You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ অর্থমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা

বাংলাদেশের জন্য সাহায্য চাওয়ার অধিকার ইসলামাবাদ সরকারের নেই মুজিবনগর, ১৮ই জুলাই — গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব এম, মনসুর আলী গতকাল সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দু’টি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সুতরাং, বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য চাওয়ার কোন অধিকার ইসলামাবাদ সরকারের নেই।
অর্থমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বিশ্বের যে সকল দেশ এবং সংস্থা পাক জঙ্গী পাক সরকারকে সাহায্য দিতে অস্বীকার করেছেন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে দৃপ্তকণ্ঠে আরও বলেন যে, একমাত্র সাড়ে ৭ কোটি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেই বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য আনতে পারে। তিনি আরও বলেন বস্তুতঃ ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্য করা মানেই হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যায় সক্রিয় অংশ নেয়া এবং বাংলাদেশ সরকার তা কিছুতেই বরদাস্ত করবেন না।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী তাঁর সারগর্ভ দীর্ঘ ভাষণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠন, বাংলাদেশের সীমিত পরিসরে সরকার কর্তৃক কতিপয় অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি গ্রহণের এবং বাংলাদেশের এই মুক্তিযুদ্ধে দেশবাসীর কতিপয় রূপরেখা বিশ্লেষণ করেন।
অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জনাব মনসুর আলী মুক্তিযুদ্ধে যে সব বাঙালি সন্তান জীবন দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সেইসব বীর শহীদানের পরিবারবর্গের ভরণ পোষণের দায়িত্বভার গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। তিনি আরও বলেন যে, মুক্তিযুদ্ধে যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়েছেন তাঁদের পরিবার বর্গকেও যথাসাধ্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার জন্য সরকার সমূহ চেষ্টা করবেন।
শত্রু কর্তৃক বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধার বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব বলে ঘোষণা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধোত্তর বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো প্রণয়নে যে কথাটি আমরা সব সময়ই মনে রেখেছি সেটি হচ্ছে; চরম দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এই মুক্তি সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহণ করেছেন। সুতরাং স্বাধীনতার ফল ভোগ করার তাঁদের সবারই রয়েছে। এবং সেই লাভ থেকে তাঁরা যাতে বঞ্চিত না হন তার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণেরও তিনি নিশ্চয়তা দান করেন।
হানাদার পাক দস্যু বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে যে সমস্ত দুস্কৃতিকারী বাস্তুত্যাগী বাঙালিদের বাড়ীঘর জোর করে দখল এবং ধনসম্পত্তি লুঠ করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে এবং প্রকৃত মালিককে তাঁর ধনসম্পত্তি অবশ্যই ফিরিয়ে দেয়া হবে।
তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আরও বলেন যে, জাতির এই চরম সঙ্কটময় মুহূর্তে নিঃসহায় মানুষের অধিকার যারা পশ্চিমী শত্রুর সহায়তায় কেড়ে নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বাঁচার কোন অধিকার নেই।
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী দেশবাসীর কর্তব্য ব্যাখ্যা করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপন্ন যাবতীয় দ্রব্য বয়কট, শত্রুর সাথে পূর্ণ অর্থনৈতিক অসহযোগিতা অব্যাহত এবং কলকারখানার চাকা বন্ধ রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি এককথায় শত্রুর অর্থনেতিক কাঠামো ভেঙ্গে দিয়ে তাকে কাবু করার আহ্বান জানান।
শত্রুকে খাজনা ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়া তিনি বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সেহেতু ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের যাবতীয় খাজনা ট্যাক্স একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেরই প্রাপ্য। কোন বিদেশী সরকারের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোন অধিকার নেই।
তিনি জনসাধারণকে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর জোর প্রদান, গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্প গড়ে তোলার, শত্রু কবলিত এলাকায় বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসলের উৎপাদন বন্ধ রাখার এবং গ্রামগুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ করার মাধ্যমে শত্রুর মোকাবেলা করার আহ্বান জানান।
জয়বাংলা ॥ ১ : ১১ ॥ ২৩ জুলাই ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!