You dont have javascript enabled! Please enable it! মুক্তিযুদ্ধকালে অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ও দুঃসাহসিক কমান্ডাে অভিযান অপারেশন জ্যাকপট - সংগ্রামের নোটবুক

অপারেশন জ্যাকপট

অপারেশন জ্যাকপট ছিল মুক্তিযুদ্ধকালে অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ও দুঃসাহসিক এক কমান্ডাে অভিযান। নৌকমান্ডােরা ছিলেন আত্মঘাতী দলের সদস্য। তারা ১৪ই আগস্ট রাত ১২টার পর অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট একযােগে চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ নদী ও সমুদ্র বন্দর এবং ১৬ই আগস্ট দাউদকান্দি নদী বন্দরে দুঃসাহসিক অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি শত্রুপক্ষের মােট ২৬টি জাহাজ, গানবােট, বার্জ, ফেরি ধ্বংস ও নিমজ্জিত করে দেন। এ ঘটনা বিশ্বের সকল গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয় এবং সর্বমহলে সাড়া জাগায়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ছিল শতভাগ সফল অভিযান। এর ফলে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনী ও পাকিস্তান সরকার নাজুক অবস্থায় পতিত হয়। এ অপারেশন পরিচালনায় একদল নৌ-কমান্ডাে গড়ে তােলার পেছনে ছিল কমান্ডােদের গভীর দেশপ্রেম, ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ সহযােগিতা, সুনিপুণ পরিকল্পনা, কঠিন প্রশিক্ষণ আর রূপকথার মতাে কাহিনী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুধু স্থল পথে নয়, নৌ-পথেও সংঘটিত হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নৌ-সেনা দলের আবশ্যকতা ছিল অপরিহার্য। পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর পক্ষ ত্যাগ করে ফ্রান্স থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকারী ৮ জন বাঙালি সাবমেরিনারকে নিয়ে মে মাসের মাঝামাঝি সর্বপ্রথম একটি নৌ-কমান্ডাে বাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর অনেক সদস্য বিদেশে দায়িত্বরত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কিছু সংখ্যক বাঙালি কর্মকর্তা ও নাবিকও ছিলেন। এভাবে ফ্রান্সের তুলো পােতাশ্রয়ে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীর সাবমেরিন ম্যানগ্রোতে ১৩ জন বাঙালি সাবমেরিনার কর্মরত ছিলেন। সাবমেরিনটি ১৯৭০ সালের ৫ই আগস্ট ফ্রান্সে কমিশন করা হয়। বাঙালি সাবমেরিনার ও নাবিকরা সেখানে প্রশিক্ষণকালে দেশে বিরাজমান গণআন্দোলনের দিকে তীক্ষ দৃষ্টি রাখছিলেন।
২৫শে মার্চ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড শুরু হলে ফরাসি পত্রিকা লা মন্ডে ও বিবিসি সহ বিদেশী প্রচার মাধ্যমে সে সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালি সাবমেরিনাররা দেশে গণহত্যার কথা জেনে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে গােপনে আলাপআলােচনা চালাতে থাকেন। পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য মন থেকে সম্পূর্ণ উঠে যায়। ইতােমধ্যে বাংলাদেশে প্রতিরােধ যুদ্ধের সংবাদ এবং সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের খবর জানতে পেরে সাবমেরিনে অবস্থানরত ১৩ জন বাঙালি সাবমেরিনারের মধ্যে ৯ জন সরাসরি দেশে ফিরে মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে জাহাজ ত্যাগ করতে সম্মত হন। তাঁরা হলেন- আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী (বীর উত্তম, বীর বিক্রম; কমােডর), আহসান উল্লাহ (পরবর্তীতে বীর প্রতীক), আবদুর রকিব মিয়া (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও বীর বিক্রম), আবিদুর রহমান (পরবর্তীতে বীর বিক্রম), বদিউল আলম (পরবর্তীতে বীর উত্তম), আমানুল্লাহ শেখ (পরবর্তীতে বীর বিক্রম), সৈয়দ মাে. মােশারফ হােসেন, গাজী মাে. রহমতউল্লাহ (পরবর্তীতে বীর প্রতীক) এবং আবদুল মান্নান। এঁদের মধ্যে আবদুল মান্নান (ইলেকট্রিক্যাল সাবমেরিনার; জেলা সিলেট) দলচ্যুত হয়ে লন্ডনে আত্মীয়-স্বজনের কাছে চলে যান। বাকি ৮ জন সাবমেরিনার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ২৯শে মার্চ ফ্রান্স থেকে সুইজারল্যান্ড, আবার ফ্রান্স, সেখান থেকে স্পেন এবং ভারতীয় দূতাবাসের সহায়তায় স্পেন থেকে ইতালি হয়ে অবশেষে ১০ই এপ্রিল বােম্বে (বর্তমান মুম্বাই) বিমান বন্দরে এসে পৌছাতে সক্ষম হন। এঁরা ছিলেন বিদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রথম সাবমেরিনার ভারতীয় নৌ-বাহিনীর প্রধান এস এম নন্দা, কমান্ডার শর্মা, গােয়েন্দা কর্মকর্তা রায় চৌধুরী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম এ জি ওসমানী ফ্রান্স থেকে আগত এ ৮ জন সাবমেরিনারকে নিয়ে একটি নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। প্রথমে তাঁদের ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় দিল্লির পার্শ্ববর্তী যমুনা নদীতে এপ্রিলমে মাসে দুই সপ্তাহের নৌ-প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সে-সময় লক্ষ্যবস্তু ডিমােলিশনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে তাদেরকে দিল্লির কুতুব মিনারে নিয়ে যাওয়া হতাে। এরপর ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী পলাশীর একটি দুর্গম এলাকায় নৌ-কমান্ডােদের স্থায়ী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। এর সাংকেতিক নাম ছিল ‘সি-২-পি’। ভারতীয় নৌ-বাহিনীর কমান্ডার এম এন সামন্ত ছিলেন নৌ-কমান্ডােদের প্রশিক্ষণ ও অভিযানের সমন্বয়ক লে. কমান্ডার জি মার্টিস ছিলেন ক্যাম্পের সার্বক্ষণিক পরিচালক। এদিকে বাংলাদেশ সরকার-এর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ-এর সভাপতিত্বে জুন মাসে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে যুদ্ধ পরিস্থিতির সার্বিক বিশ্লেষণ করে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীনে যুদ্ধ অঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে লক্ষ্যে জরুরিভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ােজিত কমান্ডারদের সমন্বয় সভা আয়ােজন করার জন্য কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়। ১১ই জুলাই থেকে ১৭ই জুলাই পর্যন্ত মুজিবনগরে উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের এরূপ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে বাংলাদেশের সব যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে প্রত্যেকটির জন্য একজন অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি নিয়মিত বাহিনী গঠন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। একই বৈঠকে নদীমাতৃক বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রপথে পাকিস্তানের যােগাযােগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া এবং অভ্যন্তরীণ জলপথে শত্রুবাহিনীর পরিবহণে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা ও শত্রুবাহিনীর অপ্রতিরােধ্য অগ্রাসনের মূলে আঘাত হানার লক্ষ্য নিয়ে নৌকমান্ডাে বাহিনী গড়ে তােলার ওপর গুরুত্বারােপ করা হয়। জলপথের যুদ্ধ ছিল ১০নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত। এ সেক্টর ছিল কর্নেল এম এ জি ওসমানীর সরাসরি নিয়ন্ত্রণাধীন। অপারেশন জ্যাকপট পরিচালনার পূর্বে মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী ক্যাম্পে নৌ-কমান্ডােদের আড়াই মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের টাকি, বক্সনগর, হাতিমারা, মেলাঘর, অম্পিনগর, কাঁঠালিয়া, হরিণা যুবশিবির ইত্যাদি ক্যাম্প থেকে বিশেষ করে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সংগ্রহ করা হয়। তাদের অধিকাংশই ছিল ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, ফরিদপুর, বরিশাল, খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের। ফলে সাঁতারের ব্যাপারে তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। এভাবে প্রায় ৫শ নৌকমান্ডােকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তাদের প্রশিক্ষক ছিলেন ভারতীয় নৌ-বাহিনীর লেফটেন্যান্ট এস কে দাশ, লেফটেন্যান্ট কপিল, জুনিয়র অফিসার কে সিং, চমন সিং, কুন্দন সিং, লাল সিং, গুপ্তবাবু, পরিমল ভট্টাচার্য, নানাবুজ এবং ফ্রান্স থেকে আগত ৮ জন বাঙালি সাবমেরিনার।
প্রশিক্ষণ কার্যক্রম ছিল খুবই কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে সাঁতারকাটা, দীর্ঘ সময় পানির নিচে ডুবে থাকা, ফিনস পায়ে সাঁতার, পানির নিচ দিয়ে শুধু নাক ভাসিয়ে দীর্ঘ সাঁতার, নাক ভাসিয়ে চিৎ হয়ে সাঁতার, কীভাবে পানির নিচে মাইন স্থাপন ও বিস্ফোরণ ঘটানাে হয় তা, শরীরের সঙ্গে গামছা দিয়ে ৪-৫ কেজি ওজনের ভারী বস্তু বেঁধে সাঁতারকাটা, শত্রুর জাহাজে লিমপেট মাইন স্থাপন, লিমপেট মাইনে ডেটোনেটর ফিট করা, জাহাজে মাইন লাগানাের পূর্বে এর তলদেশে চাকু বা অন্য ধাতব্যবস্তু দ্বারা শেওলা পরিষ্কার করা, মাইন বসানাের পর সেফটি পিন খুলে নিয়ে আসা ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত ছিল। স্বল্প সময়ের মধ্যে এসব প্রশিক্ষণ গ্রহণের প্রয়ােজনে প্রশিক্ষণার্থীদের দৈনিক গড়ে ১৮ ঘণ্টা প্রশিক্ষণ কর্মে নিয়ােজিত থাকতে হয়। অত্যন্ত গােপনীয়তার সঙ্গে প্রশিক্ষণ কার্য পরিচালনা করা হয়।
এভাবে অপারেশন জ্যাকপট শুরুর পূর্বে প্রায় ৫শ নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং ফ্রান্স থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকারী ৮ জন সাবমেরিনার ও বাংলাদেশের বিভিন্ন নৌ-বন্দরে কর্মরত আরাে ৮ জন নাবিক নিয়ে মােট ৫১৫ জনের একটি সুদক্ষ নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গড়ে ওঠে। এঁরা ছিলেন দেশের জন্য আত্মােৎসর্গীকৃত সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য।
১৫ই আগস্ট একযােগে চট্টগ্রাম, মংলা সমুদ্র বন্দর এবং চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ নৌ-বন্দর ও ১৬ই আগস্ট দাউদকান্দি নদী বন্দরে পাকিস্তানি শত্রু জাহাজে নৌ-কমান্ডাে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়, যার সাংকেতিক নাম ছিল ‘অপারেশন জ্যাকপট’। এর সার্বিক পরিকল্পনা ও দায়িত্বে ছিলেন ভারতের ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং। অত্যন্ত সুনিপুণভাবে অপারেশনটির পরিকল্পনা করা হয়। প্রতিটি স্থানে অপারেশনের জন্য (দাউদকান্দি ব্যতিত) গঠিত নৌ-কমান্ডাে গ্রুপের কমান্ডার বা অধিনায়ক হিসেবে ফ্রান্স থেকে পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে যােগদানকারী সাবমেরিনারদের মধ্য থেকে একজনকে নিযুক্ত করা হয়। গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রার পূর্বে তাদেরকে নদী বন্দরের অবস্থা, নদী ও সমুদ্র বন্দরের স্রোতের গতি, শত্রুসৈন্যের অবস্থান ও শক্তি, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার সম্ভাব্য নিরাপদ পথ, পথ প্রদর্শক, শেল্টারের ঠিকানা, নিরাপত্তা সাহায্য, অপারেশনের পূর্ব প্রস্তুতি ও অপারেশন শুরুর সাংকেতিক নির্দেশনা ইত্যাদি সম্বন্ধে ব্রিফ করা হয়। এছাড়া প্রত্যেক কমান্ডারের হাতে একটি করে মানচিত্র ও ট্রানজিস্টার দেয়া হয়। অপারেশনের সংকেত হিসেবে দুটি গান নির্দিষ্ট করা হয়। পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে গানদুটি হলাে- ‘আমি তােমায়। যত শুনিয়েছিলেম গান’ এবং আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি। আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্রের সকাল ও বিকেল বেলার অধিবেশনে ভিন্ন-ভিন্ন দিনে গানদুটি বাজানাের কথা। প্রথমটি দ্বারা ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে অপারেশনের প্রস্তুতি গ্রহণ এবং দ্বিতীয়টি দ্বারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে চূড়ান্ত অপারেশন শুরু বুঝানাে হয়। চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি অপারেশনের নৌ-কমান্ডােদের জন্য ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা শহরের অদূরে বিএসএফ ক্যাম্পের নিকটবর্তী স্থানে ‘নিউ ক্যাম্প’ নামে একটি ট্রানজিট পয়েন্ট স্থাপন করা হয়। ১লা আগস্ট এসব কমান্ডােরা উল্লিখিত স্থানে অপারেশনের উদ্দেশ্যে পলাশী ক্যাম্প ত্যাগ করেন। ভারতীয় সামরিক বিমানে তাঁদের আগরতলা ‘নিউ ক্যাম্প’-এ আনা হয়। সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর তাঁদেরকে ১নং সেক্টর কমান্ডার। মেজর রফিকুল ইসলামের হরিণা ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। অতঃপর মাইনসহ প্রয়ােজনীয় অপারেশন সামগ্রী দিয়ে ১০ই আগস্ট ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং ও মেজর রফিক গন্তব্য স্থানের উদ্দেশে কমান্ডােদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠান। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর অপারেশন বাংলাদেশের পূর্বাংশে পাহাড় বেষ্টিত বঙ্গোপসাগরের তীর ঘেঁষে চট্টগ্রাম জেলা অবস্থিত। জেলার গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলী। পূর্ব পাড়ে রয়েছে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি। চট্টগ্রাম বন্দর কর্ণফুলী নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান সমুদ্র থেকে অনেকটা ভেতরে। নিকটেই নৌ-বাহিনীর ঘাটি। ফলে প্রথম দিকে প্রতিরােধ। যুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বন্দর অভিমুখে তেমন কোনাে অভিযান। পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে পাকসেনাদের আক্রমণ প্রতিরােধ এবং তাদের খাদ্য ও রসদ সরবরাহ বন্ধ করতে বন্দর অচল করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে নৌ-কমান্ডাে অপারেশন পরিচালনা খুবই গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল পাকিস্তান নৌবাহিনীর ৪টি গানবােটসহ অনেকগুলাে টহল নৌ-যান। শতাধিক অফিসারের অধীনে ২০০০ নাবিক ও ক্রু সেখানে মােতায়েন ছিল। তাছাড়া বন্দরের নিরাপত্তা সুরক্ষার জন্য ৯৭ পদাতিক ব্রিগেডের অতিরিক্ত ১ কোম্পানি সৈন্য বন্দরের পূর্ব (চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি এলাকা) ও পশ্চিমাংশে নিয়ােজিত করা হয়। তাদের সহযােগিতায় ছিল স্থানীয় রাজাকার ও আলবদরসদস্যরা। এমনি নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে নৌকমান্ডােদের অস্ত্র ভাণ্ডারসহ শহরের ওপর দিয়ে কর্ণফুলী নদী অতিক্রম করে বন্দরের পূর্বে আনােয়ারা ও পশ্চিমে পটিয়ায় (বর্তমান কর্ণফুলী উপজেলা) পৌছতে হয়, যা ছিল এক দুঃসাহসিক অভিযান।
অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় ১৫ই আগস্ট চট্টগ্রাম বন্দর। অভিযানের জন্য সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, বীর উত্তম, বীর বিক্রম-এর নেতৃত্বে ৬০ জন চৌকস কমান্ডাের একটি দল নিযুক্ত করা হয়। অপারেশনের স্বার্থে তিনি ২০ জন করে কমান্ডাে নিয়ে তাঁর দলটিকে ৩টি গ্রুপে ভাগ করেন। প্রত্যেক গ্রুপের দায়িত্ব একজন সমন্বয়কের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এভাবে ৩ গ্রুপের ৩ জন সমন্বয়ক হলেন ডা. শাহ আলম, বীর উত্তম, মাজহারুল্লাহ, বীর উত্তম ও আব্দুর রশিদ। তাঁরা ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম সীমান্ত থেকে ১০ই আগস্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করে নিরাপত্তার দায়িতে নিয়ােজিত মুক্তিযােদ্ধা ও স্থানীয় গাইডদের সহায়তায় কয়েক রাত দীর্ঘ ও ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি, কোথাও কর্দমাক্ত পথ পায়ে হেঁটে ও নৌকায় চড়ে ছাগলনাইয়া-ফেনী-মিরসরাই হয়ে দুটি গ্রুপ মিরসরাইয়ের দক্ষিণে চট্টগ্রাম অভিমুখী সমিতির হাটে পৌছে সেখানে (প্রথমে বদিউল আলমের ও পরে পাল বাড়ি) আশ্রয় নেয়। সেখান থেকে ঝুড়ির ভেতর মাইন ও অন্যান্য অস্ত্র রেখে তার ওপর শাক-সবজি, তরিতরকারি দিয়ে ঢেকে গাড়ি (কার), যাত্রীবাহী বাস এবং চট্টগ্রামের বিদ্যুৎ বিভাগের প্রকৌশলীর লাইন মেরামতের গাড়িসহ পিকআপে করে তা চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে আসা হয়। নৌ-কমান্ডােরাও ২-৩ জন। করে পৃথক-পৃথক যাত্রীবাহী বাস ও পিকআপে করে চট্টগ্রাম শহরে পৌঁছে যান। এটি ছিল খুবই দুঃসাহসিক ও দুঃসাধ্য, কেননা কিছুদূর পরপরই ছিল পাকিস্তানি সেনাদের চেকপােস্ট। ২০ জনের একটি কমান্ডাে গ্রুপ পাকহানাদার বাহিনীর প্রতিরােধে সীতাকুণ্ডে আটকা পড়ে। ফলে তারা অপারেশনে অংশ নিতে পারেননি।
একই দিন বিকেলে অপারেশনের দলনেতা এ ডব্লিউ চৌধুরী চট্টগ্রাম শহরের ও. আর নিজাম রােডের এনায়েত মওলার বাসা কাকলী’-তে কমান্ডাে খােরশেদ আলম ও ডা. শাহ আলমসহ এসে ওঠেন। অন্যান্য কমান্ডােরা ভাগ-ভাগ করে শহরের বিভিন্ন শেল্টারে ওঠেন। ঐদিন সকালে সীতাকুণ্ড থাকাকালে আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে অপারেশন প্রস্তুতির সংকেতস্বরূপ ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলেম’ গানটি তাঁরা শুনতে পান। একই দিন সন্ধ্যায়ও গানটি পুনঃপ্রচারিত হয়। কাকলীর শেল্টার থেকে পানওয়ালাপাড়ার সবুজবাগে আবদুল হাই সরদারের বাড়িতে এ ডব্লিউ চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহম্মদ (মৌলভী সৈয়দ নামে পরিচিত), কমান্ডাে খােরশেদ আলম ও ডা. শাহ আলম অপারেশন পরিকল্পনা নিয়ে এক গােপন বৈঠক করেন। উল্লেখ্য, আবদুল হাই সরদারের সবুজবাগের বাড়িটি ছিল কন্টাক্ট পয়েন্ট ও মৌলভী সৈয়দের বাড়িটি গােপন শেল্টার বা বেইজ। ঐ বৈঠক শেষে এ ডব্লিউ চৌধুরী অপর দুই কমান্ডােসহ এনায়েত মওলার ও. আর নিজাম রােডের বাড়িতে ফিরে আসেন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। এদিকে অপারেশনের জন্য ভারত থেকে সঙ্গে করে আনা লিমপেট মাইনগুলাে প্রথমে আবদুল হাই সরদারের সবুজবাগ বাড়িতে এবং সেখান থেকে নিরাপত্তার স্বার্থে পরে ইসহাক এমপিএ-র কাছারি ঘরে এবং সেখান থেকেও সরিয়ে হােন্ডা প্লেসের মালিক নুরুল ইসলামের বিধবা নানীর নির্জন বাড়িতে রাখা হয়।
পরের দিন ১৪ই আগস্ট মৌলভী সৈয়দ (সবুজবাগের প্রধান বেইজ কমান্ডার), আবু সাইদ সরদার (বেইজ কমান্ডার), মঈনউদ্দীন খান বাদল (বেইজ কমান্ডার), জালাল উদ্দিন আহম্মদ (বেইজ কমান্ডার), মাে. হারিছ (বেইজ কমান্ডার), জানে আলম (মুক্তিযােদ্ধা), কমান্ডাে খােরশেদ আলম, আবু সিদ্দিক সরদার (মুক্তিযােদ্ধা ও আবু সাইদ সরদারের সহােদর), মােহাম্মদ ইউনুস (মুক্তিযােদ্ধা) এবং চট্টগ্রামের অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থকদের সহায়তায় জীবনের সর্বপ্রকার ঝুঁকি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের একের পর এক চেকপােস্ট অতিক্রম করে মাইন ও অন্যান্য অস্ত্রসহ অপারেশন সামগ্রী কর্ণফুলী নদীর বাংলা বাজারঘাট (পূর্বের পাকিস্তান বাজারঘাট) দিয়ে অপর পাড়ে চরলক্ষ্যা ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ শুরু হয়। মাইন ও অন্যান্য অস্ত্র ঝুড়িতে ভরে পূর্বের ন্যায় শাক-সবজি, তরিতরকারি দিয়ে ঢেকে সাজানাে হয়। অপরদিকে কমান্ডােরা লুঙ্গি, ছেঁড়া গেঞ্জি বা শার্ট পড়ে কাঁধে গামছা ঝুলিয়ে শ্রমিকের বেশ ধারণ করেন। অস্ত্র ও কমান্ডােদের বাংলা বাজারঘাটে পৌছাতে বিদ্যুৎ লাইন মেরামতে ব্যবহৃত মই ঝুলানাে বিদ্যুৎ বিভাগের দুটি পিকআপ ও অন্য গাড়ি ব্যবহার করা হয়। ছদ্মবেশ ধারণ করায় পাকসেনাদের নিরাপত্তার চেকপােস্ট এড়ানাে সম্ভব হয়। এভাবে মুটে আর মজুরের বেশে বাংলা বাজারঘাট থেকে খেয়া নৌকা ও সাম্পানে করে কর্ণফুলী নদীর পূর্ব পাড়ে চরলক্ষ্যা শেল্টারে অস্ত্রসহ কমান্ডােরা পৌছতে সক্ষম হন।
১৪ই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস থাকায় সেদিন পাকসেনারা সর্বোচ্চ নিরাপত্তামূলক সতর্কতা অবলম্বন করে। তাই ঐদিনের পরিবর্তে ১৫ই আগস্টকে চূড়ান্ত অপারেশনের দিন হিসেবে নির্ধারণ করা হয়। ১৪ই আগস্ট আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে সকালে ও বিকেলে চূড়ান্ত অপারেশন পরিচালনার সংকেত স্বরূপ পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’ গানটি দুবার বাজানাে হয়। এবার অপারেশনের অধিনায়ক সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী ৪০ জন কমান্ডাের মধ্যে ৭ জনকে অস্ত্রসহ নিরাপত্তার দায়িত্বে রেখে ১১টি শত্রুজাহাজ, গানবােট, বার্জ ও কার্গো টার্গেট করে প্রতিটির জন্য ৩ জন কমান্ডাে নিযুক্ত করে রাত ১২টার পরপর অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট তিনি স্বয়ং এবং অন্যরা সাঁতার কেটে লিমপেট মাইন নিয়ে অপারেশনে নেমে পড়েন। রাত আনুমানিক ১টা পর্যন্ত অপারেশন চলে। নির্দিষ্ট প্রতিটি টার্গেটে ৩টি করে লিমপেট মাইন সফলভাবে স্থাপন করে তারা সকলেই সাঁতরে নিরাপদ আশ্রয়ে ফিরে আসতে সক্ষম হন। কমান্ডােরা নদীতে থাকা অবস্থায়ই একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা সঙ্গে-সঙ্গে গুলি ছােড়ে। কিন্তু অপারেশনে নিয়ােজিত সকল কমান্ডােই অক্ষত থাকেন। কিছু সময়ের মধ্যেই প্রচণ্ড শব্দে বাকি মাইনগুলাের বিস্ফোরণ শুরু হয়। পাকহানাদাররা হতবিহ্বল হয়ে দিকভ্রান্তের মতাে নদীর দুই কিনারে গুলি চালাতে ও সাইরেন বাজাতে থাকে। এদিকে একের পর এক জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান পানিতে নিমজ্জিত হয়। অপারেশনে এমভি আল আব্বাস, এমভি হরমুজ, বার্জ ওয়ারেন্ট, নেভির দুটি গানবােটসহ মােট ৯টি টার্গেট ধ্বংস প্রাপ্ত হয়। বন্দরের পন্টুনও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপারেশনে অংশগ্রহণকারী ৪০ জন কমান্ডাে (নিরাপত্তা দায়িত্বে নিয়ােজিত ৭ জনসহ) হলেন- কমােডর আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, বীর উত্তম, বীর বিক্রম, ডা. শাহ আলম, বীর উত্তম (পিতা এম আলী আহমদ চৌধুরী), মাযহার উল্লাহ, বীর উত্তম (পিতা মাে. আজব, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), এমদাদ হােসেন মতিন (পিতা সফিউল্লাহ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), খােরশেদ আলম, বীর প্রতীক (পিতা হাজী মােহাম্মদ ছাদত আলী, খুলশী, চট্টগ্রাম), নুরুল হক, বীর প্রতীক (পিতা সামছুল হক, বহদ্দারহাট, চট্টগ্রাম), এস এন মাওলা, বীর প্রতীক (পিতা ডা. এস এম মাওলা, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম), এ এইচ এম জিলানী চৌধুরী (পিতা বুজরুছ আলম চৌধুরী, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), মাে. আনােয়ার মিয়া (পিতা ঠান্দু মিয়া, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম), প্রকৌশলী এম এ বশর (পিতা হাজী মাে. সামছুল হক, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), আবু বক্কর ছিদ্দিক (পিতা আবুল বশর, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), জয়নাল আবেদীন কাজল (পিতা নাদেরুজ্জামান, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), সেলিম বাঙালী (পিতা ইয়াকুব আলী, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), বদিউল আলম শাহ (পিতা বজল আহমেদ শাহ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম), মহিব উল্লাহ (পিতা আবদুল করিম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম), কালাম আহমেদ (পিতা সৈয়দ আহমদ, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম), এম এ কামাল (পিতা হাজী সুলতান আহমদ, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম), আবু মুসা চৌধুরী (পিতা সুলতান আহমেদ চৌধুরী, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম), নুরুল ইসলাম চৌধুরী (পিতা এম এ চৌধুরী, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), খায়রুল বশর (পিতা ছালেহ আহমেদ, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম), নুরুল গণি (পিতা মাে. ইলিয়াছ মাস্টার, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম), সিরাজ-উদ-দৌলা (পিতা আহমেদ সােবহান মিস্ত্রী, মিরসরাই, চট্টগ্রাম), গিয়াস উদ্দিন (পিতা নুরুল হুদা, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম), বশির উল্লাহ (পিতা হাজী বাদশা মিয়া, ছাগলনাইয়া, ফেনী), বিধান বিশ্বাস (পিতা কুঞ্জ বিহারী বিশ্বাস, মুকসুদপুর, গােপালগঞ্জ), সত্যেন নাথ বিশ্বাস (পিতা জনার্দন বিশ্বাস, মুকসুদপুর, গােপালগঞ্জ), অরুণ কুমার ভট্টাচার্য (পিতা সুধীর কুমার ভট্টাচার্য, মনিরামপুর, যশাের), আবুল হােসেন (পিতা এ রহমান গাজী, কালকিনি, মাদারীপুর), শওকত আলী (পিতা মামদার বিশ্বাস, মহেশপুর, ঝিনাইদহ), গফুর খান (পিতা আ. সাত্তার খান, চরমুগুরিয়া, মাদারীপুর), গােলাম মােস্তফা (পিতা আজিজুর রহমান মােল্লা, কাশিয়ানী, গােপালগঞ্জ), প্রকৌশলী ফজলুল হক (পিতা মাে. আব্দুর রাজ্জাক, মতিহার, রাজশাহী), সাজেদুল হক চনু (পিতা আলিম উদ্দিন আহমদ, নিউটাউন, মাদারীপুর), হাবিবুল হক খােকন (পিতা আলহাজ্ব সায়েম উদ্দিন আহমদ, নিউটাউন, মাদারীপুর), সাইদুর রহমান মনু (পিতা এম মজিদ মিয়া, কমলাপুর, ফরিদপুর), গােলাম রাব্বানী (পিতা মুন্সী নূর মােহাম্মদ, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর), এম এ রহিম (পিতা আলী বক্স বেপারী, ভেদরগঞ্জ, শরীয়তপুর), এ হােসেন (পিতা এম এ বারিক, দেবীদ্বার, কুমিল্লা), হেলাল উদ্দিন আহমদ (পিতা নুরুল ইসলাম, সােনাগাজী, ফেনী), মহিউদ্দিন (পিতা মনসুর আহমদ, মিরসরাই, চট্টগ্রাম)। অপারেশনের পরের দিন সকাল থেকে পাকহানাদার বাহিনী কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে আনােয়ারা ও পটিয়া থানায় নৌকমান্ডােদের খোঁজে গ্রামের পর গ্রামে কম্বিং অপারেশন চালায়। তাতে শত্রুবাহিনীর হেলিকপ্টারও যােগ দেয়। কিন্তু ইতােমধ্যে সফল অপারেশন শেষে নৌ-কমান্ডােরা চট্টগ্রাম শহরে ফিরে এসে তাঁদের শেল্টারে আশ্রয় নিতে সক্ষম হন। এবং রাত্রিযাপন না করে একই রুট দিয়ে বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে ভারতের গন্তব্যস্থলে ফিরে যান। পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে হানাদাররা কয়েকটি গ্রাম সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দেয়, অনেককে হত্যা করে এবং নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
ভারত সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের পর থেকে শুরু করে আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন নৌকমান্ডােদের গাইড বা পথ প্রদর্শক, অস্ত্রসহ কমান্ডােদের গন্তব্যে পৌছানাে, যানবাহন যােগান, অস্ত্র সংরক্ষণ, কমান্ডােদের শেল্টারদান, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, অপারেশনস্থল রেকি, অপারেশনকালে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন এবং অপারেশন শেষে কমান্ডােদের শহরে নিরাপদ স্থানে ফিরে আসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে অনেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলেন- চট্টগ্রাম জেলার বিএলএফ কমান্ডার এস এম ইউসুফ, চট্টগ্রাম শহর বিএলএফ কমান্ডার আব্দুল্লাহ আল হারুন, চট্টগ্রাম শহর গেরিলা কমান্ডার মৌলভী সৈয়দ (কমান্ডােদের সহযােগিতায় সার্বিক দায়িত্ব পালন), কমান্ডাে খােরশেদ আলম, বীর প্রতীক ও নূরুল হক, মুক্তিযােদ্ধা আবু সাইদ সরদার (সবুজবাগ, পানওয়ালাপাড়া; অপারেশনস্থলের শেল্টারে মাইন পৌছানােসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালন), জালাল উদ্দিন আহম্মদ, মােহাম্মদ ইউনুস (সিটি কলেজের ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা), আবু সিদ্দিক সরদার (আবু সাইদ সরদারের সহােদর; অপারেশনস্থলের শেল্টারে মাইন পৌছাতে ভূমিকা), খাজা সামছুল আবেদীন বাবুল, ইস্টার্ন রিফাইনারীর প্রকৌশলী আজিজুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী, ওয়াপদার মেইনটেন্যান্স বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আলতাফ হােসেন (পিকআপ সরবরাহকারী), শাহ আলম (ইছাখালী, মিরসরাই), নুর মােহাম্মদ (ভাটিয়ারী), জানে আলম (সীতাকুণ্ড; চট্টগ্রাম শাহীন বিরানী হাউসের মালিক), সীতাকুণ্ডের সলিমপুরের মাে. নাদের, কবির আহমদ, সালেহ আহমদ, মাে. ইউসুফ (মাইন সাম্পান থেকে ওঠানাে), সীতাকুণ্ডের দাউদ ও লােকমান (মাইন চট্টগ্রাম শহরে পৌছাতে সহায়তা)। বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ে চরলক্ষ্যার অপারেশন শেল্টার পর্যন্ত যারা কমান্ডােদের অস্ত্রসহ আশ্রয়দানে সহায়তা করেন বা যেসব শেল্টারে কমান্ডােরা আশ্রয়গ্রহণ করেন- ডা. ফয়েজ আহমদ (সীতাকুণ্ড), বশির মাস্টার (সীতাকুণ্ড), নুরুল আলম (সীতাকুণ্ড), বদিউল আলমের বাড়ি (সমিতির হাট), মমতাজ মহল (আগ্রাবাদ), নাসিরাবাদ এলাকায় এনায়েত মওলা ও তাঁর স্ত্রীর বাড়ি কাকলী’ (ও.আর নিজাম রােড), আবদুল হাই সরদারের বাড়ি (সবুজবাগ, পানওয়ালাপাড়া), ইসহাক এমপিএ-র বাড়ি, হােন্ডা প্লেসের মালিক নুরুল ইসলাম (হাজীপাড়া), নুরুল ইসলামের বিধবা নানীর নির্জন বাড়ি (বেপারীপাড়া), নুর মােহাম্মদ মিন্ডি, কমান্ডাে খােরশেদ আলমের বাড়ি নাহার মঞ্জিল, চকবাজার কবির সওদাগরের বাড়ি, বিদ্যুৎ বিভাগের শিক্ট ইনচার্জ আবু তাহের, বকসু মিয়া ড্রাইভার, আবদুল বারেক ড্রাইভার, নূর আহমদ ড্রাইভার (কমলদহ বাজার), রুবি প্লাইউডের নুরুল হুদা, চরলক্ষ্যায় রফিক সওদাগরের খামার বাড়ি, কালামিয়া সওদাগরের বাড়ি, ইব্রাহিম সওদাগরের বাড়ি, সামছুন নাহার বেগম, সুফিয়া খাতুন, ইসমাইল কুতুবী প্রমুখ।

মংলা সমুদ্র বন্দর অপারেশন
মংলা বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে সমুদ্র উপকূল ও সুন্দরবনের গা ঘেঁষে বৃহত্তর খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমা (বর্তমান জেলা)-র পশুর নদীর তীরবর্তী স্থানে মংলা বন্দর অবস্থিত। মংলা বন্দরের ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে সুন্দরবন। মংলার দক্ষিণপশ্চিমে বাংলাদেশ ও ভারত জুড়ে সুন্দরবনের বিস্তৃতি। মংলার অবস্থান খুলনার দক্ষিণে। দূরত্ব ৪৬ কিমি। বাংলাদেশ ও ভারতের এ অঞ্চল জুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদ-নদী। এর মধ্যে কতগুলাে খুবই বিশাল। অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় ১৫ই আগস্ট চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের পাশাপাশি একই সময়ে মংলা সমুদ্র বন্দরে মুক্তিযােদ্ধা নৌ-কমান্ডাে বাহিনী এক দুর্ধর্ষ অভিযান চালিয়ে পাকিস্তানি শত্রুপক্ষের বেশকিছু জাহাজ ও অন্যান্য নৌযান ধ্বংস করে দেয়। আলােচ্য নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন সাবমেরিনার আহসান উল্লাহ, বীর প্রতীক। তিনি ছিলেন ৮ জন বাঙালি সাবমেরিনারের অন্যতম যারা ফ্রান্সে পাকিস্তানের কমিশনপ্রাপ্ত ম্যানগ্রো সাবমেরিনে দায়িত্বরত থাকা অবস্থায় পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এরপর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বিভিন্ন দেশ হয়ে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতের সহায়তায় দেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডাে বাহিনীতে যােগ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফ্রান্স থেকে প্রত্যাগত অন্য সাবমেরিনারদের সঙ্গে তিনিও প্রথমে দিল্লির নিকটবর্তী যমুনা নদীতে ২ সপ্তাহের নৌ-কমান্ডের ট্রেনিং গ্রহণ করেন।
অতঃপর ভারতীয় নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনা ও তত্ত্বাবধানে মুর্শিদাবাদ জেলার ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশী নামক এক নির্জন স্থানে নৌকমান্ডােদের একটি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আগস্ট মাসে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অপারেশন জ্যাকপট নামে নৌ-কমান্ডাে অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্তক্রমে তাঁকে প্রধান করে ৬০ জন প্রশিক্ষিত নৌ-কমান্ডােকে মংলা সমুদ্র বন্দর অপারেশনে পাঠানাে হয়। তাঁদের ৫টি দলে বিভক্ত করে প্রত্যেকটি দলকে একজন উপ-দলনেতার অধীনে ন্যস্ত করা হয়। ৫ জন উপ-দলনেতা ছিলেন শেখ মহসীন আলী, মুজিবর রহমান, খলিলুর রহমান, ইমাম বারী ও আ. গফফার। আগস্টের ৪ তারিখ এঁদের সকলকে কলকাতার ব্যারাকপুর সেনানিবাসে আনা হয়। সেখান থেকে পরের দিন খিদিরপুর হয়ে ডায়মন্ড হারবারের কাছাকাছি ক্যানিং নৌ-বন্দরে পৌছানাে হয়। সেখানে সুন্দরবন অঞ্চলের ম্যাপ ও অপারেশনের বিস্তারিত বিষয় শেষবারের মতাে তাঁদের বুঝিয়ে দেয়া হয়। ৬ই আগস্ট ৫টি ছইযুক্ত বড় দেশী নৌকায় তাঁরা গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভয়াল মান্দ্রা নৌ-মােহনা, শিবসা পয়েন্ট, হিরণ পয়েন্ট, জেফার্ড পয়েন্ট অতিক্রম করে ভারত সীমান্তে অবস্থিত হিঙ্গলগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধীন কৈখালী মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প হয়ে সুন্দরবনের আঁকাবাঁকা ছােট নদী বেয়ে ১২ই আগস্ট তাঁরা খুলনা জেলার দক্ষিণে কয়রা থানাধীন কালাবগি গ্রামে এসে পৌঁছেন। পরের দিন মংলার অদূরবর্তী সুতারখালী গ্রামে এসে তারা অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করেন। সমগ্র যাত্রাপথে নিরাপত্তার জন্য তাঁদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক গেরিলা যােদ্ধা ছিলেন। অপারেশন স্থলটি ৯নং সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, লে. মাহফুজ আনাম, সাব-সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন বেগ, সুন্দরবন সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. (পরবর্তীতে মেজর) জিয়াউদ্দিন নৌ-কমান্ডােদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করেন। গাইড হিসেবে খুলনার মুক্তিযােদ্ধা খিজির আলী, বীর বিক্রম, আফজাল ও আনােয়ার এবং দুর্গম সুন্দরবন অঞ্চলের যাতায়াত ব্যবস্থা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অভিজ্ঞ রয়েজুদ্দিন নামে বরিশাল অঞ্চলের একজন নৌ-মাঝি মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। অপারেশনের পূর্বে ও পরে স্থানীয় লােকজন নৌ-কমান্ডােদের সর্বাত্মক সহযােগিতা ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য, নৌ-কমান্ডােদের সুতারখালী গ্রামে পৌঁছার পূর্বে হিরণ পয়েন্টে অভিযান পরিচালনার লক্ষ্যে লে. জিয়াউদ্দিন ও ১২ জন কমান্ডাে মূল দল থেকে আলাদা হয়ে যান। ফলে মংলা অপারেশনের জন্য ৪৮ জন কমান্ডাে রয়ে যান।
মংলায় পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কোনাে ঘাঁটি ছিল না। তা ছিল খুলনায়। মার্চ মাসে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তারা মংলা বন্দরের নিরাপত্তা রক্ষায় গানবােট ও নৌযানে কামান বসিয়ে যুদ্ধের উপযােগী করে সেখানে মােতায়েন করে। পাকিস্তানিদের অস্ত্র ও রসদ সরবরাহে মংলা পাের্ট ব্যবহৃত হতাে।
১৩ই আগস্ট সুতারখালী অস্থায়ী ঘাঁটিতে বসে অধিনায়ক আহসান উল্লাহ আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে অপারেশনের প্রস্তুতি সংকেত হিসেবে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলেম’ গানটি শুনতে পান। সঙ্গে-সঙ্গে তারা অপারেশনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। একদিন পর ১৪ই আগস্ট একই বেতার কেন্দ্র থেকে শত্রু টার্গেটে চূড়ান্ত আঘাত হানার সংকেত ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’ গানটি বাজানাে হয়। জোয়ার-ভাটার হিসেবে কিছুটা গড়মিল হওয়ায় তারা সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। এরপর নৌকা যােগে স্রোতের বিপরীতে যখন তারা মংলা বন্দরের অপর পাড়ে বানিয়াসান্তা নামক গ্রামে গিয়ে পৌছেন, তখন প্রায় ভােররাত। দ্রুত তারা কোমরে লিমপেট মাইন, পায়ে ফিস এবং সুইমিং কস্টিউমস পড়ে এক্সপ্লোসিভ, ছুড়ি ইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে সেখান থেকে টার্গেটের উদ্দেশে পশুর নদীতে নেমে পড়েন। দলের অধিনায়ক সাবমেরিনার আহসান উল্লাহ নিজেও লিমপেট মাইন নিয়ে অপারেশনে নেমে যান। বন্দরে জাহাজ ও অন্যান্য নৌযানগুলাে ছিল বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে। একাধিক দলে বিভক্ত হয়ে কমান্ডােরা মাইন নিয়ে এগিয়ে যান। পশুর নদীতে তখন ছিল বড়বড় ঢেউ। অন্যদিকে শত্রুপক্ষের গানবােট ও জাহাজের সার্চলাইটের আলাে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। এরই মধ্যে তাদেরকে অপারেশন সম্পন্ন করতে হয়।
মংলা অপারেশনে যেসব নৌ-কমান্ডাে অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন- সাবমেরিনার মাে. আহসান উল্লাহ, বীর প্রতীক, নাবিক আব্দুল মালেক, মুস্তাফিজুর রহমান, মুজিবুর রহমান, আফতাব উদ্দিন, সিরাজুল ইসলাম, ইমাম বারী, যােয়াদুর রসুল বাবু, আমিনুর রহমান, জি এম এ রহিম, আলাউদ্দিন আহমেদ, খলিলুর রহমান, শেখ মহসীন আলী, সুবােধ, এমদাদুল হক, আলফাজ উদ্দিন, আব্দুস সেলিম, এবাদুল ইসলাম, প্রফুল্ল কুমার মিস্ত্রী, আরজ মিয়া, অনিল কুমার, মহেন্দ্র নাথ, আ. হামিদ, দিলীপ কুমার, বিশ্বনাথ পালিত, রফিকুল ইসলাম, সৈয়দ আক্রাম, এম মােস্তাফা, আব্দুল কুদ্দুস, আক্রাম হােসেন, জহুরুল হক, রইছউদ্দিন, শফিক আহমদ, আব্দুল কাদির (পুলিশ), খলিলউল্লাহ, মফিজ উদ্দিন, বিল্লাল হােসেন মৃধা, আ. হাশেম, এনামুল হক, শাহজাহান আলম, জোবেদ আলী, সামসুর রহমান, শাহ আলম, সামসুল আলম, বশিরউল্লা, আলমগীর শিকদার প্রমুখ। কিছু সময় না যেতেই শুরু হয় বিকট শব্দে একের পর এক মাইন বিস্ফোরণ। এতে ৮-১০টি জাহাজ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে নদীতে নিমজ্জিত হয়। তবে হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড পত্রিকার ভাষ্যমতে ৬টি সমুদ্রগামী জাহাজ (২টি আমেরিকান, ২টি চাইনিজ, ১টি জাপানি ও ১টি পাকিস্তানি) ধ্বংস হয়। এসব জাহাজে করে পাকিস্তানিরা অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ও রসদ আনছিল। এছাড়া একটি ব্রিটিশ কার্গো শিপও আক্রমণের শিকার হয়। পাকিস্তানি সেনারা উদ্ভ্রান্ত হয়ে এলােপাতাড়ি মেশিনগানের গােলা ছুড়তে থাকে। বানিয়াসান্তা গ্রামসহ পার্শ্ববর্তী একাধিক গ্রাম তারা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। যাকে যেখানে পেয়েছে হত্যা করেছে। নারীদের গানবােটে তুলে নিয়ে গেছে। এদিকে নৌ-কমান্ডােদের অপারেশনের ফলে মংলা বন্দরে জাহাজ চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কিছুদিনের বিরতি দিয়ে পুনরায় সেখানে কমান্ডােদের নৌঅভিযান চলে। প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখে জাহাজে মাইন লাগিয়ে ফিরে আসার সময় কমান্ডােগণ বিছিন্ন হয়ে পড়েন। আগেপিছে করে অবশেষে তারা মংলা বন্দর থেকে দূরে কামারখােলা গ্রামের একটি স্কুলে এসে জড়াে হতে সক্ষম হন। সেখান থেকে নৌকায় করে তারা সুতারখালী অস্থায়ী ঘাঁটিতে ফিরে আসেন। এরপর নিরাপত্তার কথা ভেবে অধিনায়ক আহসান উল্লাহ অধিকাংশ কমান্ডােদের নিয়ে ভারতের পলাশী ক্যাম্পে প্রত্যাবর্তন করেন। তবে ৭ জনের একটি কমান্ডাে দল পাকিস্তানি সেনাদের এম্বুশের মধ্যে পড়ে তাদের হাতে বন্দি হন। তাঁদের মধ্যে আফতাব উদ্দিন ও সিরাজুল ইসলাম চরম নির্যাতনের ফলে শহীদ হন। বাকিরা সেপ্টেম্বর মাসে যশাের সেনানিবাস থেকে পালিয়ে গিয়ে পুনরায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। মংলা বন্দরের এ নৌ-কমান্ডাে অপারেশন বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বসহকারে প্রচারিত হয়।

চাঁদপুর নদী বন্দর অপারেশন
চাদপুর (বর্তমান জেলা) ছিল কুমিল্লার অন্তর্গত একটি মহকুমা। প্রমত্তা মেঘনা থেকে উঠে আসা ডাকাতিয়া নদীর মােহনায় চাদপুর বন্দরের অবস্থান। ডাকাতিয়া নদীটি চাদপুর শহরকে ভেদ করে পূর্ব দিকে প্রবাহিত। চাঁদপুর বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী বন্দর। এখান থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, ফরিদপুর, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ, ভােলাসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় নৌপথে যােগাযােগের ব্যবস্থা রয়েছে। এ রুটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিযুদ্ধকালে অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ও খাদ্যসামগ্রী আনা-নেয়া করত। তাই বাংলাদেশ সরকারের জন্য এখানে অপারেশন পরিচালনা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ১৫ই আগস্ট চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরের মতাে চাঁদপুর নৌ-বন্দরেও বাঙালি নৌ-কমান্ডােদের দ্বারা অপারেশন জ্যাকপট পরিচালিত হয়। তাতে শত্রুপক্ষের বেশ কয়েকটি জাহাজ ও নৌযান ধ্বংস হয়।
অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় চাঁদপুরে উল্লিখিত নৌকমান্ডাে অভিযান পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন সাবমেরিনার বদিউল আলম, বীর উত্তম। তিনি ফ্রান্সে পাকিস্তানি সাবমেরিন ম্যানগ্রো পরিত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগকারী আরাে ৭ জন বাঙালি সাবমেরিনারের সঙ্গে জীবনের চরম ঝুঁকি নিয়ে ইউরােপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে অবশেষে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সহায়তায় তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং নৌ-কমান্ডাে হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এভাবে দেশে প্রত্যাবর্তনকারী অন্যান্য সাবমেরিনারদের সঙ্গে দিল্লির নিকটবর্তী যমুনা নদীতে তিনি ২ সপ্তাহের নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীর তীরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গড়ে তােলার লক্ষ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হলে সেখানে তিনি প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। অতঃপর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে একই দিন একাধিক সমুদ্র ও নৌ-বন্দরে শত্রুর জাহাজ ও অন্যান্য নৌযানে আক্রমণ পরিচালনায় অপারেশন জ্যাকপটএর অংশ হিসেবে সাবমেরিনার বদিউল আলমকে অধিনায়ক করে ২০ জন নৌ-কমান্ডাের একটি দলকে চাঁদপুরের উদ্দেশে পাঠানাে হয়। তারা আগরতলা থেকে মেলাঘর হয়ে বক্সনগর সীমান্ত দিয়ে ১০ই আগস্ট বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। দুরাত দুদিন কখনাে পায়ে হেঁটে কখনাে নৌকায় চড়ে অবশেষে ১২ই আগস্ট তাঁরা চাঁদপুরের নিকটবর্তী দাশাদী গ্রামে এসে পৌঁছেন। সেখানে প্রবীণ শিক্ষক মাে. ইব্রাহিম, বিএ, বিটি-র বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, তার দুই সন্তান মাে. শাহজাহান কবির ও মাে. শামসুল কবির ছিলেন নৌ-কমান্ডাে দলের সদস্য। নিরাপত্তা ও অপারেশনের সুবিধার্থে সেখান থেকে তাঁরা চাঁদপুরের অতি নিকটস্থ করিম খান (শাহজাহান কবির ও শামসুল কবিরের মামা)-এর বাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৩ই আগস্ট শাহজাহান কবির, ফজলুল কবির ও মমিন উল্লাহ পাটওয়ারী এ তিন জন কমান্ডাে স্থানীয়দের সহায়তায় ছদ্মবেশে চাদপুর নৌ-বন্দর এলাকা রেকি করে শত্রুবাহিনীর জাহাজ ও নৌযানের অবস্থান পর্যবেক্ষণ করে নিজেদের আশ্রয়স্থলে ফিরে আসেন। ঐদিনই সকালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র ‘খ’ থেকে অপারেশনের প্রস্তুতি সংকেতসূচক পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলেম’ গানটি প্রচারিত হয়। একদিন পর ১৪ই আগস্ট সকালে চূড়ান্ত অপারেশন শুরুর নির্দেশনাস্বরূপ আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র ‘খ’ থেকে সাংকেতিক সঙ্গীত পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’ বেজে ওঠে। চূড়ান্ত অপারেশনের জন্য কমান্ডার সাবমেরিনার বদিউল আলম সর্বপ্রকার প্রস্তুতি ইতােমধ্যে সম্পন্ন করেন। ২০ জন কমান্ডাের মধ্যে ২ জন (এস এ মজুমদার ও শফিকুর রহমান) অপারেশনে অংশগ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন। তাদের কমান্ডােদের উদ্ধারে নৌকা নিয়ে দূরবর্তী স্থানে অপেক্ষায় থাকার দায়িত্ব দিয়ে তিনি পন্টুন, জাহাজ, বার্জ, ফেরি ইত্যাদি নিয়ে ৬টি টার্গেট ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ৩ জন করে বাকি ১৮ জন কমান্ডােকে ৬টি গ্রুপে ভাগ করেন। এরপর কমান্ডার বদিউল আলমসহ প্রত্যেকে বুকে লিমপেট মাইন, পায়ে ফিস, পরনে কস্টিউমস এবং এক্সপ্লোসিভসহ অন্যান্য অপারেশন সামগ্রী সঙ্গে নিয়ে ডাকাতিয়া নদীর পাড়ে করেগাে দোকানের কাছ দিয়ে পানিতে নেমে পড়েন। নদীতে তখনাে প্রবল ঢেউ ও স্রোত। পাকিস্তানি গানবােটগুলাে টহল দিচ্ছিল। গােটা এলাকা সার্চলাইটের আলােতে ঝলমল করছিল। এমনি এক অবস্থায় নৌ-কমান্ডােরা নির্দিষ্ট টার্গেটে লিমপেট মাইন বসিয়ে ফিরে আসার পথে বড় বিপদের সম্মুখীন হন। স্টিমার সার্ভিসের গাজী জাহাজে করে পাকিস্তানি সৈন্যরা খুলনা থেকে সৈন্য এবং অস্ত্র নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝে জাহাজটি ডাকাতিয়া ও মেঘনা নদীর বাঁকে এসে নােঙ্গর ফেলে। অপারেশন শেষে নদীর একই রুট দিয়ে সাঁতরে নৌ-কমান্ডােদের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পৌঁছার কথা ছিল। একটি বার্জের আড়ালে পানির ভেতর কিছু সময়ের জন্য তারা নিজেদের গােপন করে রাখেন। এদিকে ডাকাতিয়া নদীতে লিমপেট মাইন সেট করা শত্রুপক্ষের জাহাজ ও নৌযান একের পর এক বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়ে পানিতে নিমজ্জিত হতে থাকে। কয়েকটি জাহাজ ছাড়াও কমান্ডাে আক্রমণে লঞ্চঘাট টার্মিনাল ও স্টিমার ঘাটের ব্যাপক ক্ষতি হয়। হতচকিত ও সন্ত্রস্ত পাকিস্তানি সেনারা নদীর দুই পাড়ে অনবরত ভারী অস্ত্র দিয়ে গুলি বর্ষণ করতে থাকে। এরূপ অবস্থায় গাজী জাহাজ নােঙ্গর তুলে দূরে সরে যায়। এ সুযােগে নৌ-কমান্ডােরা প্রায় এক মাইল পথ সাঁতরে অতিক্রম করে মেঘনা পাড়ের একটি পাটক্ষেতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে নানু নামে এক জেলে কমান্ডােদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেন। তাঁর নৌকায় করে তাদেরকে কলমজোড়া গ্রামের কাছাকাছি একটি স্থানে পৌঁছে দেয়া হয়। সেখান থেকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বাড়ি, আগরতলা মামলার অন্যতম আসামী স্টুয়ার্ড মুজিবের বাড়ি, দাশদী গ্রাম এভাবে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পূর্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ২টি দলে মােট ১৮ জন নৌকমান্ডাে ১৯শে আগস্ট আগরতলায় গিয়ে পৌঁছেন। চাঁদপুর নৌ-বন্দর অভিযানে যেসব নৌ-কমান্ডাে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন- সাবমেরিনার বদিউল আলম, বীর উত্তম, মমিন উল্লাহ পাটওয়ারী, মাে. শাহজাহান কবির, বােরহান উদ্দিন আহমেদ, সালাউদ্দিন আহমদ (মরহুম), মাে. শামসুল কবির, ফজলুল কবির, সামসুদ্দিন সামু, আলী আশরাফ, আ. হাকিম, মাহবুবুর রহমান, আ. আজিজ, আ. গফুর, হাজী শহীদ হােসেন, লুৎফর রহমান, আমির হােসেন, মুন্নাফ পাটোয়ারী, রুহুল আমিন ও এস এম বাশার। এ অপারেশনে যারা আশ্রয়দান, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা, গাইড বা পথ প্রদর্শক হিসেবে নৌ-কমান্ডােদের সহযােগিতা প্রদান করেন, তাঁদের মধ্যে মাস্টার মাে. ইব্রাহিম, বিএ, বিটি, আব্দুল করিম খান (রঘুনাথপুর), চেয়ারম্যান দেলােয়ার হােসেন (কলমজোড়া ইউনিয়ন পরিষদ), সামছুর রহমান ওরফে ছিটু শেখ (দক্ষিণ বালিয়া গ্রাম), নসু মিয়া (এখলাসপুর), বাচ্চু মিয়া (নারায়ণপুর), মুক্তিযােদ্ধা জহিরুল হক পাঠান, বি এম কলিমউল্লাহ, খােকা, নানু খা, দরবেশ খা, নানু মিয়া প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। এছাড়া চাঁদপুর শহরের করেগাে দোকান সংলগ্ন এক বাড়িতেও কমান্ডােরা আশ্রয় গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মাে. ইব্রাহিম, বিএ, বিটি (দাশাদী; সফরমালী হাইস্কুলের হেডমাস্টার, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক)-কে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় ও সহায়তাদানের অভিযােগে ১৭ই আগস্ট গ্রেপ্তার করে। একই সঙ্গে তাঁর পুত্র নৌ-কমান্ডাে শাহজাহান কবিরও গ্রেপ্তার হন। নৌকায় করে তাঁদের নিয়ে যাওয়ার পথে শাহজাহান কবির নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপর পাকবাহিনী আরাে ক্ষীপ্ত হয়ে তাঁর পিতা মাে. ইব্রাহিমের ওপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে শেষে গুলি করে হত্যা করে। এছাড়াও নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের প্রতিশােধ হিসেবে পাকহানাদাররা চাঁদপুর ও সফরমালীর বিভিন্ন গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে এবং বহু নারীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর অপারেশন। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলা ঢাকা জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি মহকুমা ছিল। নারায়ণগঞ্জ শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিমি। ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী নারায়ণগঞ্জের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক দিয়ে প্রবাহিত হয়ে উভয় নদী মেঘনায় গিয়ে মিলিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ নৌ ও বাণিজ্যিক বন্দর। এছাড়া এখানে বহু শিল্প ও কল-কারখানা গড়ে ওঠে। এক সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যােগাযােগের ক্ষেত্রে এটি ছিল অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এ নৌ-বন্দরটিকে তাদের অস্ত্রশস্ত্র, রসদ, পণ্য ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে আসছিল। অতএব মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে এ নৌ-বন্দরে অভিযান পরিচালনা করা ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক বিবেচনা করে অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর এবং চাঁদপুর নৌ-বন্দরের পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জ নৌ-বন্দরেও নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৫ই আগস্ট একই তারিখে তা পরিচালিত হয়। নারায়ণগঞ্জ নৌ-কমান্ডাে অপারেশন পরিচালনার জন্য ২০ জনের একটি কমান্ডাে টিম গঠন করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন সাবমেরিনার আবিদুর রহমান, বীর বিক্রম আবিদুর রহমান ছিলেন সেই ৮ জন সাবমেরিনারের অন্যতম যিনি দেশের টানে ফ্রান্সের তুলো বন্দরে পাকিস্তানের কমিশনকৃত সাবমেরিন ম্যানগ্রো ত্যাগ করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরােপের বিভিন্ন দেশ হয়ে বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র ভারতের সহায়তায় ফিরে এসে নৌ-কমান্ডাে হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অন্য ৭ জন। সাবমেরিনারের সঙ্গে তিনিও ২ সপ্তাহের জন্য দিল্লির নিকটবর্তী যমুনা নদীতে ভারতীয় নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এরপর তিনি মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীর তীরে স্থাপিত নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আগস্ট মাসের শুরুর দিকে তাকে প্রধান করে ২০ জন প্রশিক্ষিত নৌ-কমান্ডােকে সেখান থেকে আগরতলা নিয়ে আসা হয়। সেখানে নৌঅভিযানের জন্য প্রত্যেককে লিমপেট মাইন, বিস্ফোরক, ফিস, সুইমিং কস্টিউমস ও অন্যান্য অপারেশন সামগ্রী, দলনেতার হাতে একটি ট্রানজিস্টার, ম্যাপ ও সঙ্গে একজন গাইড দিয়ে নারায়ণগঞ্জ নৌ-বন্দরে অপারেশন পরিচালনার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে হয়। তারা ১০ই আগস্ট কসবা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পায়ে হেঁটে ও নৌপথে ১১ই আগস্ট তাঁরা প্রথমে সােনারগাঁও সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন। অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৩ই আগস্ট সকালে আকাশবাণী কলকাতা ‘খ’ কেন্দ্র থেকে প্রস্তুতি সংকেতস্বরূপ পঙ্কজ মল্লিকের ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলেম’ গানটি পরিবেশিত হয়। সঙ্গে-সঙ্গে দলনেতা চূড়ান্ত অপারেশনের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। চূড়ান্ত অপারেশনের পূর্বে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানার মদনগঞ্জের শুভকরদি গ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা আবু বক্কর সিদ্দিকের বাড়িতে তাঁরা ওঠেন। দলনেতা আবিদুর রহমানসহ কমান্ডােদের কয়েকজন শীতলক্ষ্যা নদীর নিকটবর্তী স্থান থেকে একাধিকবার বন্দরে জাহাজ ও অন্যান্য নৌযানের অবস্থান রেকি করেন। ১৪ই আগস্ট সকালে একই বেতার কেন্দ্র থেকে পঙ্কজ মল্লিকের কণ্ঠে এবার অপারেশনের চূড়ান্ত সংকেত ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’ গানটি বেজে ওঠে।
বন্দর থানায় কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি রেঞ্জার্স ফোর্স ও রাজাকার সদস্য অবস্থান করছিল। এছাড়া শীতলক্ষ্যাসহ পার্শ্ববর্তী নদীসমূহে পাকিস্তানি কিছু গানবােটের নিয়মিত টহল ছিল। ৫টি জাহাজ ও নৌযানকে টার্গেট করে ৩ জন করে ৫টি দলে মােট ১৫ জন কমান্ডােকে অপারেশনে নিয়ােজিত করা হয়। দলনেতা আবিদুর রহমানও একটি টিমে অপারেশনে সক্রিয় অংশ নেন। তারা নারায়ণগঞ্জের পূর্ব পাড়ে বন্দর থানাধীন সােনাকান্দা গ্রামের ভেতর দিয়ে নদীর পাড়ে এসে পৌঁছেন। নারায়ণগঞ্জে তখন পাকিস্তানিদের তদ্রুপ শক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না। পথিমধ্যে তাদেরকে অস্ত্র হাতে পাহারারত এক রাজাকারকে সুকৌশলে মােকাবেলা করে অপারেশনে এগিয়ে যেতে হয়। অতঃপর রাত ১২টার পর অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট লিমপেট মাইনসহ শীতলক্ষ্যা নদীতে নেমে ডুবসাঁতার কেটে লক্ষ্যবস্তুর কাছে গিয়ে পরিকল্পনা মাফিক যথাস্থানে ঐসব মাইন স্থাপন করে সকলে নিরাপদে আশ্রয়স্থলে ফিরে আসতে সমর্থ হন। তখন মধ্যরাত। রাতের নিঃস্তদ্ধতা ভেঙ্গে বিকট শব্দে একের পর এক মাইন বিস্ফোরিত হতে থাকে। ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ ও নৌযানগুলাে পানিতে নিমজ্জিত হয়। মাইনগুলাে যখন একের পর এক বিস্ফোরিত হচ্ছিল, তখন পাকিস্তানি সেনারা টহলরত গানবােট ও অন্যান্য স্থান থেকে নদীর দুই তীরে। অনবরত গুলিবর্ষণ করছিল।
অপারেশনে যেসব কমান্ডাে অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেনসাবমেরিনার আবিদুর রহমান, আব্দুর রহিম-১, আ. রহিম-২, আজাহার হােসেন, আব্দুল মালেক, হাবিবুল হক, আব্দুল জলিল, শহিদুল্লাহ, আ. হােসেন সিরাজ ও ফজলুল হক ভুইয়া প্রমুখ। অপারেশন শেষে তারা পূর্বের পথ ধরে আগরতলা গিয়ে পৌছেন।
অপারেশন চলাকালে নারায়ণগঞ্জ মহকুমা (বর্তমান জেলা) আঞ্চলিক মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার গিয়াসউদ্দিন, বীর প্রতীক কয়েক জন মুক্তিযােদ্ধাসহ নদীর তীরে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন।

দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশন
দাউদকান্দি উপজেলা কুমিল্লা জেলার অন্তর্ভুক্ত। ঢাকা থেকে এর দূরত্ব পূর্বদিকে প্রায় ৫২ কিমি। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ভেদ করে প্রবাহিত মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ে দাউদকান্দি সদর উপজেলা ও ফেরিঘাট অবস্থিত। বর্তমানে এখানে সেতু রয়েছে। ৭১-এ ফেরিতে করে নদী পাড়াপাড় হতে হতাে। ভৌগােলিক অবস্থান বিবেচনায় দাউদকান্দি ফেরিঘাটটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়ক পথে যােগাযােগের এটিই ছিল একমাত্র মাধ্যম। ফেরিঘাটের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানি সেনাসদস্য ছাড়াও রেঞ্জার্স ও রাজাকাররা এখানে মােতায়েন ছিল। ফেরিতেও নিরাপত্তা রক্ষীরা থাকত ও তল্লাশি চালাত।
দাউদকান্দি ফেরিঘাটের গুরুত্ব বিবেচনায় রেখে অপারেশন জ্যাকপটের আওতায় অন্যান্য সমুদ্র ও নৌ-বন্দরের সঙ্গে এখানেও নৌ-কমান্ডাে অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ লক্ষ্যে কমান্ডাে শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে ৯ সদস্যের একটি দল গঠন করা হয়। তাঁরা মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীর তীরে নৌ-কমান্ডাে হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। সেখান থেকে তাদের আগরতলায় নিয়ে এসে অপারেশন সম্বন্ধে বিস্তারিত ব্রিফিং দেয়া হয়। অন্যান্য দলের মতাে এঁদেরও লিমপেট মাইন, এক্সপ্লোসিভ, সুইমিং কস্টিউমস, সাঁতারের ফিস, দলনেতাকে একটি ট্রানজিস্টার এবং অন্যান্য অপারেশন সামগ্রী দিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাঠানাে হয়। ভারত সীমান্তবর্তী কুমিল্লার কংশনগর পথ ধরে কখনাে পায়ে হেঁটে কখনাে নৌপথে চলে কমান্ডাে দলটি দাউদকান্দির বন্ধরামপুর গ্রামে এসে আল্লামা শাহ কামাল নামে এক পীরের বাড়িতে অস্থায়ী ঘাঁটি করে সেখানে ওঠেন। ২নং সেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন এ টি এম হায়দার অপারেশনে তাঁদের গাইড হিসেবে আবুল কাশেম ও আব্দুল মান্নান নামে ২ জন মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ােজিত করেন। ১৪ই আগস্ট অস্থায়ী ঘাঁটি থেকে একটি ছইওয়ালা নৌকায় করে দলনেতা শাহজাহান সিদ্দিকী অপর একজন কমান্ডােকে সঙ্গে নিয়ে অপারেশনস্থল রেকি করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৫ই আগস্ট অন্যান্য স্থানের মতাে একই সঙ্গে অপারেশন পরিচালনার সিদ্ধান্ত থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়া ও অপর একটি বিশেষ কারণে ১৫ তারিখের পরিবর্তে ঐদিন রাত ১২টার পর অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট এখানকার অপারেশন পরিচালিত হয়। অপারেশনের দিন সন্ধ্যার পর কমান্ডােরা সর্বপ্রকার প্রস্তুতি সম্পন্ন করে একটি ছইওয়ালা বড় নৌকা যােগে অস্থায়ী ঘাঁটি থেকে প্রায় ৫ মাইল দূরবর্তী দাউদকান্দি ফেরিঘাটের উদ্দেশে রওনা দেন। সঙ্গে একটি কোষা নৌকাও ছিল। রাত ১টার দিকে ফেরিঘাটের অদূরে একটি ধানক্ষেতের মধ্যে বড় নৌকাটি বেঁধে রেখে ২টি ফেরি ও ১টি পন্টুনকে টার্গেট করে ৩ জন করে ২টি গ্রুপ এবং অপর একজন কমান্ডােকে সঙ্গে নিয়ে দলনেতা শাহজাহান সিদ্দিকী স্বয়ং ডুবসাঁতারে নির্দিষ্ট টার্গেটে পৌছে যথাস্থানে লিমপেট মাইন বসান। এরপর দ্রুত তাঁরা স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে অপেক্ষমাণ কোষা নৌকায় চড়ে সেখান থেকে বড় নৌকায় গিয়ে ওঠেন এবং নিরাপদে অস্থায়ী ঘাঁটিতে গিয়ে পৌঁছেন। এর পূর্বেই বিকট শব্দে লিমপেট মাইনগুলাে বিস্ফোরিত হয় এবং লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস হয়ে পানিতে নিমজ্জিত হয়। অপরদিকে শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের অবিরাম গুলিবর্ষণ। ১৭ই আগস্ট কমান্ডােরা একই পথে ভারতের উদ্দেশে রওনা দিয়ে পরের দিন আগরতলা গিয়ে পৌঁছেন। পথিমধ্যে এক প্রৌঢ় মহিলা ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত কমান্ডােদের খাবারের ব্যবস্থা করেন।
দাউদকান্দি ফেরিঘাট অপারেশনে যাঁরা অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা হলেন- শাহজাহান সিদ্দিকী, বীর বিক্রম, হাসান নূর, মতিউর রহমান, নুরুল ইসলাম, খােরশেদ আলম, মােরশেদ সরকার, সিরাজুল ইসলাম, শাহ আলম ও আরব আলী।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অপারেশন জ্যাকপট ছিল একটি সাড়া জাগানাে ঘটনা। ১৫ই আগস্ট একযােগে একাধিক সমুদ্র ও নৌ-বন্দরে নৌ-কমান্ডােদের শতভাগ সফল অভিযান পাকিস্তানিদের কাছে ছিল বিস্ময়কর। এতদিন মুক্তিযােদ্ধারা শুধু স্থলভাগ ও সীমান্তবর্তী এলাকায় পাকহানাদারদের বিরুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতি, এম্বুশ বা কখনাে সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। কিন্তু তারা যে নৌ-পথেও আক্রমণ পরিচালনায় পারদর্শী, অপারেশন জ্যাকপট ছিল তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পত্রিকা ডেইলী টেলিগ্রাম, অবজারভার, নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পােস্ট, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড ও অন্যান্য গণমাধ্যমে এ ঘটনা গুরুত্বসহকারে প্রচার পায়। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর পাকিস্তানি সামরিক জান্তার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি এর ফলে খর্ব হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকারের জন্য এটি ছিল মহা বিপর্যয়কর এক ঘটনা। অন্যদিকে, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এটি ছিল একটি টার্নিং পয়েন্ট, যা মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল বহুগুণ বাড়িয়ে দেয় । [হারুন-অর-রশিদ]
তথ্যসূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস (সেক্টরদশ), মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, মার্চ ২০০৬; এ কে খন্দকার, ভেতরে বাইরে ১৯৭১, প্রথমা ২০১৪; কমােডর এ ডব্লিউ চৌধুরী, বীর উত্তম, বীর বিক্রম-এর সাক্ষাত্তার, ২০১৯; মুক্তিযােদ্ধা আবু সাইদ সরদার (সম্পাদিত), অপারেশন জ্যাকপট – চট্টগ্রাম, নেভাল কমান্ডাে এন্ড এসােসিয়েটস ২০১৫; কমান্ডাে মাে. খলিলুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান, সাহিত্য প্রকাশ ২০১১; মাে. শাহজাহান কবির, বীর প্রতীক, চাঁদপুরে নৌ-মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য প্রকাশ ২০১২।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড