You dont have javascript enabled! Please enable it!

অপারেশন সার্চলাইট

অপারেশন সার্চলাইট ৭১-এর ২৫শে মার্চের কালরাত থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর অতর্কিতে নির্বিচার গণহত্যা শুরুর অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর জন্য ছিল এক বিরাট বিস্ময়। সামরিকবেসামরিক বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টাদের ধারণা জন্মেছিল যে, আওয়ামী লীগ- চল্লিশ শতাংশের মতাে আসন পেতে পারে, কিন্তু জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের মাধ্যমে কেন্দ্রে সরকার গঠনে সক্ষমতা লাভ করবে – এটি ছিল তাদের ধারণার বাইরে। উল্লেখ্য, জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ ৩১৩টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন (৭টি মহিলা আসনসহ) এবং পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন লাভ করে। গণরায় মেনে নিয়ে বাঙালির অবিসংবাদিত ও মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সক্রিয় সমর্থন নিয়ে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহণ করে। এরই অংশ অপারেশন সার্চলাইট। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালিদের গণতান্ত্রিক অধিকার নস্যাৎ করে চিরতরে তাদের পদানত করে রাখতে এ নীলনকশা প্রণয়ন করে। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনী সে নীলনকশা অনুযায়ী ঢাকাসহ সারাদেশে আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে বাঙালিদের ওপর গণহত্যায় ঝাঁপিয়ে পড়ে।
অপারেশন ব্রিজ (Operation BLITZ): অপারেশন সার্চলাইটের পূর্বে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অপারেশন ব্রিজ নামে আরেকটি সামরিক পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। লে. জেনারেল নিয়াজীর পূর্বে পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের বিবরণ অনুযায়ী সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়লে সে পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য অপারেশন ব্রিজ প্রণয়ন করা হয়। ১৪ ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজার বর্ণনা অনুযায়ী দেশে সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ করে সামরিক শাসন প্রবর্তন করা ছিল এ অপারেশনের মূল বিষয়। কিন্তু ৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল ঘােষণার পরপর সম্পূর্ণ এক নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ইস্পাতদৃঢ় ঐক্য নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের অভ্যুত্থান ঘটে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এমন পরিস্থিতির নজির নেই। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এডমিরাল আহসান এবং জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইয়াকুব খান বাঙালির মনােভাব যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এ কারণে তাঁরা উভয়ই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে যে-কোনাে ধরনের সামরিক সমাধানের পদক্ষেপ থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেন। লে. জেনারেল ইয়াকুব অপারেশন ব্রিজ প্রণয়ন করলেও এর বাস্তবায়নের কোনাে উদ্যোগ নেননি। গণ-আন্দোলন দমনে সামরিক পন্থা : দু-একজন ব্যতিক্রম বাদে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের অধিকাংশই মনে করত যে, শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমেই বাঙালিদের উপযুক্ত শিক্ষা দেয়া সম্ভব। শুধু সামরিক বাহিনী নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোও সামরিক পন্থা গ্রহণের কট্টর সমর্থক ছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নীতি-নির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত উচ্চপদস্থ অফিসারদের মধ্যে লে. জেনারেল ওমর, লে. জেনারেল গুল হাসান, জেনারেল পীরজাদা, মেজর জেনারেল মিঠা খান, মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান, লে. জেনারেল টিক্কা খান, রিয়াল এডমিরাল মাে. শরীফ, এয়ার কমােডর ইনাম-উল-হক এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আব্দুল হামিদ খান ছিল সামরিক পদক্ষেপের পক্ষে।
প্রধানত দুটি কারণে ইয়াহিয়া সরকার রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সামরিক সমাধান বেছে নেয়। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকবর্গ জাতিগতভাবে বাঙালিদের প্রতি সর্বদা অবজ্ঞা, বিদ্বেষ ও বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করত। অযােদ্ধা বাঙালিদের সহজেই দমন করা সম্ভব বলে তারা মনে করত। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের ৬-দফা কর্মসূচিভিত্তিক সংবিধান প্রণীত হলে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর তাদের আর ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণ চালানাে যাবে না। জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে আঁতাত পাকাপােক্ত করার উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া পাখি শিকারের নামে ভুট্টোর লারকানাস্থ বাস ভবনে গমন করে। তার সঙ্গে ছিল প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লে. জেনারেল পীরজাদা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধু লে. জেনারেল আবদুল হামিদ খান। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টি কোনাে অবস্থায়ই ৬-দফাভিত্তিক সংবিধান মেনে নেবে না বলে তাদের মধ্যে বৈঠকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। এর পূর্বে ৩রা জানুয়ারি ৬-দফা প্রশ্নে কোনােরূপ সমঝােতার সুযােগ না থাকা এবং ৬-দফার সঙ্গে যাতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কেউ বেঈমানি করতে না পারে সে উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৪৬৫ জন সদস্যকে শপথ বাক্য পাঠ করান।
অপারেশন সার্চলাইটের পটভূমি, কৌশল ও লক্ষ্য: ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেয়। ২রা ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত পাঁচ প্রদেশের গভর্নর ও সামরিক শাসকদের বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া বাঙালিদের এ মর্মে সর্তক করে দেয় যে, সামরিক আইনের লঙ্ঘন সহ্য করা হবে না। লে. জেনারেল নিয়াজীর ভাষ্যমতে ঐ বৈঠকেই সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা অনুমােদন করা হয়। মুজিব ৬-দফা প্রশ্নে তাঁর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে ব্যর্থ হলে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে তার বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেয়া হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর জনসংযােগ অফিসার সিদ্দিক সালিক তার Witness to surrender বইয়ে লিখেছেন, ২৭শে ফেব্রুয়ারি থেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পদাতিক বাহিনীর শতশত সৈনিক বিমানপথে ঢাকায় আসতে শুরু করে। পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার কাজ গােপনে সারতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত গােপন থাকেনি। সামরিক বেসামরিক নানা উৎস থেকে আওয়ামী লীগ নেতবৃন্দ পর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর শক্তিবৃদ্ধির বিষয়ে অবহিত ছিলেন। ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত রূপ নেয় যে, সেনাশক্তি নিয়ােজিত করে বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দমন করা হবে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এডমিরাল আহসানকে গভর্নরের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দিয়ে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানকে গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। রাজনৈতিক পন্থায় রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার অনাগ্রহ এবং ক্রমাগত বল প্রয়ােগের দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে এডমিরাল আহসান এবং লে. জেনারেল ইয়াকুব উভয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার পছন্দের উপদেষ্টাদের পরামর্শ অনুযায়ী ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের আসন্ন অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করে। পূর্ব বাংলায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘােষণার প্রতিক্রিয়া হয়েছিল মারাত্মক। সারাবাংলায় স্বতঃস্ফুর্ত বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বাঙালির ক্রোধ, দ্রোহ ও ক্ষোভকে ধারণ করে বঙ্গবন্ধু ঘােষণা দেন, এটি আনচ্যালেঞ্জ যাবে না। রাজপথ ও মিছিলে বিক্ষুব্ধ জনতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয় স্লোগান: ‘জাগাে জাগাে বাঙালি জাগাে’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তােমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ইত্যাদি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুরু হয় সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু পরিণত হন পূর্ব বাংলার কার্যত সরকার প্রধান। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে তাঁর বাসভবন থেকে আন্দোলনের সকল নির্দেশনা জারি করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সাতই মার্চের ভাষণ-এর পরপর স্বাধীনতার লক্ষ্যে এদেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু হয়। লে. জেনারেল ইয়াকুব পদত্যাগ করে ৭ই মার্চ ‘বেলুচিস্তানের কসাই খ্যাত’ লে. জেনারেল টিক্কা খানের নিকট দায়িত্ব হস্তান্তরপূর্বক ১১ই মার্চ ঢাকা ত্যাগ করেন।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর ঘােষিত অসহযােগ আন্দোলন, হরতাল, বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ইত্যাদি কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও একক সত্তায় পরিণত হয়। এক পর্যায়ে গভর্নর হাউজ এবং ঢাকা সেনানিবাস ব্যতীত কোথাও পাকিস্তান সরকারের কোনাে অস্তিত্ব ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আনার প্রতিবাদে বাঙালিরা পিআইএ-তে দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানায়। পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী ৮ই মার্চ জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর পদে শপথ পাঠদানে অপারগতা প্রকাশ করেন। অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে প্রধান বিচারপতি বাঙালি জনমতেরই প্রতিধ্বনি করেন। এমনকি এ সময়ে ঢাকাস্থ প্রেসিডেন্ট হাউজের পানির সংযােগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়, যা ১৫ই মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়ার ঢাকায় আগমনের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পুনঃস্থাপিত হয়।
১৫ই মার্চ প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় আসে। ১৬ই মার্চ থেকে মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনা শুরু হয়। আলােচনায় যােগ দিতে ২১শে মার্চ দলবলসহ ভুট্টো ঢাকায় আসে। সবই ছিল লােক দেখানাে ও ষড়যন্ত্রের অংশ এবং বাঙালিদের সঙ্গে প্রতারণার সামিল। ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পরই জেনারেল ইয়াহিয়া ১৭ই মার্চ রাতে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়। পরের দিন ১৮ই মার্চ মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন। রাজা এবং মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ঢাকা সেনানিবাসের জিওসি অফিসে বসে সামরিক পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপরেখা প্রণয়ন করে। একই দিন সন্ধ্যায় কমান্ড হাউজে অনুষ্ঠিত বৈঠকে তেমন কোনাে আলােচনা ছাড়াই পরিকল্পনাটি অনুমােদন লাভ করে। ২২শে মার্চ ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউজ থেকে জারিকৃত এক ঘােষণায় ২৫শে মার্চ অনুষ্ঠেয় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন পুনরায় অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করা হয়। ২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে সারাবাংলায় প্রতিরােধ দিবস পালিত হয়। বাংলার ঘরে-ঘরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকার পাশাপাশি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ষড়যন্ত্র ও দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র মানুষজনকে হত্যার প্রতিবাদে কালাে পতাকা উত্তোলিত হয়। রংপুর ও চট্টগ্রামে নিরীহ জনতা পাকিস্তান সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। ঢাকার উপকণ্ঠে মিরপুরে বিহারিরা বাঙালিদের। ওপর আক্রমণ চালিয়ে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। ১৯শে মার্চ জয়দেবপুরের চৌরাস্তা মােড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ হয় এবং হানাদারদের গুলিতে বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। শ্রমিক-জনতার প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে এম ভি সােয়াত থেকে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আনসারীর নেতৃত্বে অস্ত্র-গােলাবারুদ নামানাে শুরু হয়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া বাঙালিদের ধোকা দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করে। ২৫শে মার্চ বিকেলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সেনানিবাসে অবস্থিত ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে যায়। সন্ধ্যার দিকে প্রেসিডেন্টের গাড়ির বহর প্রেসিডেন্ট হাউজে ফিরে আসে। দেখানাে হয় যে, প্রেসিডেন্ট ঢাকায় অবস্থান করছে। প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়া সেনানিবাস থেকে কঠোর গােপনীয়তায় সন্ধ্যা ৭টায় পশ্চিম পাকিস্তানগামী বিমানে চড়ে বসে। নির্ধারিত সময়ের পূর্বে তার বিমান করাচিতে পৌছলে অপারেশন সার্চলাইটের সঙ্গে যুক্ত জেনারেলরা আক্রমণের সময় এগিয়ে আনে।
অপারেশন সার্চলাইটের দুটি অংশ ছিল। প্রথম অংশে ছিল। পরিকল্পনার ভিত্তি, সাফল্যের জন্য অবশ্য করণীয়, কৌশলগত দিক, ব্রিগেড কমান্ড অধিনায়কত্ব ইত্যাদি বিষয়ে ১৬টি পয়েন্টের উল্লেখ। দ্বিতীয় অংশে ছিল ঢাকা, যশাের, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা, সিলেট এবং চট্টগ্রাম অঞ্চলের জন্য সেনা বরাদ্দ ও তাদের করণীয় সম্পর্কে নির্দেশনা। অভিযানের মৌলিক নির্দেশনাবলি: অভিযানে সাফল্যের জন্য যেসব মৌলিক নির্দেশনা দেয়া হয়, তার মধ্যে ছিল- সারা প্রদেশে একই সঙ্গে অভিযান শুরু করা; সর্বাধিক সংখ্যক রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা এবং সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিক্ষকদের মধ্যকার চরমপন্থীদের গ্রেপ্তার করা; ঢাকার অভিযানকে শতভাগ সফল করা; এজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দখল প্রতিষ্ঠা করে তল্লাশি চালানাে; সেনানিবাসের নিরাপত্তা অবশ্যই নিশ্চিত করা; অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক যােগাযােগের সকল মাধ্যম বিচ্ছিন্ন করা; অস্ত্রাগার নিয়ন্ত্রণ ও প্রহরায় পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ােগের মাধ্যমে বাঙালি সেনাদের নিষ্ক্রিয় করা ইত্যাদি।
অপারেশনের কৌশলগত দিক: বাঙালিদের ধোঁকা দেয়ার লক্ষ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের শেখ মুজিবের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে যাওয়া এবং আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নেয়ার প্রতারণামূলক ইঙ্গিতের আড়ালে সামরিক পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা; অভিযানের সর্বোচ্চ গােপনীয়তা রক্ষা করা। ঢাকা শহরে অবস্থিত নিম্নে বর্ণিত বিভিন্ন স্থাপনায় সেনাবাহিনীর প্রাথমিক অভিযান পরিচালনা ও সেক্ষেত্রে যা করণীয়-
১. বলপূর্বক ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িতে প্রবেশ করে যাদের পাওয়া যাবে মুজিবসহ তাঁদের সবাইকে গ্রেফতার করা। গােয়েন্দা প্রতিবেদন অনুযায়ী বাড়িটির নিরাপত্তা ও পাহারা ব্যবস্থা বেশ মজবুত, তাই বিষয়টি হিসেবে রাখা; খ. বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের গুরুত্বপূর্ণ হলগুলাে প্রথমে ঘেরাও করা। এর মধ্যে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল) ও জগন্নাথ হল এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াকত হল; গ. টেলিফোন এক্সচেঞ্জ বিকল করা; ঘ. ইপিআর সদর দফতর ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স অতর্কিত আক্রমণের মাধ্যমে দখল করে নেয়া; ঙ. প্রেসিডেন্ট হাউজ, গভর্নর হাউজ, এমএনএ হােস্টেল, রেডিও, টেলিভিশন এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এলাকায় সেনা সমাবেশ বৃদ্ধি করা ইত্যাদি। অপারেশনের অধিনায়কত্ব: দুটি পৃথক সদর দপ্তর থেকে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালিত হয়। ঢাকা অঞ্চলের কমান্ডার ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী। এর বাইরে সমগ্র দেশের কমান্ডার ছিল মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা। ঢাকা শহরে আক্রমণ পরিচালনার দায়িত্বে ছিল ৫৭ ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। মেজর জেনারেল ইফতেখার জানুজুয়া ও মেজর জেনারেল মিঠা কর্তৃক যথাক্রমে খাদিম হােসেন রাজা ও রাও ফরমান আলীকে সহায়তাদান। এমনকি প্রয়ােজনে তাদের হাত থেকে অপারেশনের দায়িত্বভার নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়ার জন্য তাদের প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। লে. জেনারেল টিক্কা খান ও তার ব্যক্তিগত স্টাফরা পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক আইন সদর দফতর থেকে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করছিল।

এইচ আওয়ার: অপারেশন সার্চলাইট-এর পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর ১৪ ডিভিশনের সদর দফতর থেকে ঢাকার বাইরের সব গ্যারিসনকে টেলিফোনে আক্রমণ শুরুর (এইচ আওয়ার) সময় জানিয়ে দেয়া হয়। গােপন সংকেতের মাধ্যমে বার্তাটি সব সেনা ছাউনিতে পৌছে যায়, যাতে সারাদেশে এক সঙ্গে আক্রমণ হয়। সেই চরম মুহূর্তটি নির্ধারিত হয় ২৫শে মার্চ রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬শে মার্চ রাত ১টায়। সংকেতটি ছিল ২৬০১০০ ঘণ্টা। ধারণা করা হয়েছিল, করাচিতে পৌছাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঐ সময় লাগবে। কিন্তু তার আগে সে পৌছে যাওয়ায় আক্রমণের সময় এগিয়ে ২৫শে মার্চ রাত ১১:৩০ টায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এদিকে ২৪শে মার্চ চট্টগ্রাম থেকে ৮ম রেজিমেন্টের সিনিয়র বাঙালি অফিসার ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদারকে খাদিম হােসেন রাজা কৌশলে তার সঙ্গে করে ঢাকা নিয়ে আসার পর তাকে বন্দি করে রাখা হয়। অন্যদিকে ইবিআরসি-র বাঙালি সিনিয়র কর্মকর্তা লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেয়া হয়।
ঢাকায় অপারেশন বাস্তবায়ন ও এর ভয়াবহতা: পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পকিকল্পনা অনুযায়ী পূর্ণ শক্তি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পুরান ঢাকা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে অভিযান চালায়।
ঢাকা সেনানিবাসের প্রতিরক্ষার জন্য ৫৭ ব্রিগেডের ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে রিজার্ভ বাহিনী হিসেবে মােতায়েন করা হয়। ঢাকা বিমান বন্দরের দায়িত্ব দেয়া হয় ৪৩ বিমান বিধ্বংসী রেজিমেন্টকে পিলখানার ইপিআর সদর দফতরে মােতায়েন করা হয় ২২ বালুচ রেজিমেন্টকে। এ রেজিমেন্টের দায়িত্ব ছিল দুটি। প্রথমত, পিলখানায় অবস্থানকারী ২ হাজার ৫শ বাঙালি ইপিআর সদস্যকে নিরস্ত্র বা মােকাবিলা করা, দ্বিতীয়ত, ইপিআর-এর ওয়ারলেস এক্সচেঞ্জ দখল করা। রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের প্রায় ১০০০ বাঙালি পুলিশের জন্য ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে প্রেরণ করা হয়। পুরান ঢাকার নওয়াবপুর এলাকায় পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে মােতায়েন করা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ধারণা ছিল, পুরান ঢাকার হিন্দুদের বাড়িগুলাে অস্ত্রাগারে পরিণত হয়েছে। ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বালুচ ও ৩২ পাঞ্জাবের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, বিশেষ করে ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল আক্রমণের নির্দেশ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিয়ে এক প্লাটুন কমান্ডােকে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে তার বাড়িতে পাঠানাে হয়। ৫৭ ব্রিগেড কমান্ডার বিগ্রেডিয়ার জাহানজেব আরবাবের নেতৃত্বে ঢাকা শহরে আক্রমণ পরিচালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিশেষ টার্গেট। আধুনিক মারণাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি হানাদারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হল (ইকবাল হল), জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ হল, রােকেয়া হল, ঢাকা হল (বর্তমান শহীদুল্লাহ হল), আর্ট হােস্টেল (শাহনেওয়াজ হল) ও শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় আক্রমণে ঝাপিয়ে পড়ে। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালিত হয় জহুরুল হক ও জগন্নাথ হলে। জীবন রক্ষার জন্য ছাত্ররা হলের ছাদে, টয়লেটে, হলের বিভিন্ন কোনায়, পানির ট্যাংকের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক তল্লাশির মুখে অনেকেই নিজেদের লুকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হয়। হানাদারদের এলােপাতাড়ি গুলি আর নির্বিচার বেয়নেটের আঘাতে ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীদের অনেককে জীবন দিতে হয়।
জগন্নাথ হলের ৩৬ জন ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন শিক্ষক ও ঐ হলের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বহিরাগত অতিথি মিলে ৭০ জনকে হত্যা করে হলের খেলার মাঠের উত্তর-পশ্চিম কর্নারে গণকবরে মাটিচাপা দেয়া হয়। ২৫শে মার্চ রাতে ও পরের দিন জহুরুল হক হলের খেলার মাঠে ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের স্তুপীকৃত লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। রােকেয়া হলে কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যসহ ৪৫ জন হানাদারদের নির্মম হত্যার শিকার হন। ঢাকা হলে ২ জন শিক্ষক ও ১০-১২ জন ছাত্র নিহত হন। এছাড়া সলিমুল্লাহ হল। ও শাহনেওয়াজ হােস্টেলেও হত্যাকাণ্ড ঘটে। হানাদাররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী মধুর ক্যান্টিনের পরিচালক মধুসূদন দে (সকলের প্রিয় মধুদা)-র শিববাড়ির বাসা আক্রমণ করে তার স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূসহ তাঁকে হত্যা করে।
শিববাড়ির ৫ জন সাধুকেও বর্বর পাকসেনারা অন্যান্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে গুলি ও বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। ২৫শে মার্চ রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তাঁরা হলেন- অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিজ্ঞান), মােহাম্মদ আবদুল মুকতাদির (ভূতত্ত্ব), আতাউর রহমান খান খাদিম (পদার্থবিজ্ঞান), অধ্যাপক এ এন এম মুনীরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), অধ্যাপক ড. গােবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শন), অধ্যাপক ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি; ২৫শে মার্চ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মকভাবে আহত অবস্থায় ৩০শে মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যু), ড. ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকাবিজ্ঞান), মােহাম্মদ সাদেক (ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক, ইউল্যাব) ও শরাফত আলী (গণিত) (দেখুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণহত্যা)।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের অপর দুটি প্রধান টার্গেট ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স ও পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স। ট্যাংক ও কামান সজ্জিত হয়ে ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যরা পুলিশ লাইন্সে রাত ১২টার দিকে আক্রমণ শুরু করে। পুলিশ সদস্যরা জীবন দিয়ে প্রতিরােধের চেষ্টা করেন। রাত প্রায় সাড়ে ৩টা পর্যন্ত সেখানে প্রতিরােধযুদ্ধ চলে। হানাদার বাহিনীর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের সম্মুখে পুলিশের প্রতিরােধযােদ্ধাদের পক্ষে এর বেশি টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। এখানে শতাধিক পুলিশ সদস্য শহীদ হন, অনেকে গ্রেপ্তারবরণ করেন এবং বাকিরা পালিয়ে যান। তাঁদের অনেকেই পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন (দেখুন রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স প্রতিরােধযুদ্ধ)। ২৫শে মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর দু-একদিন। আগে পিলখানায় ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সে ২২ বালুচ। রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানিকে মােতায়েন করা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী ইপিআর-এর বাঙালি সদস্যদের অধিকাংশকে নানা অজুহাতে নিরস্ত্র করে। এরপর ঐদিন রাত ১২টার দিকে শুরু হয় পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্বপরিকল্পিত পৈশাচিক আক্রমণ। সামান্য কিছু হাতিয়ার যা ছিল, তা নিয়ে বাঙালি ইপিআর সদস্যরা প্রতিরােধ গড়ে তােলার ব্যর্থ চেষ্টা করেন। বেশকিছু ইপিআর সদস্য হানাদারদের হাতে শহীদ হন। অনেকে বন্দি হন। বাকিরা পালিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে জিঞ্জিরায় একত্রিত হয়ে হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। বন্দি ইপিআর সদস্যদের ওপর চরম নির্যাতন চালিয়ে পরবর্তীতে হত্যা করা হয়। এছাড়া একই রাতে ঢাকায় প্রেসিডেন্ট হাউজ ও গভর্নর হাউজে দায়িত্বে নিয়ােজিত বাঙালি ইপিআর সদস্যদের ওপর হানাদার বাহিনী সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। এর পূর্বে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করা হয়। শতাধিক ইপিআর সদস্যকে বন্দি করে ২৯শে মার্চ রাতে রমনা কালীমন্দির সংলগ্ন স্থানে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার ও বেয়নেট চার্জ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। (দেখুন মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর)। অপারেশন সার্চলাইট শুরুর সঙ্গে সঙ্গে গুড়িয়ে দেয়া হয় রমনা কালী মন্দির। এ অপারেশনের অপর একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল পুরান ঢাকার হিন্দু সম্প্রদায়। ২৫শে মার্চ রাতে তারা শাঁখারী বাজার, তাঁতী বাজার, নারিন্দা, বাবু বাজার, সূত্রাপুর, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, নারিন্দা মন্দির, নয়া বাজার, গােয়াল নগর, ইংলিশ রােড প্রভৃতি স্থানে ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালনা করে নির্বিচারে হত্যা এবং ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে অগ্নিসংযােগ করে। ২৫-২৯শে মার্চ কেবল শাঁখারীবাজারেই ৬শ হিন্দুকে হত্যা করে (দেখুন ঢাকা শহরে গণহত্যা ও বধ্যভূমি)।
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার: একদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উল্লিখিত হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসের তাণ্ডবলীলা যখন চলছিল, অপরদিকে তখন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তারের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি চৌকস কমান্ডাে দলকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে পাঠানাে হয়। কমান্ডাে অফিসার মেজর জেড এ খানের নেতৃত্বে এ দলে অফিসার পর্যায়ের আরাে ছিল। মেজর বিল্লাল, মেজর জাফর, ক্যাপ্টেন হুমায়ুন এবং ক্যাপ্টেন সাঈদ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল আবদুল হামিদ খানসহ একাধিক উচ্চপদস্থ সেনাকর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পরিকল্পনা পূর্বেই চূড়ান্ত করা হয়। ২৩ ও ২৪শে মার্চ সেনাকর্মকর্তারা বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর বাড়ি ও সংলগ্ন এলাকা রেকি করে। ২৫শে মার্চ সন্ধ্যা থেকেই কমান্ডােদের একটি অংশ বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ঘেরাও করে রাখে। চূড়ান্ত অপারেশনের দিন মধ্যরাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিশেষ কমান্ডাে বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে হাজির হয়। অনেকে বাড়ির সীমানা প্রাচীর টপকে ভেতরে প্রবেশ করে। গ্রেনেড বিস্ফোরণ ও গুলি ছুড়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে তারা ত্রাসের সঞ্চার করে। মুক্তিযুদ্ধোত্তর ১৯৭২ সালের ১৮ই জানুয়ারি ধানমন্ডির বাসভবনে প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার সাক্ষাৎকারে ২৫শে মার্চ রাতের অভিজ্ঞতা ও তার গ্রেপ্তারবরণের ঘটনা এভাবে বর্ণনা করেনসে এক কাহিনী… সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডাে বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে। যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপােসের আলােচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থিরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুনাে না বেরুনাে নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তান বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগােপন করলে, ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা করবে।… আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তাও ভালাে, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।… ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল।… আমি এই শােবার ঘরেই তখন বসেছিলাম। এদিক থেকে ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে। তারপর এদিক ওদিক-সবদিক থেকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। জানালার উপর গুলি চালায়।… একটা গুলি আমার শােবার ঘরে এসে পড়ে।… আমি দুয়ার খুলে বাইরে বেরিয়ে ওদের গুলি বম্যন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম: “তােমরা গুলি বন্ধ কর। আমি তাে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।…” তখন চারদিক থেকে ওরা আমার দিকে ছুটে এলাে, বেয়নেট উদ্যত করে। ওদের একটা অফিসার আমাকে ধরল। ওই অফিসারই বললাে: ‘এই! ওকে মেরে ফেলাে না।’ … ওরা তখন আমাকে এখান থেকে টেনে নামালাে। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে বন্দুকের কুদো দিয়ে মারতে লাগল। … আমি বললাম: ‘তােমরা আমাকে টানছ কেন? আমি তাে যাচ্ছি। … চারিদিকে তখন আগুন জ্বলছিল। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর আদমজি ক্যান্টনমেন্ট স্কুলে ঐ রাতে রাখা হয়। পরের দিন ফ্লাগ স্টাফ হাউজে স্থানান্তর করা হয়। এর তিনদিন পর তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। উল্লেখ্য, ২৫শে মার্চ রাতে গ্রেপ্তারকালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু মেজর জেনারেল মিঠার নির্দেশে তাকে হত্যার পরিবর্তে বন্দি করে নিয়ে আসা হয়। ঢাকার বাইরে অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনা : শুধু ঢাকা শহর নয়, অপারেশন সার্চলাইট-এর উদ্দেশ্য ছিল একই সঙ্গে সারাদেশের বড়-বড় শহরে আক্রমণ পরিচালনা করা। এসব শহরের মধ্যে ছিল যশাের, খুলনা, রংপুর-সৈয়দপুর, রাজশাহী, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি। যশাের : এখানকার দায়িত্বে ছিল ১০৭ ব্রিগেড, ২৫ ও ২৭ বালুচ রেজিমেন্ট, ২৪ ফিল্ড রেজিমেন্ট (আংশিক) ও ৫৫ ফিল্ড রেজিমেন্ট। এদের করণীয় ছিল প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর-এর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স, রিজার্ভ পুলিশ ও আনসারদের নিরস্ত্র করা; আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার; টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করা; যশাের ক্যান্টনমেন্ট, যশাের শহর, যশাের-খুলনা সড়ক ও বিমানবন্দর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়া; কুষ্টিয়াকে সর্বপ্রকার যােগাযােগ থেকে বিচ্ছিন্ন করা; খুলনায় পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি ইত্যাদি।
খুলনা : এখানে অপারেশনের দায়িত্ব ছিল ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের ওপর। এদের করণীয় ছিল ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার্স, রিজার্ভ কোম্পানিজ ও রিজার্ভ পুলিশের সদস্যদের নিরস্ত্র করা; টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও রেডিও স্টেশন দখলে নেয়া; আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগ ও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা; শহর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেয়া ইত্যাদি।
রংপুর-সৈয়দপুর : ২৩ ব্রিগেড, ২৯ গােলন্দাজ বাহিনী, ২৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স ও ২৩ ফিল্ড রেজিমেন্টের ওপর এখানকার অপারেশনের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। এদের দায়িত্বের মধ্যে ছিল সৈয়দপুরে অবস্থিত ৩য় ইস্ট বেঙ্গল, দিনাজপুরে সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ও রিজার্ভ কোম্পানি ইত্যাদিকে নিরস্ত্র করা; সীমান্ত আউটপােস্টে শক্তি বৃদ্ধি করা; রংপুর রেডিও এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখলে নেয়া; আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার করা; বগুড়ায় সংরক্ষিত অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ন্ত্রণে নেয়া ইত্যাদি।
রাজশাহী : ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে এখানে নিয়ােজিত করা হয়। এদের দায়িত্ব ছিল টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও রেডিও স্টেশন দখলে নেয়া; ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ও রিজার্ভ পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র করা; রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ করে মেডিকেল কলেজকে নিয়ন্ত্রণে নেয়া; আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার করা ইত্যাদি।
কুমিল্লা : ৫৩ ফিল্ড রেজিমেন্ট, ১মর্টার ব্যাটারিজ, স্টেশন ট্রপস ও ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের ওপর এখানকার অপারেশনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। তাদের দায়িত্বের মধ্যে ছিল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর উইং হেডকোয়ার্টার্স ও রিজার্ভ ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ বাহিনীকে নিরস্ত্র করা; টেলিযােগাযােগ
নিয়ন্ত্রণে নেয়া; আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার করা; শহরের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা ইত্যাদি।
সিলেট : ৩১ পাঞ্জাব কোম্পানির এক অংশকে এখানকার অপারেশনের দায়িত্ব দেয়া হয়। তাদের দায়িত্বের মধ্যে ছিল সিলেট রেডিও স্টেশন ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখলে নেয়া; সুরমা নদীর কিন ব্রিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা; সিলেট বিমানবন্দরের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা; আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার করা; ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সেকশন হেডকোয়ার্টার্স এবং রিজার্ভ পুলিশ ফোর্সকে নিরস্ত্রীকরণ ইত্যাদি।
চট্টগ্রাম : ২০ বালুচ, ৩১ পাঞ্জাব কোম্পানি ও ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের এক কলাম ভ্রাম্যমাণ সেনাসদস্যের ওপর এখানকার অপারেশনের দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। ভ্রাম্যমাণ কলামের মধ্যে ছিল ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, ভারী মর্টারবাহী ট্রপস, ফিল্ড কোম্পানি ইঞ্জিনিয়ার্স ইত্যাদি। এদের দায়িত্বের মধ্যে ছিল ইবিআরসি, ৮ম ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর-এর সেকশন হেডকোয়ার্টার্স এবং রিজার্ভ পুলিশ সদস্যদের নিরস্ত্র করা; সেখানকার কেন্দ্রীয় পুলিশ অস্ত্রাগার দখলে নেয়া; রেডিও স্টেশন ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ দখলে নেয়া; পাকিস্তানি নৌবাহিনীর কমােডর মমতাজের সঙ্গে লিয়াজোঁ রক্ষা করা; ৮ম ইস্ট বেঙ্গল-এর কমান্ডিং অফিসার্স শাইগ্রি ও জানজুয়ার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রক্ষা করা; ইবিআরসি-র ইনস্ট্রাক্টর এম আর চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা; আওয়ামী লীগ ও ছাত্রনেতাদের গ্রেপ্তার করা ইত্যাদি। উল্লিখিত এসব পরিকল্পনা থেকে দেখা যায় যে, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে অপারেশন সার্চলাইট কার্যকর করতে দায়িত্বে নিয়ােজিত সেনাসদস্যদের সাধারণ করণীয় বিষয়াবলির মধ্যে ছিল- স্ব-স্ব স্থানের ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি বাহিনীর বাঙালি সশস্ত্র সদস্যদের নিরস্ত্রীকরণ; টেলিফোন যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকরণ; যেখানে বিমানবন্দর রয়েছে তা দখলে নেয়া; অস্ত্রাগারের ওপর পূর্ণর্দখল প্রতিষ্ঠা করা; আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও অন্যান্য ছাত্রনেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা ইত্যাদি। ঢাকার বাইরে অপারেশন সার্চলাইট ও এর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ: পাকিস্তানি বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট অভিযান ঢাকার তুলনায় দেশের অন্যত্র কঠিন প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। এর মধ্যে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা (ব্রাহ্মণবাড়িয়া), সিলেট, পাবনা, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। সর্বপ্রথম প্রতিরােধ গড়ে ওঠে চট্টগ্রামে। ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপারেশন শুরুর পূর্বেই ইস্টপাকিস্তান রাইফেলস-এর চট্টগ্রাম হেডকোয়ার্টার্সের এডজুট্যান্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তাঁর ইপিআর-এর বাঙালি সৈনিক ও জেসিওদের নিয়ে পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন এবং সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন (দেখুন রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম)। ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে অনেক হানাদার সৈন্যকে হত্যা কিংবা বন্দি করতে তাঁরা সমর্থ হন। তখন ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের সিনিয়র বাঙালি অফিসার মেজর জিয়া তাঁর উধ্বর্তন পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জানজুয়ার নির্দেশে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সােয়াত জাহাজে করে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধারে পাের্টের দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে তাকে ফিরিয়ে আনা হয় এবং সবকিছু শুনে তিনি বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। তাঁর পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার জানজুয়াসহ আরাে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর চট্টগ্রাম শহর ক্যাপ্টেন রফিকের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং ২৮শে মার্চ পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এর ভেতর পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির নেতৃত্বে কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব প্রায় ১০০ মাইল। এ দীর্ঘ পথে ছিল অসংখ্য কালভার্ট ও ব্রিজ। পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য স্থানীয় জনগণ কালভার্ট ও ব্রিজের বড় অংশ ধ্বংস করে দেয়। ফলে পাকিস্তানি সেনারা বড় বাধার মধ্যে পড়ে। ২৬শে মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তানি হানাদাররা চট্টগ্রামের নিকটবর্তী কুমিরা নামক স্থানে পৌঁছে এবং সেখানেও বড় ধরনের প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়। এসব প্রতিরােধ উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত তারা চট্টগ্রাম পৌছাতে সক্ষম হয়। হেলিকপ্টারের সাহায্যে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রামে অবতরণ করে ক্যান্টনমেন্টে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চট্টগ্রাম শহরের ওপর তীব্র আক্রমণ পরিচালনা করে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বালুচ রেজিমেন্ট ২৯শে মার্চ ভােররাতে চট্টগ্রামের দামপাড়াস্থ পুলিশ লাইন্সের ওপর আক্রমণ চালায়। ভাের ৬টা থেকে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে পুলিশ লাইন্সের প্রতিরােধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। অনেক পুলিশ সদস্য শাহাদত বরণ করেন। ৩০শে মার্চ পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহর ও এর পার্শ্ববর্তী স্থানে ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বাধীন ইপিআর সদস্যদের সঙ্গে হানাদার বাহিনীর সংঘর্ষ চলে। এরপর ক্যাপ্টেন রফিক তাঁর ইপিআর সদস্যদের নিয়ে ভারতে চলে যান। এদিকে ২৬শে মার্চ সকালে মেজর জিয়া তাঁর বাহিনী নিয়ে কালুরঘাট ব্রিজের দিকে চলে যান। কালুরঘাট ব্রিজ সংলগ্ন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র তখন প্রতিরােধযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘােষণার বার্তা হাতে পান এবং ২৬শে মার্চ চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে প্রথম আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান ঐ বার্তা পাঠ করেন। এরপর আবুল কাশেম সন্দ্বীপ দ্বিতীয়বার ঐ বার্তা পাঠ করেন। ২৭শে মার্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের আহ্বানে মেজর জিয়াউর রহমান, বীর উত্তম- তৃতীয় ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন (দেখুন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র)। তখন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের নাম দেয়া হয়েছিল ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। ৩০শে মার্চ পাকিস্তানি বিমান বাহিনী এ বেতার কেন্দ্রের ওপর ব্যাপক বােমা হামলা চালায়। তাতে বেতার কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে এর সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত মেজর মীর শওকত আলী (পরবর্তীতে ৫নং সেক্টর কমান্ডার)-র নেতৃত্বে কালুরঘাট ব্রিজ ও তৎসংলগ্ন এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল।
ভৌগােলিক দিক বিবেচনায় কুমিল্লার অবস্থান ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে সড়ক পথে বন্দর নগরী চট্টগ্রামে যেতে পথিমধ্যে কুমিল্লা শহর। তাই অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পূর্বে প্রতিরােধকারীরা এ শহর ও এর আশেপাশে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর চলাচলের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। সকল প্রতিরােধ ভেঙ্গে ২৫শে মার্চ রাতেই ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কুমিল্লা শহরে প্রবেশ করে। তাদের আক্রমণের প্রধান টার্গেট ছিল পুলিশ লাইন্স। সেখানে তখন স্বল্প সংখ্যক পুলিশ উপস্থিত ছিলেন। তারা সাধারণ অস্ত্র নিয়ে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তাঁদের প্রতিরােধ ভেঙ্গে পড়ে। হানাদার বাহিনীর গুলিতে পুলিশের অন্তত ৩১ জন সিপাহি ও কর্মকর্তা শহীদ হন। হানাদার বাহিনীর দ্বিতীয় টার্গেট ছিল সার্ভে ইনস্টিটিউট প্রাঙ্গণে আনসার-মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এখানে ৩৫০ জন প্রশিক্ষণার্থী বাঙালি আনসার-মুজাহিদ ছিলেন। এঁদের প্রায় সকলে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম হত্যার শিকার হন। ২৭শে মার্চ কুমিল্লার ডেপুটি কমিশনার শামসুল হক খান এবং পুলিশ সুপার মুন্সী কবিরউদ্দিন আহমদকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে ময়নামতিক্যান্টনমেন্টে বন্দি করে রেখে ৩০শে মার্চ তাদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ২৯শে মার্চ ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে হানাদাররা ৩ শতাধিক লােককে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের যারা শিকার, তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত অন্যতম।
অপারেশন সার্চলাইট পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানি কমান্ডার মেজর শাফায়াত জামিলকে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এবং ২৪শে মার্চ অর্থাৎ অপারেশন শুরুর পূর্বের দিন মেজর খালেদ মােশাররফকে ২৫০ জন সেনাসদস্যসহ সিলেটের শমশের নগরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসে মেজর শাফায়াত জামিল ঢাকা ও দেশের অন্যত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫শে মার্চের গণহত্যা সম্পর্কে জানতে পারেন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সিদ্ধান্ত নেন। ২৭শে মার্চ তাঁর নেতৃত্বে বাঙালি সেনাসদস্যরা পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসার কর্নেল খিজির হায়াত খানকে অপর ২ জন অফিসারসহ বন্দি করে নিজেরা বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। একই দিন শমশের নগর থেকে মেজর খালেদ মােশাররফ তাঁর বাহিনী নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের সঙ্গে যােগ দেন এবং তাঁদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২য় বেঙ্গলের সৈন্যরা মেজর কে এম সফিউল্লাহর নেতৃত্বে বিদ্রোহ করে ময়মনসিংহ হয়ে ৩১শে মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে পৌঁছান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে এঁদের নেতৃত্বে সংগঠিত কঠিন। প্রতিরােধের সম্মুখীন হতে হয়। এপ্রিলের ৩য় সপ্তাহ পর্যন্ত অত্র অঞ্চল পাকহানাদারমুক্ত রাখা সম্ভব হয়। ১৩ই এপ্রিল থেকে ২৪শে এপ্রিল সময়ে একাধিকবার প্রতিরােধযােদ্ধাদের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আকাশ, নৌ ও স্থল পথে পরিচালিত তীব্র আক্রমণ মােকাবেলা করতে হয়। এক পর্যায়ে প্রতিরােধযােদ্ধারা অবস্থান ত্যাগ করে অন্যত্র সরে যান (দেখুন কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা ও শাফায়াত জামিল, বীর বিক্রম)।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ব থেকেই সিলেট সদরে পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সলিমুল্লাহ খানের নেতৃত্বে এক ব্রিগেড সৈন্য মােতায়েন ছিল। বাইরে থেকে আরাে সৈন্য যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে কিংবা শহরের পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতে বাইরে বের হতে না পারে, সেজন্য মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধযােদ্ধারা সদর উপজেলার সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়কের কয়েকটি ব্রিজ ধ্বংস করে দেন। তা সত্ত্বেও মৌলভীবাজার থেকে প্রায় ২ হাজারের মতাে পাকসেনা সিলেট সদরে অনুপ্রবেশ করে। ২৫শে মার্চ রাতে তারা সিলেট শহরে কার্ফ্যু জারি করে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর হত্যাকাণ্ড চালায়। সিলেটের সালুটিকর বিমান বন্দরে পাকসেনা বাহিনীর একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। ২৭শে মার্চ ৩নং ইপিআর উইংয়ের একটি কোম্পানি সুবেদার ফজলুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে ঐ ঘাঁটিতে আক্রমণ পরিচালনা করেন। পাকিস্তানি বাহিনী অনেক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়ে সিলেট শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ৩০শে মার্চ হানাদাররা খাদিমনগরে ইপিআর-এর উইং ব্যারাকে আক্রমণ চালিয়ে বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করে। তাদের এ আক্রমণকালে বেশকিছু ইপিআর সদস্য শহীদ হন। এদিকে ২৭শে মার্চ হবিগঞ্জে অবস্থানরত মেজর সি আর দত্ত (পরবর্তীতে ৪নং সেক্টর কমান্ডার) কর্নেল (অব.) আব্দুর রব এমএনএ ও মানিক চৌধুরী এমএনএ-এর সঙ্গে বৈঠক করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। এরপর তারা ইপিআর, পুলিশ, আনসার-মুজাহিদ, ছাত্র-যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীসহ একটি প্রতিরােধ বাহিনী সঙ্গে নিয়ে হবিগঞ্জ থেকে সিলেট অভিমুখে অগ্রসর হন। পথিমধ্যে রশিদপুর চা-বাগান ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি হানাদারদের হটিয়ে মৌলভীবাজার মুক্ত করে সিলেটের নিকটবর্তী শেরপুর ও সাদিপুরে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে কয়েকদিন ধরে যুদ্ধ করেন এবং হানাদাররা পরাস্ত হয়ে সিলেট শহরের দিকে পালিয়ে যায়। অতঃপর ৬ই এপ্রিল সিলেট শহর দখলের চূড়ান্ত যুদ্ধ হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের তীব্র আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা সিলেট শহরের ১৪ কিমি দূরে সালুটিকর বিমান বন্দর এবং ১০ কিমি-এর মতাে দূরে অবস্থিত লাক্কাতুরা চাবাগানে আশ্রয় নেয়। এভাবে এ দুটি স্থান ছাড়া ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত সিলেট শহরসহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার ওপর মুক্তিযােদ্ধাদের দখল প্রতিষ্ঠিত ছিল। বিমানে করে পাকিস্তানি সৈন্য বৃদ্ধি ও তাদের ভারী অস্ত্রের কাছে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে বেশিদিন টিকে থাকা সম্ভব হয়নি। সিলেট শহর পুনর্দখল করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালাতে থাকে (দেখুন সি আর দত্ত, বীর উত্তমও সিলেট সদর উপজেলা)।
২৫শে মার্চের পরপর ময়মনসিংহের ইপিআর উইংএর অবাঙালি সৈন্যরা বাঙালি ইপিআরদের হত্যা কিংবা বন্দি করার পরিকল্পনা করে। এটি বুঝতে পেরে বাঙালি ইপিআর ও জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করে আগত ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা সম্মিলিতভাবে সেখানে অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের পরাস্ত করে বাঙালি ইপিআররা নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন, যদিও তা বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পাবনায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর অন্যান্য সদস্যদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। পাবনায় ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানি ছিল। ইপিআর, পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার ও জনতার সমন্বিত একটি বাহিনী ২৭শে মার্চ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ওপর ব্যাপক আক্রমণ পরিচালনা করে। ২৮শে মার্চ পর্যন্ত সংঘর্ষ স্থায়ী হয়। উভয় পক্ষে বহু যােদ্ধা হতাহত হয়। বেসামরিক প্রতিরােধযােদ্ধারাও হত্যার শিকার হন। তবে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ও নিহতের সংখ্যা ছিল বেশি। প্রতিরােধযােদ্ধাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে অবশিষ্ট পাকিস্তানি হানাদাররা পাবনা থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে পালিয়ে যায়। ৩০শে মার্চ পাবনা শত্রুমুক্ত হলে বাংলাদেশের নামে পাবনাতে প্রথম বেসামরিক প্রশাসন চালু হয়। পাবনা ১০ই এপ্রিল পর্যন্ত হানাদারমুক্ত থাকে (দেখুন পাবনা সদর উপজেলা, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা- ও মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর)।
পাকহানাদার বাহিনীকে প্রতিরােধের লক্ষ্যে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পূর্বেই বগুড়ার পুলিশ লাইন্সের কর্মকর্তারা পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অস্ত্র বিতরণ করে প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ২৬শে মার্চ থেকে ৩১শে মার্চ পর্যন্ত প্রতিরােধ যুদ্ধ চলে। এ-সময়ে শহরের বিভিন্ন স্থানে এবং শহরের প্রবেশমুখে পাকহানাদারদের সঙ্গে প্রতিরােধযােদ্ধাদের একাধিক সংঘর্ষ হয়। এতে ৪৯ জন পাকসেনা নিহত হয়। অপরপক্ষে বেশ কয়েকজন প্রতিরােধযােদ্ধা শহীদ হন। ১লা এপ্রিল পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান পাকসেনাদের সমর্থনে শহরের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ব্যর্থ হয়। প্রতিরােধযুদ্ধে টিকতে না পেরে ১লা এপ্রিল পাকসেনারা রংপুরের দিকে পালিয়ে যায়। তবে প্রতিরােধযােদ্ধাদের এ বিজয় বেশিদিন ধরে রাখার সম্ভব হয়নি। কিছুদিনের মধ্যে পাকবাহিনী বগুড়া শহরে অনুপ্রবেশ করে বগুড়া সার্কিট হাউজ, সরকারি আজিজুল হক কলেজের নতুন ও পুরাতন ভবন, জেলা স্কুল, মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজ, এসডিও-র বাংলাে, বগুড়া রেল স্টেশন কলােনি, কটন মিল রেস্ট হাউজ এবং ভার্জিনিয়া টোবাকো কারখানায় ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর বিহারি ও স্থানীয় দালালদের সহযােগিতায় সংঘটিত করে একাধিক গণহত্যা (দেখুন বগুড়া সদর উপজেলা ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা)। রাজশাহীতে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল। উপশহরে অবাঙালি কলােনি এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটি ছাউনি ছিল। সেখানে কর্মরত ছিল ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ৫০০ সৈন্য এবং তাদের কমান্ডার ছিল অবাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফাকাত বেলুচ। রাজশাহী শহর থেকে ১৮ কিমি দূরে সরদহতে ছিল পুলিশ একাডেমি ও সরদহ ক্যাডেট কলেজ। ২৫শে মার্চ রাত ও ২৬শে মার্চ ভােরে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকার মতাে রাজশাহীতেও হত্যাকাণ্ড চালায়। ২৬শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজশাহী পুলিশ লাইন্সে প্রবেশের চেষ্টা করে। পূর্বপ্রস্তুতি থাকায় পুলিশ সদস্যদের প্রবল প্রতিরােধের মুখে তারা পুলিশ লাইন্সে প্রবেশে ব্যর্থ হয়। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈনিকরা শহরের প্রান্তে অবস্থান গ্রহণ করে। ২৮শে মার্চ বেলা ১টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশ লাইন্সের ওপর মর্টার শেলিং ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করে। রকেট লাঞ্চারের শেলের আঘাতে পুলিশ লাইন্সের ওয়ারলেস টাওয়ারটি ভেঙ্গে পড়ে, কয়েকটি ব্যারাকে আগুন ধরে যায়। এক পর্যায়ে প্রতিরােধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে এবং পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্য অন্যত্র নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যান। এ প্রতিরােধযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর অর্ধশত সদস্য ও কর্মচারী শহীদ হন। পুলিশ লাইন্সের অভ্যন্তরে তাঁদের সমাহিত করা হয় (দেখুন রাজশাহী মহানগর ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা)।
রাজশাহীতেও ইপিআর সদস্যরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল রাজশাহী শহরে। এর ২টি উইংএর একটি চাপাইনবাবগঞ্জ ও একটি নওগাঁতে ছিল। তিন স্থানেই বাঙালি ইপিআর সদস্যরা অস্ত্রাগার ভেঙ্গে যেসব অস্ত্র পাওয়া যায় তাই নিয়ে হানাদারদের মােকাবিলা করার চেষ্টা করেন। কিছু সময় গুলি বিনিময়ের পর চাঁপাইনবাবগঞ্জে অবাঙালি ইপিআর সদস্যরা তাদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় (দেখুন মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর)। ৬ই এপ্রিল বাঙালি ইপিআর সদস্যরা যৌথভাবে রাজশাহী শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনা ছাউনির ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে রাজশাহী শহরের দখল নেন। কিন্তু পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করে ১৩ই এপ্রিল আর্টিলারি ফায়ার ও জঙ্গি বিমানের সহায়তায় রাজশাহী শহর পুনর্দখল করে নেয়। এরপর নতুন করে শুরু হয় বাঙালিদের ওপর গণহত্যা, ঘরবাড়ি ও দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযােগ।
রংপুরে ছিল ইপিআর উইংএর হেডকোয়ার্টার্স। এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৩ ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার্সও ছিল। ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে এখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি ইপিআর ও নিরস্ত্র জনতার ওপর আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এখানকার ইপিআর-এর অন্যতম সহকারী উইং কমান্ডার নওয়াজেস উদ্দিন আহমেদ পূর্বেই এটি অনুমান করতে পেরে তাঁর বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যকে নিয়ে রংপুর শহর ছেড়ে তিস্তা নদীর অপর পাড়ে গিয়ে অবস্থান নেন। এদিকে যেসব ইপিআর সদস্য সরে যেতে ব্যর্থ হন, তারা পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে বন্দি, না হয় মর্মান্তিকভাবে নিহত হন। তিস্তা ব্যারেজের অপর পাড়ে অবস্থান নেয়া ইপিআরদের সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদারদের যুদ্ধ হয়। তাতে উভয় পক্ষে অনেকে হতাহত হয়। ২৮শে মার্চ ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ, সাঁওতাল সম্প্রদায় ও বিপুল সংখ্যক বিক্ষুব্ধ জনতা সম্মিলিতভাবে রংপুর পাকিস্তানি সেনা দপ্তর আক্রমণে এগিয়ে যায় (দেখুন রংপুর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ ও মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর)। শত্রুপক্ষ ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রতিরােধযােদ্ধাদের মধ্যে বহু সামরিক-বেসামরিক লােক তাদের নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হন।
সৈয়দপুর ছিল উর্দুভাষী বিহারি (অবাঙালি) অধ্যুষিত শহর। বিহারিরা ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একনিষ্ঠ সমর্থক। ২৫শে মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পূর্বের দিন অর্থাৎ ২৪শে মার্চ এখানে ব্যাপক বাঙালি-অবাঙালি সংঘর্ষ হয়। ২৫শে মার্চ সৈয়দপুর শহরের বাঙালি পুলিশ ব্যারাকে অবাঙালি ও পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিতে হামলা চালায়। বিকেল ৫টায় শহরে কার্ফিউ জারি করা হয়। সৈয়দপুর শহরে সেনানিবাস থাকায় পূর্ব থেকেই সেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ছিল। অপারেশন সার্চলাটের শুরুতেই সৈয়দপুরে তারা সৈয়দপুর দারুল উলুম মাদ্রাসা, সৈয়দপুর হাইস্কুল, সৈয়দপুর টেকনিক্যাল স্কুল এবং সৈয়দপুর পুলিশ ফাঁড়িতে ক্যাম্প স্থাপন করে। ২৬শে মার্চের পর পাকবাহিনী শহরের বাঙালিদের ধরে নিয়ে সৈয়দপুর হাইস্কুল ও সৈয়দপুর দারুল উলম মাদ্রাসায় ১২৫ জনকে হত্যা করে। কামারপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ গ্রাম তারা পুড়িয়ে দেয়। অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে প্রতিরােধযােদ্ধাদের মােকাবেলায় এখান থেকে পাকিস্তানি সেনাসদস্যদের দিনাজপুর ও আশেপাশের এলাকায় প্রেরণ করা হয়।
দিনাজপুরে ইপিআর বাহিনীর পক্ষ থেকে পাকহানাদারদের প্রথম প্রতিরােধের সম্মুখীন হতে হয়। দিনাজপুরে ইপিআর বাহিনীর একটি সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স ছিল। ঠাকুরগাঁও ও রংপুরে এর উইং ছিল। সীমান্তবর্তী এ সেক্টর ও এর উইংয়ের আওতাধীন একাধিক বিওপি ছিল। এ সেক্টর হেডকোয়ার্টার্স, উইং ও বিওপিগুলিতে পাকহানাদারদের সঙ্গে বাঙালি ইপিআরদের প্রতিরােধযুদ্ধ হয়। প্রতিরােধযােদ্ধাদের হাতে বহু পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। আক্রমণের আশঙ্কায় দিনাজপুর সেক্টরের সদর হেডকোয়ার্টার্সের বাঙালি ইপিআর সদস্যরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পূর্ব থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। ২৮শে মার্চ দিনাজপুর সার্কিট হাউজে অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদাররা ইপিআর হেডকোয়ার্টার্স কুঠিবাড়ির দিকে গােলাবর্ষণ করে। এরপর শুরু হয় পাল্টা আক্রমণ। অন্যান্য বাহিনীর সদস্যসহ ইপিআর, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিপুল সংখ্যক জনগণ সার্কিট হাউসের দিকে অগ্রসর হন। ২৯শে মার্চ পাকিস্তানি হানাদাররা রাতের আঁধারে দিনাজপুর থেকে পালিয়ে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। দিনাজপুর শহর ১৩ই এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত হানাদারমুক্ত থাকে। ১৪ই এপ্রিল পাকবাহিনী সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্যাংকসহ দিনাজপুরের দিকে অগ্রসর হয়। তারা বৃষ্টির মতাে গােলাগুলি করতে-করতে রাস্তার সমস্ত অবরােধ ভেঙ্গে এগিয়ে যায়। এ-সময় রাস্তার দুপাশের বাড়িঘরে আগুন দিয়ে ধ্বংসলীলা চালায় এবং শেষে দিনাজপুর শহরে অবস্থান নেয় (দেখুন দিনাজপুর সদর উপজেলা ও মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর)।
২৮শে মার্চ ঠাকুরগাঁও ইপিআর উইংএ বাঙালি ও অবাঙালি সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। তাতে বেশ কিছু পাকিস্তানি ইপিআর নিহত হয়।
২৫শে মার্চের কালরাতে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকা দখলে নেয়ার সঙ্গে-সঙ্গে কুষ্টিয়া আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ২৬শে মার্চ সারাদেশের ন্যায় কুষ্টিয়ায়ও কারফিউ জারি করা হয়। যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে ২৭ বালুচ রেজিমেন্টর ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার মেজর শােয়েব বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানি সেনাসদস্য নিয়ে ঝিনাইদহ অতিক্রম করে কুষ্টিয়া শহরে প্রবেশ করে। তারা জেলা স্কুল, পুলিশ লাইন্স, সদর থানা এবং ওয়ারলেস অফিসে ক্যাম্প স্থাপন করে। পাকসেনা কনভয় সারা শহর দাপিয়ে বেড়ায় এবং প্রতিটি অলি-গলিতে তাদের টহল চলতে থাকে।
এদিকে ২৬শে মার্চ ইপিআর-এর চুয়াডাঙ্গা ৪ নম্বর উইং-এর মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে তার সদর দপ্তরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৭শে মার্চ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও জনতার সম্মিলিত বাহিনী একই সঙ্গে তিনদিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান বাহিনীকে পরাস্ত করে কুষ্টিয়া শহর দখলের সিদ্ধান্ত নেয়। ইস্ট বেঙ্গল, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর দায়িত্ব ছিল সরাসরি পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করা। জনগণের দায়িত্ব ছিল। আক্রমণের সময় ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে পাকিস্তানিদের মনােবল ভেঙ্গে দেয়া। হানাদারদের বিরুদ্ধে এ-যুদ্ধে ইপিআরএর ৪র্থ উইং-এর ৫টি কোম্পানিকে দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়। ৩০শে মার্চ দুপুরের মধ্যে জেলা স্কুল ছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানকৃত পুলিশ লাইন্স, ওয়ারলেস, সদর থানা ও টেলিফোন এক্সচেঞ্জ সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত হয়। এরপর কুষ্টিয়া জেলা স্কুলকে চারদিক থেকে অবরুদ্ধ করে মাঝে-মাঝে ফায়ার করতে থাকেন ইপিআরসহ মুক্তিযােদ্ধারা। তিনদিন যুদ্ধ শেষে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতত্বে ১লা এপ্রিল কুষ্টিয়া হানাদারমুক্ত হয়। এখানকার প্রতিরােধযুদ্ধে ২০০ জনের অধিক পাকসেনা নিহত হয়। কিছু সংখ্যক সেনাসদস্য নিয়ে মেজর শােয়েব পলায়নকালে জনতার হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়। মধ্য-এপ্রিল পর্যন্ত কুষ্টিয়া মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে ছিল (দেখুন কুষ্টিয়া সদর উপজেলা, আবু ওসমান চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা)।
সড়ক ও রেলপথে আক্রমণে ব্যর্থ হয়ে পাকহানাদার বাহিনী আকাশপথে কুষ্টিয়া আক্রমণ করে। ১১ই এপ্রিল পাকিস্তানি বিমান বহর কুষ্টিয়া ও কুমারখালীর ওপর হামলা করলে তাতে বহু নিরীহ মানুষ মৃত্যুবরণ করে। ১২ই এপ্রিল পুনরায় বিমান হামলা হলে মুক্তিযােদ্ধাদের পাল্টা গুলিবর্ষণে একটি পাকিস্তানি জঙ্গি বিমান জেলখানার ওপর বিধ্বস্ত হয়। মধ্য-এপ্রিল বিমান বাহিনীর কভারে পাকসেনাদের পদাতিক বাহিনী যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে কুষ্টিয়া শহর দখলে নেয়।
২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যশাের সেক্টরের ইপিআর হেডকোয়ার্টার্সের ওপর গুলি ছােড়ে। বাঙালি ইপিআর সদস্যরা পাল্টা জবাব দেয়। এরপর অস্ত্রাগারের তালা ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের নিরস্ত্র ও বন্দি করে। এদিকে অপারেশন সার্চলাইট শুরুর কয়েকদিন পূর্বে ফিল্ড এক্সারসাইজের নামে বাঙালি সৈনিকদের যশাের ক্যান্টনমেন্টের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে তারা ঢাকা ও দেশের অন্যত্র পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপারেশন সম্পর্কে প্রথমে অবহিত ছিলেন না। এরপর ক্যান্টনমেন্টে ফিরিয়ে এনে তাঁদের নিরস্ত্র ও দরবার হলে একত্রিত করে হত্যার পরিকল্পনা করা হলে ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দীন, বীর বিক্রম ও সেকেন্ডে লেফটেন্যান্ট আনােয়ার হােসেনের নেতৃত্বে বাঙালি সৈনিকরা বিদ্রোহ করে অস্ত্র হাতে তুলে প্রতিরােধের চেষ্টা করেন। কিন্তু ভারী অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাঙালি সেনাসদস্যদের ওপর ব্রাশ ফায়ার করলে সেকেন্ড লে. আনােয়ার হােসেনসহ অনেকেই শহীদ হন। ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন ও অন্যান্য বাঙালি সেনারা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যশােরের চৌগাছায় গিয়ে একত্রিত হন এবং সেখান থেকে প্রতিরােধযুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। বাঙালি সৈন্যরা সেনানিবাস থকে চলে আসার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যশাের শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ, লুটপাট ও নারীদের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায় (দেখুন যশাের সদর উপজেলা ও মুক্তিযুদ্ধে ইপিআর)।
খুলনা পুলিশ লাইন্সের সদস্যগণ ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেন। এদিকে খুলনায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা ঐ রাতেই পুলিশ লাইন্সের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। ২৬শে মার্চ সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর পিপলস জুট মিলসের পুলিশ পােস্ট দখলের চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ২৭শে মার্চ সকালে খালিশপুর নৌঘাঁটির পাকিস্তানি গানবােট খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছাকাছি অবস্থান নিয়ে শহর এবং পুলিশ লাইন্সের ওপর শেলিং শুরু করে। অন্যদিকে, দৌলতপুরের দিক থেকে পাকসেনাদের একটি কনভয় পথে-পথে প্রতিরােধকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ ও তাদের দেয়া বেরিকেড গুঁড়িয়ে দিয়ে ২৮শে মার্চ খুলনা শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানি সেনাদের ত্রিমুখী আক্রমণের মুখে শহরের প্রতিরােধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ে। হানাদার বাহিনী শহরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। উল্লেখ্য, খুলনা শহরে ছিল পাকবাহিনীর এডহক ব্রিগেডের ৫নং উইং। এর নেতৃত্বে ছিল লে. কর্নেল শামস। তার অধীনে ছিল ২২ এফএফ রেজিমেন্ট ও ১০৭ পদাতিক ব্রিগেডের ২৫ বালুচ রেজিমেন্ট। ৩রা এপ্রিল মুক্তিযােদ্ধারা খুলনা শহরের নিকটবর্তী (বর্তমান খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন) গল্লামারিতে অবস্থিত রেডিও স্টেশন হানাদারদের দখলমুক্ত করতে এক অভিযান চালিয়ে তাঁরা ব্যর্থ হন। তখনকার নির্জন গল্লামারি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধকালে পাকহানাদাররা বিভিন্ন স্থান থেকে বহু লােকজন ধরে এনে নৃশংসভাবে হত্যা করে (দেখুন খুলনা সদর উপজেলা ও গল্লামারি যুদ্ধ)।
নদ-নদী বেষ্টিত বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা শহর (বর্তমানে বিভাগ) বরিশাল ২৪শে এপ্রিল পর্যন্ত হানাদারমুক্ত ছিল। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও গণপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে বরিশালের প্রতিরােধযােদ্ধারা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে স্বাধীন দক্ষিণ বাংলা সংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত এখানে সংগ্রাম পরিষদের পূর্ণ কর্তৃত্ব বহাল ছিল।
১৮ই এপ্রিল প্রথম পাকিস্তানি ৬টি জঙ্গি বিমান বরিশাল শহরের ওপর বােমা নিক্ষেপ এবং মেশিনগানের গুলিবর্ষণ করে অনেককে হতাহত করে। এরপর ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী জল, স্থল ও আকাশ পথে বরিশালের ওপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এদিন সকাল ১০টার পর থেকে তারা বরিশাল শহরের বিভিন্ন স্থাপনার ওপর ক্রমাগত বিমান হামলা চালায়। তারা শহরের উত্তর প্রান্ত সায়েস্তাবাদ এলাকায় হেলিকপ্টার থেকে প্যারাট্রুপার নামাতে থাকে। নদীপথে আগমনের সময় তারা চরবাড়িয়া ইউনিয়নে গণহত্যা চালায় এবং শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ করে। অপরদিকে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক দিয়ে অনেকগুলাে গাড়িতে করেও তারা শহরে প্রবেশ করে।
সন্ধ্যার মধ্যে পাকবাহিনী বরিশাল শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং প্রথমে ব্রজমােহন কলেজ, অশ্বিনী কুমার টাউন হল ও পরবর্তীতে জেলা স্কুল, ওয়াপদা কলােনি এবং ত্রিশ গােডাউন এলাকায় তাদের হেডকোয়ার্টার্স ও ক্যাম্প স্থাপন করে (দেখুন বরিশাল সদর উপজেলা ও মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ বাহিনীর ভূমিকা)। প্রথমদিকে এখান থেকে দক্ষিণ অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় তারা অপারেশন পরিচালনা করে। এক কথায়, অপারেশন সার্চলাইট ছিল বাঙালি জাতিকে সমূলে নির্মূলের লক্ষ্যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কর্তৃক প্রণীত মানব জাতির ইতিহাসে এক কলঙ্কিত গণহত্যার নীলনকশা। সে অনুযায়ী ৭১-এর ২৫শে মার্চ থেকে শুরু করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথায় পূর্ব বাংলায় নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও মানবতার বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার অপরাধ সংঘটিত করে। মহান মুক্তিযুদ্ধকালে বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বিশ্বজনমতের সমর্থন ও সহানুভূতির মূলে নারী-শিশু-বৃদ্ধ ও ধর্মনির্বিশেষে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর ঘৃণ্য গণহত্যা ও মানবতাবিরােধী অপরাধ ছিল অন্যতম বিবেচ্য বিষয়। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের এসব অপরাধের দায়ভার কোনােদিনও মােচন হওয়ার নয়। [হারুন-অর-রশিদ ও মােহাম্মদ সেলিম]
তথ্যসূত্র: Major General (Retd.) Khadim Hussain Raja, A Strange in My Own Country : East Pakistan, 1969-1971, Dhaka, The University Press Limited, 2012; Siddiq Salik, Witness to Surrender, Dhaka, The University Press Limited, 1997; বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ডেভিড ফ্রস্টের সাক্ষাত্তার (ঢাকা, ১৮ই জানুয়ারি ১৯৭২), দ্রষ্টব্য হারুন-অর-রশিদ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন : বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা, ঢাকা, নিউ এজ পাবলিকেশন্স ২০১২, পরিশিষ্ট-খ

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!