You dont have javascript enabled! Please enable it! অভয়মিত্র ঘাট ট্রান্সফরমার অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক

অভয়মিত্র ঘাট ট্রান্সফরমার অপারেশন

অভয়মিত্র ঘাট ট্রান্সফরমার অপারেশন (চট্টগ্রাম)। পরিচালিত হয় নভেম্বর মাসের শেষদিকে ট্রান্সফরমারের অবস্থান ছিল চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর সন্নিকটে। এখানে পাকবাহিনীর একটি ক্যাম্প ছিল। তাদের সহায়তায় এখানকার দালালরা মুক্তিযােদ্ধা চিহ্নিতকরণের নামে স্থানীয় মানুষদের প্রতিনিয়ত হয়রানি করত। কাউকে সন্দেহ হলে তাকে ধরে এনে নদীর পাড়ে বা ট্রান্সফরমারের সঙ্গে বেঁধে নির্যাতন করত। মাঝে-মধ্যে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে নদীতে ফেলে দিত। তাই পাকসেনা ও তাদের বাঙালি-বিহারি দোসরদের শাস্তি দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিযােদ্ধারা এ ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নভেম্বর মাসের শেষদিকে মুক্তিযােদ্ধারা অপারেশনের স্থানটি বেশ কয়েকবার রেকি করেন এবং অপারেশন পরিচালনার কৌশল নির্ধারণ করেন। স্থানটিতে লােকসমাগম ছিল বেশি এবং নদীর পাড়ে হওয়ায় তা নৌযাত্রীদের দৃষ্টিগােচর হতাে। ট্রান্সফরমার থেকে কিছুটা দূরে নদীর পাড়ে ছিল পাকসেনাদের ক্যাম্প। এখানে দুটি ট্রান্সফরমার ছিল – একটি ওপরে এবং অন্যটি নিচে। দুটির মধ্যে তারের সংযােগ ছিল। অভয়মিত্র ঘাট থেকে পূর্ব-পশ্চিমের ব্যাপক এলাকা এবং পাকসেনাদের ক্যাম্প বিদ্যুতের জন্য এই ট্রান্সফরমারের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ডা. মাহফুজুর রহমান ও সাব্বির নামে দুজন মুক্তিযােদ্ধা সিদ্ধান্ত নেন নিচের ট্রান্সফরমারে বা তৎসংলগ্ন কোনাে পাতে বিস্ফোরক বসানাে হবে। সে অনুযায়ী সাব্বিরের বাসা থেকে বিস্ফোরক তৈরি করে একটি সাধারণ মানের ব্যাগে করে অপারেশনস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়। নদীর পাড় ধরে একেবারে সাধারণ মানুষের বেশে মুক্তিযােদ্ধারা চলে আসেন ট্রান্সফরমারের কাছে। এর কিছু দূরে পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী অবস্থান করছিল। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের চিনতে পারেনি। কারণ তাদের ধারণা ছিল, মুক্তিযােদ্ধারা হবে পাকিস্তানি বাহিনীর মতাে সুসজ্জিত। তাই তারা ট্রান্সফরমারের দিকে যাওয়া এই দুজনকে সন্দেহ করেনি। ট্রান্সফরমারের গােড়ার দিকটা ছিল ঝােপ-জঙ্গলে ভরা। ডা. মাহফুজুর রহমান বিস্ফোরক নিয়ে ট্রান্সফরমারের পাশে ঝোপের আড়ালে প্রস্রাব করার ভঙ্গিতে বসে কৌশলে পাতের ওপর বিস্ফোরক বসান এবং তারের সংযােগ ঘটিয়ে ফিউজে আগুন লাগিয়ে দ্রুত সরে পড়েন। তারা নিরাপদ স্থানে পৌছানাের পরপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ট্রান্সফরমার দুটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। নদীর পাড়ে অবস্থানরত লােকজন আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সেখানে অবস্থানরত মিলিশিয়ারা পালাতে শুরু করে। নদীতে অবস্থানরত নৌকা ও জাহাজগুলাে নদীর দক্ষিণ পাড়ে চলে যায়। অপারেশনের ফলে নদীর পাড়ে অবস্থিত পাকসেনা, রাজাকার ও মিলিশিয়া বাহিনীর ক্যাম্পের অবস্থা খুবই নাজুক হয়ে পড়ে। অপারেশনের পর পাকবাহিনীর অনেক স্থলসেনা ও নৌসেনা এসে পুরাে এলাকা ঘিরে রাখে। স্থানীয় দোকানপাট সব বন্ধ হয়ে যায়। পুরাে এলাকার বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পাকসেনারা চারদিকে গুলি ছুড়তে থাকে। তাদের বাঙালি-অবাঙালি দোসররা পালিয়ে যায়। পরে জানা যায় যে, এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে পাকবাহিনী কয়েকজন রাজাকারকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়। এ অপারেশনকে কেন্দ্র করে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকসেনাদের ব্যাপক গােলাগুলি হয় এবং তাতে ১৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত ও ৩৫ জন আহত হয়। নিজেদের পক্ষে কোনােপ্রকার প্রাণহানি ছাড়াই মাত্র দুজন। মুক্তিযােদ্ধা এ অপারেশন সম্পন্ন করেন। এটি ছিল পাকবাহিনীর হৃৎপিণ্ডে আঘাত হানার মতাে একটি ঘটনা। পাকবাহিনীর স্থানীয় দোসররা এরপর এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ফলে এলাকায় বাঙালিদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধ হয়। এ ঘটনার পর পাকবাহিনী এখানে স্থলের পরিবর্তে জাহাজে অবস্থান নেয়। [সাখাওয়াত হােসেন মজনু]

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড