You dont have javascript enabled! Please enable it!

দেশাত্মবােধক ও উদ্দীপনামূলক গান ‘শােন একটি মুজিবরের থেকে’-র কণ্ঠশিল্পী অংশুমান রায়

অংশুমান রায় (১৯৩৬-১৯৯০) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভকারী দেশাত্মবােধক ও উদ্দীপনামূলক গান ‘শােন একটি মুজিবরের থেকে’-র কণ্ঠশিল্পী। যুদ্ধের প্রথম পর্যায় থেকে অসংখ্যবার শ্রুত এ গান রণাঙ্গনের মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে অনুপ্রেরণার এক অফুরন্ত উৎস ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী অংশুমান রায় অনন্যসাধারণ এ গান গাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু গােল্ড মেডেল এবং Friends of Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) লাভ করেন।
অংশুমান রায় ১৯৩৬ সালের ১৯শে আগস্ট পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রামপদ রায় এবং মাতার নাম বিভাবতী রায়। তিনি কুমুদ কুমারী ইনস্টিটিউট ও ঝাড়গ্রাম রাজ কলেজে অধ্যয়ন করেন। অল্প বয়স থেকে সঙ্গীতের প্রতি অংশুমানের প্রবল আগ্রহ ছিল। প্রথমে পিতার এক বন্ধুর কাছে এবং পরে বিখ্যাত সঙ্গীতগুরু পণ্ডিত জ্ঞান প্রকাশ ঘােষের কাছে তিনি সঙ্গীত বিষয়ক শিক্ষা গ্রহণ করেন। অংশুমান রায় এক সময় একজন ভার্সেটাইল সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। তার কণ্ঠে দেশাত্মবােধক গান, লােকগীতি, নজরুলগীতি ও ভক্তিমূলক গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। তাঁর গাওয়া গানের অসংখ্য ক্যাসেট ও সিডি বের হয়েছে। জনপ্রিয় এ শিল্পী পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সকল সঙ্গীত সাধক, সুরস্রষ্টা ও সঙ্গীতশিল্পীর সঙ্গে কাজ করেছেন।
১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর দেয়া সাতই মার্চের ভাষণ- কেবল বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষকে উদ্দীপ্ত, আলােড়িত ও প্রভাবিত করেনি, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদেরও বাংলাদেশের বাঙালিদের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে অনুপ্রাণিত করে। এ ভাষণের সংবাদ আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়। কিন্তু সেদিন আকাশবাণীর এক দল বাঙালি ঠিক করেন যে, রাতের খবরে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ভাষণের সঙ্গে গানও যুক্ত হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাঁরা কাজ শুরু করেন। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, দীপেন্দ্র গুপ্ত, অংশুমান রায়, দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাংলাদেশের শিল্পী কামরুল হাসান। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায়, দীপেন্দ্র গুপ্তের সুরে এবং অংশুমান রায়ের কণ্ঠে সৃষ্টি হয় বিখ্যাত ‘শােন একটি মুজিবরের থেকে’ গানটি। সেদিন রাতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের কিছু অংশ এবং কিছু গান নিয়ে সংবাদ পরিবেশিত হয়। প্রথম থেকেই গানটি সবার মনােযােগ আকর্ষণ করে। আস্তে-আস্তে এ গান রণাঙ্গনের সৈনিকদের উদ্দীপ্ত করার অব্যর্থ মন্ত্রে পরিণত হয়। কেবল মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও এখনাে এ গান বাঙালিদের অনুপ্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে। গানের লিরিক এ-রকম,

শােন একটি মুজিবরের
থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।
সেই সবুজের বুক চেরা মেঠো পথে
আবার যে যাব ফিরে, আমার
হারানাে বাংলাকে আবার তাে ফিরে পাব
শিল্পে-কাব্যে কোথায় আছ
হায়রে এমন সােনার খনি।
শােন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ ॥
বিশ্ব কবির সােনার বাংলা
নজরুলের বাংলাদেশ।
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।
জয় বাংলা বলতে মন রে আমার
এখনও কেন ভাবাে আবার।
হারানাে বাংলাকে আবার তাে ফিরে পাব
অন্ধকারের পূর্বাকাশে উঠবে আবার দিনমণি।
শােন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ ॥
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ ॥

মহান মুক্তিযুদ্ধে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ সরকার ২০১২ সালের ২৭শে মার্চ অংশুমান রায়কে Friends of Liberation War সম্মাননা (মরণােত্তর) প্রদান করে। ‘শােন একটি মুজিবরের থেকে’ গানের জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশায় ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু গােল্ড মেডেল লাভ করেন। প্রখ্যাত এ শিল্পী ১৯৯০ সালে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি ২ পুত্র ও ১ কন্যা সন্তানের জনক। তাঁর স্ত্রীর নাম কমলা রায়। [জালাল আহমেদ]।

সূত্র: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ জ্ঞানকোষ ১ম খণ্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!