অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ঘোষণা
এটা জনযুদ্ধ : ভাড়াটিয়া সৈন্যের যুদ্ধ নয়
এই সরকারের আয়ের কোন রকম সুনির্দিষ্ট বন্দোবস্ত নেই। শুধু মাত্র দান, শুধু মাত্র খয়রাত, শুধু মাত্র ঋণ, আর শুধু মাত্র কিছু কিছু বান্ধব মারফত টাকা সংগ্রহ করে কোন মতে সরকার চলছে। তাই আমাদের বীর যুবকেরা যারা প্রতি নিয়ত আজকে মুক্তি যুদ্ধে নাম লেখাবার জন্য ট্রেনিং গ্রহণ করতে বিভিন্ন অঞ্চলে এগিয়ে আসছেন, তাদের সবাইকে ট্রেনিং এর সুবন্দোবস্ত করা সম্ভবপর হয় নাই। কি করে এই সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে ভাল ট্রেনিং এর বন্দোবস্ত করা যায়, কি করে আমাদের বীর মুক্তি বাহিনীকে আরো জোরদার করা যায় আপনাদের মন্ত্রিসভার সদস্যরা সেই কথা আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আমি বিশ্বাস রাখি দেশ-প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আপনারা গঠনমূলক সমালোচনা দ্বারা ভবিষ্যত কর্মপন্থা নির্দ্ধারণ করবেন। আর মনে রাখবেন বর্তমান মুহূর্তে আমরা একটা যুদ্ধে লিপ্ত। যুদ্ধের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ঐক্যের। ঐক্যকে আজকে অটুট রাখতে হবে। সারা পৃথিবীর মানুষ যেন দেখতে যায় [পায়] আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরা, বঙ্গবন্ধুর শিষ্যরা, বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়করা এক প্রাণ এক মন হয়ে বাঙলার স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। ঐক্যের কোনরকম ফাটল ধরলে তার ফল হবে মারত্বক। কেউ কেউ বাইরে থেকেও নানা প্রকার প্ররোচানায় আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে চেষ্টা করতে পারে। সেই সমস্ত প্রচেষ্টাকে আমাদের বানচাল করে দিতে হবে। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি আমার মন্ত্রি সভার সদস্যরা মনে প্রাণে এক। তাদের প্রতিনিয়ত চিন্তা মাতৃভূমির স্বাধীনতাকে কি করে তরান্বিত করা যায়।
তাই বন্ধুরা, যে অটুট ঐক্য আজকে সরকারের মধ্যে বজায় আছে সেই অটুট ঐক্য আজকে আওয়ামী লীগের প্রতিটি নির্বাচিত সদস্য ও কর্মীদের মধ্যে গড়ে তুলতে হবে। বন্ধুরা, আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের প্রধান সেনাপতির বর্তমান রণকৌশলে আমাদেরকে গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয়েছে। এবং গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় জিনিষ হলো জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগীতা। আপনারা যারা প্রতিনিধি আপনাদের কাছে আমার আকুল আবেদন আমাদের গেরিলা যোদ্ধারা যে রণনীতি আর কৌশলে যুদ্ধ করে চলেছে, এই রণনীতি আর কৌশলে আপনারাই তাদের সর্বাধিক সাহায্য করতে পারেন জনগণের মনোবল অটুট রেখে আর সমর্থন বজায় রেখে।
আপনাদের মনে রাখতে হবে যারা বন্দুক নিয়ে লড়াই করছে তারাও যেমন মুক্তিযোদ্ধা, আমরা আপনারাও তেমনি মুক্তি যোদ্ধা। এটা জনযুদ্ধ, ভাড়াটিয়া সৈন্যদের যুদ্ধ নয়। এটা হচ্ছে People’s War এই People’s War এর People হচ্ছে সবচেয়ে Important factor.
আর সেই People কে সংঘবদ্ধ করার দায়িত্ব জনসাধারণের প্রতিনিধিদের মনে রাখতে হবে। প্রতিটি সৈনিককে জনতার বন্ধু ভাবতে হবে। নির্যাতীত, নিপীড়িত ও লাঞ্ছিত বাংলার মানুষ যেন ভাবে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, তাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের কর্মীরা, সৈনিকেরা তাদের বন্ধু। যেই বন্ধুত্ব আমরা পেয়েছি, সেই বন্ধুত্বকে অটুট রাখার জন্য আমাদেরকে দিনরাত নিরলস সংগ্রাম করে যেতে হবে। যদি আমরা জনগণের এই সমর্থনকে বজায় রাখতে পারি তাহলে আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি যে, আপনাদের বীর সৈনিকেরা, পৃথিবী যা ভাবছে, তার চেয়ে বহু আগে বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করবে।
বন্ধুরা আমার, মনে রাখবেন এই জনগণের সমর্থন আদায় করতে হলে আমাদের প্রত্যেকের চরিত্রে, প্রত্যেকের কার্যকলাপে জনগণের বন্ধু, জনতার বন্ধু, নির্যাতীত চাষীর বন্ধু বলে নিজেদের প্রমাণ করতে হবে। অত্যাচারী জোতদারদের বিরুদ্ধে আমরা নির্যাতীত চাষীর বন্ধু, অত্যাচারী মিলমালিকের বিরুদ্ধে আমরা নির্যাতীত শ্রমিকের বন্ধু। বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীর আমরা বন্ধু। এই বন্ধুত্ব প্রকাশের প্রধান উপায়ই হলো আওয়ামী লীগের প্রণীত ম্যানিফেষ্টোকে বার বার জনগণের সামনে তুলে ধরা আওয়ামী লীগ ভোট পেলে পরে যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি পালন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সে সমস্ত প্রতিশ্রুতি আমরা পালন করব। এই প্রতিশ্রুতি আমি জনগনকে নেতাদের মাধ্যমে দিয়েছি। আপনাদের প্রতি গ্রামে, গঞ্জে, বন্দরে, এই প্রতিশ্রুতি বার বার দিতে হবে। এই মুহূর্তে যে মুক্তি সেনানীরা যে অঞ্চলকে শত্রুমুক্ত করবে তমুহূর্ত্তে সেই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা, আপনারা অর্থনেতিক সামজিক সংস্কারের যে প্রতিশ্রুতি আমরা দিয়েছি, তাকে বাহ্য রূপ দেওয়ার সক্রিয় ভাবে কাজে নামবেন। মনে রাখতে হবে সেনাবাহিনী যুদ্ধে জয়লাভ করবে স্বাধীনতা তারা অর্জন করে দিবে। কিন্তু সেই স্বাধীনতাকে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক পটভূমিকায় রূপ দেওয়ার দায়িত্ব আপনাদের।
সেই দায়িত্ব আপনারা, আমরা যদি পালন করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যতে আমাদেরকে অনেকে আবার অনেক কথা বলার সুযোগ পাবেন। অনেক স্মৃতিকে মন্থন করে বহু ভুলের জন্য বহু প্রায়শ্চিত্ত্ব করতে হবে।
তাই বন্ধুরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের নীতি আদর্শে আপনারা অটল থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বিশ বছরের ক্রমাগত সংগ্রামের মধ্যে পরীক্ষা নিরীক্ষার ভিতর দিয়ে এই আদর্শকে আমরা আজকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরছি। অসাম্প্রদায়ীকতা বা ‘সেকুলারিজমের’ মহান আদর্শ বহু পরীক্ষা নিরীক্ষার পর আমার বিশ্বের কাছে তুলে ধরছি। এই একটি বিষয়ে আপনাদের অস্পষ্ট থাকতে হবে। কোন প্রকারে সাম্প্রদায়ীকতার মালিন্যে যেন আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দের নাম ফলনিবাত না হয় সে বিষয়ে আপনাদেরকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
গণতন্ত্র অর্থই হলো সাম্প্রদায়ীকতা যেখানে সাম্প্রদায়ীক ভেদ বুদ্ধি সেখানে গণতন্ত্র কোন দিন কার্যকারী হতে পারে না।
আজ আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলে অসাম্প্রদায়ীকতা বা সেকুলারিজমে বিশ্বাস করতে হবে। বাংলার প্রতি হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান যারা আছেন তাদের মধ্যে এ প্রত্যয় জন্মাতে হবে যে আপনারা সবারই বন্ধু। আর ভবিষ্যৎ বাংলার সুখের সবাই আপনারা রূপ দিতে যাচ্ছেন।
বন্ধুরা আমার, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক কাঠামোতে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক পদ্ধতি আমরা বহু পূর্বেই গ্রহণ করেছি। এ প্রশ্নে কারো মনে সন্দেহ থাকা উচিৎ নয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত যে দেশ আপনারা ভবিষ্যতে পাবেন সেই দেশকে গড়ে তুলতে হবে। ব্যক্তিগত মালিকানা হ্রাস করতেই হবে। এই যুদ্ধ বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে যদি গড়ে তুলতে হয় তা’হলে পরে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে অর্থনৈতিক মালিকানা অর্জন করে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির মাধ্যমে আপনাদেরকে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হতে হবে।
বন্ধুরা আমার, আদর্শের উপর ফাটল যেন না হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলার বাঙালির জন্য আমাদের নিবেদিত প্রাণ। বাংলার বাঙালির স্বার্থে পৃথিবীর যে দেশের সঙ্গে যে কোন জায়গায় বন্ধুত্ব করা দরকার তা আমরা করব। বিশ্বের কোন রাষ্ট্রের কাছে যত বড় রাষ্ট্রই হোক আমরা আভ্যন্তরিণ বা বাহ্যিক কোন দাসত্ব লিখে দেই নাই। ভবিষ্যতেও দেব না। জাতীয় স্বাধীনতার প্রয়োজনে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ সবারই সঙ্গে আমরা আমাদের নিজস্ব স্বার্থে বন্ধুত্বের নীতি গড়ে তুলব। এর নামই হচ্ছে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি বিশ্বের নির্যাতীত মানুষের প্রতিটি জাতীর স্বাধীনতাকে অর্জন করার জন্য আমরা সেই সমস্ত জাতীর পাশে দাঁড়াব। বহু রক্তের বদলে, বহু দুঃখের রজনী পার করে আমরা মেনেছি স্বাধীনতার লড়াই কি? আমরা মেনেছি সাম্রাজ্যবাদীরা যারা এখনও পৃথিবীর দিকে দিকে বিভিন্ন জাতীকে পদানত করে রেখেছে সেই সমস্ত পদদলিত জাতীর বুকের মর্মজ্বালা কি তা আমরা উপলব্ধি করেছি।
বন্ধুরা আমার, এ উপলব্ধি কার না হয়। কিন্তু অনেকেই ভুলে যায়। একদিন আমেরিকাকে বৃটিশের রাজ্যের অধীন থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে হয়েছিল। বোষ্টনের বন্দরে যেদিন জাহাজ ডুবিয়ে দিল। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের এবং জর্জ ওয়াশিংটনের ওসি ঝলসে উঠল বোষ্টনের তীরে তীরে। আর জেফারসনের বলিষ্ঠ কণ্ঠে যে দিন মানবতার জয় গান গাইল, সেদিনের আমেরিকা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করেছিল। তাহলে কেন আজ সাম্রাজ্যবাদ ইয়াহিয়ার জন্য অস্ত্র আসছে। এই ব্যথা বেদনার সাথেই স্মরণ করি বলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে আপনাদের তরফ থেকে মনের বেদনা প্রকাশ করেছি আর প্রতিবাদ জানাচ্ছি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে।
বন্ধুরা আমার, বহু সংগ্রামের ভিতর দিয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে তার জাতীয় স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধার করতে হয়েছিল। জারের অত্যাচার সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত পরবর্তিকালে হিটলারের আক্রমণ তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে বীর রুশ জাতীর লোকেরা জাতিয় স্বাধীনতার স্বর্ণশিখরে উপস্থিত হয়েছিল। সেই জন্য আপনাদের মাধ্যমে আর একবার আমি মহান রুশ জাতির কাছে আবেদন জানাই। তারা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াক। চিরকাল বাংলার মুক্তিকামি মানুষ সোভিয়েত রাশিয়ার মানুষকে স্মরণ করবে।
জয়বাংলা ॥ ১ : ১৪ ॥ ১৩ আগষ্ট ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন