বাঙলাদেশের মূলনীতি : গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা
জোটনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র
[নিজস্ব সংবাদদাতা]
গণ-প্রজাতন্ত্রী বাঙলাদেশ রাষ্ট্র গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের নীতির দ্বারা পরিচালিত হইবে। একচেটিয়া পুঁজি গড়িয়া উঠিতে দেওয়া হইবে না, মুষ্টিমেয় লোকের হাতে সম্পদের পাহাড় জমিবে না। রাজনীতির সহিত ধর্মের কোন সম্পর্ক থাকিবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করা চলিবে না।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ মুক্ত যশোরে তাঁহাদের প্রথম জনসভায় গত ১১ই ডিসেম্বর সরকারের এই সকল নীতি ঘোষণা করেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁহার ভাষণে বলেন যে, প্রাপ্ত বয়স্কের সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ পরিচালিত হইবে এবং দেশের অর্থনেতিক কাঠামো হইবে সমাজতান্ত্রিক। ব্যাঙ্ক, বীমা, ভারী ও মূল শিল্প জাতীয়করণ করা হইবে। পাট, চা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প- বাণিজ্য রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে আনা হইবে।
ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি বিস্তারিত বিশ্লেষণ করিয়া জনাব ইসলাম বলেন যে, সকল ধর্মের সমান অধিকার থাকিবে, ধর্ম বিশ্বাসের জন্য কাহাকেও নিগৃহীত হইতে হইবে না। ধর্মভিত্তিক ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হইবে।
সরকারের স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির কথা পুর্ণঘোষণা করিয়া জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ বলেন যে, ভারতের সহিত বাঙলাদেশের পারস্পরিক সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক থাকিবে। রক্তের বন্ধনে গড়িয়া ওঠা বাঙলাদেশ-ভারত মৈত্রীর বিরুদ্ধে মহল বিশেষের অপপ্রচার সরকার সহ্য করিবে না বলিয়া নেতৃবৃন্দ হুঁশিয়ার করিয়া দেন।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ তাঁহার ভাষণে দেশের পুনর্গঠনের কঠিন কাজে সকলকে আগাইয়া আসার আহ্বান জানান এবং শান্তি ও শৃংখলা দৃঢ়ভাবে রক্ষা করার আহ্বান জানান।
কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দের সফর
পাক হানাদার সৈন্যদের কবল হইতে যশোর শহর মুক্ত হওয়ার পর গত ১৪ই ডিসেম্বর বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির তিনি জন সদস্য কমরেড মণি সিং, কমরেড খোকা রায় ও কমরেড কবির আহমেদ যশোর শহর সফর করেন। তাঁহারা শহরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়া জনগণের সহিত আলাপ-আলোচনা করেন।
যশোর শহরে নূতন স্থাপিত কমিউনিস্ট পার্টির কার্যালয়ে নেতৃবৃন্দ স্থানীয় পার্টি কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহিত আলোচনা করেন।
ন্যাপের জনসভা
গত বুধবার যশোরের টাউন হল ময়দানে আয়োজিত এক বিরাট জনসভায় বাঙলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন যে, বাঙলাদেশকে সত্যিকার সুখী সমৃদ্ধিশালী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে গড়িয়া তুলিয়াই লক্ষ শহীদানের আত্মত্যাগকে সার্থক করিয়া তুলিতে হইবে।
সভায় বাঙলাদেশে আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ তাঁহার বক্তৃতায় ধর্মনিরপেক্ষতার বিশ্লেষণ দিয়া বলেন যে, এই নীতি সকল ধর্মের সমান অধিকারের সাথে সাথে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়সমূহকেও রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ বলেন যে, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির অর্থ শত্রু এবং মিত্র উভয়ের প্রতি নিরপেক্ষ থাকা নয়। তিনি বলেন, বাঙলাদেশের জনগণ তাহাদের মুক্তিসংগ্রামের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের বর্তমান সরকারের সঙ্গে মিত্র ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিকে একই দৃষ্টিতে দেখিতে পারে না। তিনি বলেন, আমাদের স্বাধীন ও জোটনিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতির ভিত্তিকে মজবুত করার জন্যই সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া ও উন্নয়নশীল দেশগুলির সহিত দৃঢ় মৈত্রীর সম্পর্ক গড়িয়া তুলিতে হইবে।
মতিয়া চৌধুরী
বাঙলাদেশের অগ্নিকন্যা ন্যাপ নেত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী বাঙলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় উপলক্ষে সংগ্রামী দেশবাসী, মুক্তিবাহিনী ও গেরিলা বাহিনীকে অভিনন্দন জানান এবং দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার লড়াইয়ে যাঁরা প্রাণ দিয়াছেন সেই অগণিত বীর শহীদদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সাহায্য ও সমর্থনের জন্য ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
মতিয়া চৌধুরী বলেন, বাঙলাদেশ হানাদারদের কবল মুক্ত হইয়াছে, কিন্তু উহার পুনর্গঠন, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন প্রভৃতি দুরূহ কাজ আমাদের সামনে রহিয়াছে। এই কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যে-সকল রাজনৈতিক দল বা শক্তি স্বাধীনতার সংগ্রামে রক্ত ঢালিয়াছেন তাঁহাদের একতা। তিনি বলেন, আসুন সকল সঙ্কীর্ণ দলাদলি ভুলিয়া আমরা সকলে কাঁধে কাঁধ মিলাইয়া স্বাধীন বাঙলাদেশকে সুখী সমৃদ্ধিশালী সত্যিকারের সোনার বাঙালা রূপে গড়িয়া তুলি— সকল প্রকার শোষণ পীড়নের অবসান ঘটাই।
সভায় সভাপতিত্ব করেন যশোর ন্যাপ সভাপতি জনাব আবদুর রাজ্জাক এবং বক্তৃতা করেন বাঙলাদেশ ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হোসেন, যশোরের ন্যাপ নেতা জনাব নুরুল ইসলাম ও কাজী আবদুস শহিদ।
সভায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য-সমর্থন দানের জন্য ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড প্রভৃতি রাষ্ট্রের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও অভিন্দন জানাইয়া প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। এক প্রস্তাবে পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন ইত্যাদি কঠিন সমস্যা সমাধানের জন্য মুক্তিসংগ্রামী সকল দলের সমন্বয়ে জাতীয় সরকার গঠন এবং সকল পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধ গণকমিটি গঠনের আহ্বান জানানো হয়।
প্রস্তাবে রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয় এবং তাহার জন্য আন্তর্জাতিক উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১ : ২৪ ॥ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন