলেন কনেট অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ১৯৭২ সালে পল কনেট ও এলেন কনেট দম্পতির একটি পুত্র সন্তান ভূমিষ্ঠ হলে তার নাম রাখা হয় পিটার উইলিয়াম মুজিব কনেট।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে একশন বাংলাদেশ ও অপারেশন ওমেগা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে পাকিস্তান বাহিনীর দখলকৃত এলাকায় বিনা অনুমতিতে ওমেগা ত্রাণ মিশনের সদস্যদের প্রবেশ এবং সৈন্যদের হাতে তাঁদের গ্রেপ্তার বরণ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রচারে গুরুত্বসহকারে স্থান পায়। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অপারেশন ওমেগার পল কনেট ও মিসেস এলেন কনেট-কে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘ফ্রেন্ডস অব লিবারেশন ওয়ার’ এওয়ার্ডে ভূষিত করা হয়। [হারুন-অর-রশিদ]।
তথ্যসূত্র: Harun-or-Rashid, British perspectives, pressures and publicity regarding Bangladesh, 1971′, Contemporary South Asia 1995, Oxford, 4(2), 139-149; The Guardian (London), 8 October 1971; Ibid., 8 December 1971
সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড