বাংলার পবিত্র ভূমি থেকে শত্রুকে উৎখাত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে
—সৈয়দ নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দেন নিম্নে তার পূর্ণ বিবরণ প্রদত্ত হল :
আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরা ও আমাদের মুক্তি বাহিনীর মহান বীর সেনারা—
প্রথমে জানাই আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন ও সশ্রদ্ধ সালাম। আজ রক্তাক্ত পঁচিশে সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছ’মাস পূর্ণ হলো। আজ থেকে ঠিক ছ’মাস আগে পঁচিশে মার্চ তারিখে গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে বর্বর হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের উপর বীভৎস হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল। সেদিন থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই। স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই ছ’মাস সময়ের মধ্যে যে সব নিরীহ ও নিরস্ত্র বাঙালি ভাই-বোনেরা আত্মহুতি দিয়েছেন এবং যে সব মুক্তিসেনা তপ্ত লহুর মাঝ দিয়ে শাহাদত বরণ করেছেন প্রথমে তাঁদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই-এ এঁদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এর সঙ্গে সঙ্গে আমার সরকারের তরফ থেকে আমি যে প্রতিকুল অবস্থার মধ্য থেকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত আমাদের মুক্তিবাহিনী বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন তাতে সমগ্র সভ্য জগত স্তম্ভিত হয়ে পড়ছে। বিশ্বের মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসে আপনারা উজ্জ্বল নক্ষত্র। আপনাদের মৃত্যু নেই। আপনারা মহান ও অমর। আমার সরকার ও বাঙালি জাতি এই জন্য গর্ব অনুভব করছে।
এটা আমাদের জীবন মরণের যুদ্ধ
আজকে জাতির উদ্দেশ্যে দুটো কথা বলতে যেয়ে বারবার দখলীকৃত এলাকার ছাত্র- জনতা, কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী-মধ্যবিত্ত লাখ লাখ বাঙালিদের দুর্বিষহ জীবনের চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আপনাদের দুঃখে আমরা ব্যথিত। তবুও আপনারা যেভাবে মুক্তি যুদ্ধে সহযোগিতা করছেন তা আমাদের অবিভূত করেছে। তাই আমরা সর্বশক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করবার জন্য মরণপণ লড়াই-এ ঝাঁপিয়ে পড়েছি। জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা যখন যুদ্ধকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, তখন আমরা সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছি। বাঙালির একতা, অটুট মনোবল, অদম্য সাহস আর দেশপ্রেমই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা লড়াই-এর মূলমন্ত্র। আজ বাংলাদেশের পথে প্রান্তরে একটা দানবীয় পশু শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের তাজা তরুণ প্রাণগুলি রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাঝ দিয়ে বিজয়ের বরমাল্য আনতে শুরু করেছে। এই যুদ্ধ আমাদের জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ—এই যুদ্ধ বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা-কৃষক-মজদুরের জীবন-মরণের যুদ্ধ। তাই এ যুদ্ধ এখন জনযুদ্ধ। ছ’মাসের মধ্যে আমাদের অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্যে শত্রুপক্ষ হতভম্ব, বিপর্যস্ত ও তাদের মনোবল নিঃশেষিত।
সামরিক শাসকচক্র ভেবেছিল মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই তারা কার্য্য সমাধা করতে পারবে এবং পাকিস্তানের ‘ঘরোয়া ব্যাপার’ বলে বিশ্ব-বিবেককে বুঝাতে পারবে। কিন্তু কোনটাই আর বাস্তবে পরিণত হয়নি। ছ’মাসের মধ্যে তারা পরিস্থিতি আয়ত্বে আনতে পারেনি এবং বিশ্ব জনমতকেও বিভ্রান্ত করতে পারেনি। বরঞ্চ ছ’ মাসের মুক্তিযুদ্ধের খতিয়ান করলে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে আমাদের মহান মুক্তি সেনারা প্রতিটি সেক্টরেই অবিশ্বাস্য রকমের সফলতা অর্জন করেছে।
‘সমগ্র বিশ্ব আমাদের সংগ্রামের যৌক্তিতা উপলব্ধি করেছে’
প্রেসিডেন্ট বলেন—
শত্রু বাহিনীর চলাচল পথ বিকল করে দেওয়ার জন্য যোগাযোগ ব্যবস্থা বিছিন্ন করে দিয়েছে। রসদ সরবরাহ পথ রুদ্ধ করার জন্য রেল যোগাযোগ ও সড়ক পথ ও নদী পথে আক্রমণ তীব্রতর করে তুলেছে। আমাদের বিশেষ বাহিনী চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে শত্রুর অস্ত্র ও রসদবাহী জাহাজ ধ্বংস করে দিচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর এইসব গেরিলা সৈন্যদের ওপর এ মর্মে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, “শত্রুর উপর আঘাত হানো এবং সরিয়ে পড়ো’ এই নীতি চালিয়ে যাও। বীর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর অস্ত্র দখল করে সুদীর্ঘ ছ’মাস কাল ধরে সাহসিকতার সঙ্গে কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আমার সরকার ও বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে তাঁদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। ইতিহাসের পাতায় এই সংগ্রামী যুদ্ধের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
হানাদার বাহিনী আজ বিপর্যস্ত
সর্বাধুনিক মরণাস্ত্রে সজ্জিত শত্রু সেনাদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের এই বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আঘাতে আঘাতে হানাদার সৈন্যরা আজ বিপর্যস্ত—তাদের মনোবল নিঃশেষিত। জেনারেল ইয়াহিয়ার সেনাদল এখন ক্ষয়িষ্ণু। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তি বাহিনীর শক্তি দিন দিন বেড়েই চলেছে। পদ্মা, মেঘনা যমুনা, কর্ণফুলীর বীর সন্তানেরা দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে শামিল হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক ও আমাদের নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকেরা স্বাধীন বাংলার পতাকার নীচে এক কাতারে শামিল হয়েছে। তাদের ইস্পাত কঠিন ঐক্যই আজ মুক্তিবাহিনীকে আরও দুর্বার ও অজেয় শক্তিতে পরিণত করেছে।
নৌ ও বিমান বাহিনীর প্রস্তুতি চলছে
পদাতিক বাহিনী ছাড়াও আমাদের নৌ ও বিমান বাহিনীর বীর সৈনিকরা শত্রুর উপর আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
বাংলাদেশের সর্বত্র শহরে গঞ্জে, বন্দরে গ্রাম বাংলার প্রতি পথে প্রান্তরে আমাদের গেরিলা সৈন্যরা মৃত্যুর সংগে পাঞ্জা লড়ে যেভাবে হানাদার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে চলেছে, তাতে আমরা বিরাট গর্ব অনুভব করছি। এর মধ্যেই আমাদের মুক্তিবাহিনী ভারী অস্ত্র ব্যবহারেও পারদর্শী হয়ে উঠেছে। ইশা খা, তিতুমীর, কেদার রায়, সূর্য্য সেনের ঐতিহ্য বহনকারী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের আদর্শে অনুপ্রাণিত আমাদের মুক্তি বাহিনীর সম্মুখে একটি মাত্র লক্ষ্য। সেটা হচ্ছে বাংলার বুক থেকে হানাদার সৈন্যদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া। আমার স্থির বিশ্বাস, যে আন্তরিকতা, নিষ্ঠা, ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমাদের জোয়ানরা লড়াই করে চলেছে তাতে সেই সুদিন খুব শীঘ্রই এসে হাজির হবে। আমি আবার আমাদের মুক্তি বাহিনীকে জানিয়ে দিতে চাই, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী সন্তান আজ ইস্পাত কঠিন শপথে আপনাদের পিছনে রয়েছে। বাঙালি আপামর জনসাধারণ চরম ত্যাগের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
‘মুক্তি সংগ্রামে আমরা আজ একা নই’
বাংলাদেশের স্বাধীনতাই আজ সবার কাছে সব চেয়ে বড় কথা। বাঙালী মাত্রই আজ মুক্তি সেনা।
দেউলিয়া হওয়ার পথে জান্তা
জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা দেউলিয়া হওয়ার মুখে। অন্তঃকলহে তারা বিপর্যস্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছে। সেখানকার অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ হওয়ার দরুন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের বাজার হাতছাড়া হওয়ার দরুণই আজ পশ্চিম পাকিস্তানে এ ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। তাই আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানী জিনিসপত্রের উপর বয়কট অব্যাহত রাখুন। সামরিক জান্তা বাংলাদেশের পাট, পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়া ইত্যাদি বিদেশে রফতানী করতে না পেরে বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বিশ্বের দরবারে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়াম এখন এই সামরিক জান্তাকে আর অর্থ সাহায্য বা ধার হিসাবে টাকা দিচ্ছে না। এ ছাড়া মনে রাখা প্রয়োজন, যে কোন দেশের সরকারের পক্ষে শুধুমাত্র বিদেশি সাহায্য ও ধারের উপর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। উপরন্তু এই সামরিক জান্তা নিজেরাই দেড় হাজার মাইল থেকে একটা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে জনসাধারণের মাঝেও নৈরাশ্য ও হতাশ দিন দিন দানা বেঁধে উঠেছে। সত্তুরের নির্বাচনে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল। আজ তারা দেখতে পাচ্ছে তাদের সন্তানরা সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের লড়াই ও ২২ পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় প্রাণ দিচ্ছে।
সে কারণে আজ পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচ, সিন্ধি ও পাঠানদের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা জেগে উঠছে। তাই আমরা দেখতে পাই বেলুচ ও পাঠান সৈন্যদের সাথে পশ্চিম পাঞ্জাবী অফিসারদের সংঘাত শুরু হয়েছে। পাঞ্জাবের কৃষক শ্রমিকেরা, যারা সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিগত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল তাদেরও মোহমুক্তি ঘটতে শুরু করেছে। আমি বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী নির্যাতিত মানুষদের আশ্বাস দিতে পারি, পাঠান বেলুচ ও সিন্ধি জনগণ যদি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে বাংলার সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত মানুষ তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াবে। পশ্চিম পাঞ্জাবের কৃষক শ্রমিকেরা যদি তাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই শুরু করে তাহলে বাংলার নির্যাতিত কৃষক শ্রমিকেরা তাদের সহানুভূতি জানাবে। তাই আজকের দিনে আমি পশ্চিম পাকিস্তানী সর্বহারা মানুষদের জানাই সামরিক জান্তা নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য আপনাদেরও শোষণ করে চলেছে। আপনাদের মিথ্যে ধোঁকা দিয়ে বাঙ্গালীদের উপর তারা যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এ লড়াইয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কিছু লাভ হবে না।
ঘরোয়া ব্যাপার আর বাজারে বিকাচ্ছে না
সত্যিকারভাবে বলতে গেলে আজকে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতি পদে পদে আমাদের শত্রু জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা শুধু দুর্বল হয়েই পড়েছে না, বাংলাদেশের ব্যাপারটাকে ‘ঘরোয়া ব্যাপার’ দেখাবার জন্য সারা পৃথিবী-ব্যাপী তারা যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সমগ্র বিশ্বজনমত আজ বাংলাদেশের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বুদাপেস্টের শান্তি সম্মেলন, সিঙ্গাপুরে পার্লামেন্টারী সম্মেলন এবং নয়াদিল্লীতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যোগদানকারী সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ের সপক্ষে রায় দিয়েছে। ওয়াসিংটন, নিউ ইয়র্ক, অটোয়া, লন্ডন, বৈরুত, হংকং, ম্যানিলা, টোকিও সর্বত্রই আজ নানা ধরনের সভা ও শোভযাত্রা জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের কয়েক শ’ সদস্য কয়েক দফাই একযোগে ইসলামাবাদের শাসকচক্রের বিরুদ্ধে ধিক্কার দিয়েছেন। বৃটিশ পার্লামেন্টে এর মধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশ ইস্যু আলোচিত হয়েছে। সীমান্ত অতিক্রমকারী বাঙালী শরণার্থী এবং অধিকৃত এলাকায় কোটি কোটি আমার ভাই-বোনেরা যে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে, তাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসবার জন্য সকলের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
…..তাদের প্রতি আমার আশ্বাস
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আজকে যারা অসহায় অবস্থায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, সে- সমস্ত বন্ধুদেরকে আমি আশ্বাস দিতে পারি আমাদের তরফ থেকে আমরা দ্রুত অধিকৃত এলাকাকে শত্রুমুক্ত করার সাথে সাথেই তাদের দুঃখ-দুর্দশা মোচন সম্ভব হবে অন্যথায় তাদের দুঃখ-দুর্দশা মোচন সম্ভবপর নয়। এতদ্সত্ত্বেও বিদেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে যে-সব সাহায্য বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় পাঠানো হয়েছে, আমরা শুনে ব্যথিত হয়েছি, দুঃখিত হয়েছি এবং আশ্চর্যান্বিত হয়েছি যে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক কর্তৃপক্ষ সে-সব সাহায্য থেকে আপনাদের বঞ্চিত করে তা হানাদার বাহিনীর কাজে লাগিয়েছে। এমনকি এ-সব সাহায্য দ্রব্য সরবরাহের জন্য যে-সব যানবাহন বিদেশ থেকে এসেছে সে-সব হানাদার সৈন্যদের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি রাষ্ট্রসংঘ ও বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি।
দেশকে শত্রু মুক্তির জন্য চালান হচ্ছে সমস্ত প্রচেষ্টা
সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী ভাই-বোনেরা আমার, আপনাদের সমর্থনপুষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার দেশকে শত্রুর কবজামুক্ত করবার জন্য সমস্ত রকমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই সরকারের প্রতিনিধিরা জাপান, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, সিংহল, নেপাল, লেবানন, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের সপক্ষে জনমত গড়ে তোলবার জন্য সফর করছে।
এই সমস্ত সফরের ফলে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যে সাড়া পেয়েছি তাতে বিশ্বাস করবার কারণ ঘটেছে যে, বিশ্বের ছোট বড় বহু দেশ অচিরেই সক্রিয়ভাবে আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসবে।
আমরা আজ আর একা নই
এর মধ্যেই সোভিয়েট রাশিয়া বাংলাদেশ ইস্যুতে তাঁদের বক্তব্য ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট পদগণী এবং আফগানিস্তানের রাজা জাহীর শাহের যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে মত প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোও আমাদের প্রতি সমর্থনের মনোভব প্রকাশ করেছেন। তা ছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, আফ্রিকা ও লেটিন আমেরিকার কোন কোন দেশ আমাদের স্বপক্ষে কথা বলেছেন। এ সমস্ত বিশ্ব রাষ্ট্রগুলো আজকে আমাদের সংগ্রামের সত্যতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কেন না আমাদের সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম ঘোষিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করার সংগ্রাম।
ইয়াহিয়ার নতুন ধোঁকাবাজী
তাই আজ অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা বিশ্বজনমতকে ধোঁকা দেওয়ার ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় বেসামরিক শাসন চালু হয়েছে বলে একটা মুখোস পরাবার চেষ্টা করছে। ডাক্তার মালিককে গভর্ণর নিয়োগ করে, নির্বাচনে পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলির অধিকার বা সদস্য নিয়ে একটি মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছে। এর পেছনে দুটো মাত্র উদ্দেশ্য রয়েছে। এক নম্বর হচ্ছে, বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিয়ে বোঝানো যে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর দুই নম্বর হচ্ছে, বেসামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লোভ দেখানোর প্রচেষ্টা। অথচ কার্যক্ষেত্রে এটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। জঙ্গী নায়ক ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক সহচরেরা পর্যন্ত এই লোভ দেখানো প্রহসনকে স্বীকার করে নিতে পারেননি। স্বয়ং ভূট্টো সাহেব এই লোভ দেখানো বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠাকে একটি ভাঁওতা বলে উল্লেখ করেছেন। এমন কি চরম দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী রহমত এলাহী বলেছেন এ ধরণের বেসামরিক সরকার না হবে গণপ্রতিনিধিত্বমূলক, না হবে জনপ্রিয়। এর দ্বারা কোন কাজই সফল হবে না।
ইয়াহিয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ
বন্ধুরা আমার, এই লোক দেখানো সরকার প্রতিষ্ঠা করে ইয়াহিয়া খান মনে করেছিলেন যে, বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে একটা বিরোধ সৃষ্টি করবেন, এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে একটা ভাঙন ধরাবেন। ইয়াহিয়া খানের এ প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ লোক দেখানো সরকারের সদস্য কারা? বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ তা জানেন। পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য নিয়ে যে মন্ত্রীসভা আজকে ইয়াহিয়া সাহেব গঠন করেছেন সে মন্ত্রীসভার সদস্যদের, আর যে গভর্ণর তিনি নিয়োগ করেছেন সেই ডাক্তার মালেক সাহেবকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, আপনারা বলেছেন যে, আপনারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনছেন কিন্তু আপনারা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাংলাদেশে যে ভয়াবহ অবস্থা নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে তার কি কোন কৈফিয়ত আপনারা দিতে পারবেন? মালেক সাহেব গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণ করার পর কুমিল্লা জেলার কসবা, চৌদ্দগ্রাম, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় বিগত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম থেকে যে ভয়াবহ নরহত্যা ঘটেছে তার কি কোন কৈফিয়ত মালেক সাহেব দিতে পারবেন? নির্মমভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু কুমিল্লার পূর্বাঞ্চলেই নয়, সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলে বিগত ১৮ই আগস্ট থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চলেছে তার খবর কি মালেক সাহেব রাখেন? শত শত নারীকে আজকে আবার নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়েছে। বাঙ্গালী মা-বোনদের ইজ্জাত রক্ষা করতে যারা পারবে না, বাংলার নিরীহ মধ্যবিত্ত চাষীর জীবনকে যারা বাঁচাতে পারবে না, বাংলাদেশের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার তাদের নেই। বাংলাদেশের মানুষ ঘৃণা ভরে ইয়াহিয়া খানের এই পুতুল সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি বিশ্বাস করি তাদের সঙ্গে জনগণ কোন ভাবেই সহযোগিতা করবে না।
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন ধরাতে ইয়াহিয়া খান শুধু ব্যর্থই হন নাই, তার সমস্ত প্রচেষ্টাকে আজ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যারা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগের ৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের সদস্য পদ বহাল রেখে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করবেন। কিন্তু দেশবাসী ভাইয়েরা আপনারা শুনে সুখী হবেন যে, আপনাদের নির্বাচিত সদস্যদের অধিকাংশই এখন মুক্ত এলাকায় এসে স্বাধীনতার সংগ্রামে শরিক হয়েছেন। বাকী সদস্যরা আত্মগোপন করে মুক্তি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে চলেছেন। আমি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের এ সমস্ত সংগ্রামী পরিষদ সদস্যদের তাঁদের ত্যাগ তিতিক্ষা এবং ঘোষিত স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে শরিক হবার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি।
আমি দেশবাসী ভাইদের এ আশ্বাস দিতে পারি যতদিন পর্যন্ত না বাংলার মাটি থেকে হানাদার বাহিনী উৎখাত হবে, যতদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন পর্যন্ত আপনাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আপনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করে যাবেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা তাঁদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শ এবং নীতিতে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করে গেছেন। যে গণতন্ত্র বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা, বহু মনীষীর ত্যাগ ও তিতীক্ষা আজও পৃথিবীতে স্বীকৃত এবং রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠতম আদর্শ হিসেবে পরিগণিত সেই গণতন্ত্রের লড়াই আজকের বাংলাদেশের ভূমিতেই চলছে।
সেই গণতন্ত্রের লড়াই-এ ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজ ফ্যাসিস্ট সরকারের কারাগারে বন্দী। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা, গণতন্ত্রের মহান সাধক বাঙ্গালীর প্রাণ প্রিয় নেতা জনাব শেখ মুজিবর রহমানকে আজকে এক প্রহসনমূলক বিচারে শাস্তি দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের সরকার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর বিচারের ধৃষ্টতা দেখিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ধিকৃত হয়েছেন।
গণতন্ত্রকামীদের প্রতি আহ্বান
বাংলাদেশের ভাই-বোনেরা আপনাদেরকে আমি সুস্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই পৃথিবীর ছোট বড় সমস্ত রাষ্ট্রই এই বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ করেছেন। আমি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর তরফ থেকে ইয়াহিয়া খানকে সাবধান করে দিতে চাই যে বঙ্গবন্ধুর মিথ্যা প্রহসনমূলক বিচার যদি আপনি চালিয়ে যান এবং বঙ্গবন্ধুকে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রিয়তম নেতার যদি আপনি কোন ক্ষতি করেন তা’হলে বাংলার মানুষ এ অন্যায়কে সহ্য করবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের গণতন্ত্রকামী সমস্ত মানুষের কাছে আকুল আবেদন জানাই—যারা গণতন্ত্রের সংগ্রামে আজকে লিপ্ত আছেন সে সমস্ত মানুষের কাছে আমি ফরিয়াদ করি ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া সরকারের কারগারে আবদ্ধ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রকামী নেতার মুক্তির জন্য আপনারা আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসুন এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রিয় নেতাকে তাদের মধ্যে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করুন। সে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে আমি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে আবেদন জানাই অবিলম্বে বাংলাদেশে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি, বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার বাহিনী প্রত্যাহার এবং এই যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের পর্য্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন অন্যথায় আমাদের মুক্তিবাহিনী দুর্বার গতিতে হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেশকে মুক্ত করবেই। সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ ধরণের রক্তপাতের মধ্য দিয়েই তা বাস্তবে পরিণত হবে। কেননা স্বাধীনতা, শান্তি ও গণতন্ত্রের লড়াই-এ আমরা সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি।
আমাদের জয় সুনিশ্চিত। বিশ্বের ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি দেশবাসী ভাইদের জানাতে চাই যে আমরা শান্তিপূর্ণ সমঝোতার মাঝ দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ বৈঠক উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল আমার সরকারের পক্ষ থেকে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরে গিয়ে হাজির হয়েছেন। আমি আশা করি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির প্রয়োজনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পৌঁছাবোর জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন।
সার্বিক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত
বন্ধুরা আমার, জাতিসঙ্ঘে শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা সার্বিক লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত। আমাদের শক্তি এখন দিন দিনই বেড়ে চলেছে।
দেশবাসী, ভাই-বোনেরা, আপনারা মনে রাখবেন বিশ্বের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ কখনো বিফলে যায়নি। উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আলজেরিয়ার বীর জনতা সফলকাম হয়েছে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সাইপ্রাসের বীর জনতা সফলকাম হয়েছে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ভিয়েতনামীরা সফলকাম হয়েছে। এই সফলতার জন্য আজ চাই সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঐক্য। বাংলাদেশের এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আজ প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইয়াহিয়ার বর্বর ফ্যাসিস্ট সরকার আর তার বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি সারা বাঙ্গালী জাতি। তাই বন্ধুরা এবং ভাইয়েরা— দল, মত, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে আমি সমস্ত বাঙ্গালী জাতির কাছে আবেদন জানাই আপনারা ঐক্যবদ্ধ হউন, কঠিন সংগ্রামের শপথ নিন। আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার, ফ্যাসিস্ট, সাম্রাজ্যবাদী ইয়াহিয়া সরকারকে নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য দুর্বার গতিতে এগিয়ে যান।
শত্রু সেনাকে নির্মূল করতে হবে
বন্ধুরা আমার, বীর মুক্তি সেনানী ভায়েরা আমার, তোমাদের স্মরণ রাখতে হবে এই মুক্তিযুদ্ধে হয় আমরা জয়লাভ করবো, নয় জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো।
মধ্যবর্তী কোন অবস্থা নেই। যে বর্বর সেনাদল আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, যে বর্বর হানাদার বাহিনী আজও আমার দেশের শত শত মা-বোনকে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আটকে রেখে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছ সেই নির্মম সেনাবাহিনীকে সমূলে উৎখাত না করা পর্যন্ত, আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা না করা পর্যন্ত আমাদের কোন প্রকার বিশ্রাম থাকতে পারে না।
আপোষ নেই
বাংলার সংগ্রামী কৃষক ভায়েরা—আপনাদেরকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের মেহনতের ফলে ২৩ বছর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী লুটেরারা শোষণ করে নিয়েছে। আর আপনারা অসহ্য দুঃখের মধ্যে জীবন যাপন করেছেন। হানাদার বাহিনী বাংলার গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে আজকে আপনাদের ঘরবাড়ি ধুলিসাৎ করে দিয়েছে। আপনাদেরকে তারা শেয়াল কুকুরের মতো হত্যা করেছে। এমনকি আমি নিজে জানি, অনেক পরহেজগার মুসলমান যাদেরকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে তাদেরকে দাফন-কাফন পর্যন্ত করতে দেয় নাই। অনেক ধর্মপ্রাণ হিন্দুকে শ্মশানের চিতায় শুইয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবারও সুযোগ দেয় নাই। বাংলার কৃষক জনতা, এই বর্বর বাহিনীর সঙ্গে আমাদের কোন আপোষ হতে পারে না।
বাংলার শ্রমিক ভাইয়েরা, তোমাদের মেহনতের সব ফসল বাইশ পরিবার লুটে খেয়েছে। সেই বাইশ পরিবারের অর্থনৈতিক শোষণকে চুরমার করে স্বাধীন বাংলার বুকে এক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্ত্তন করার জন্য আমি এবং সরকারের প্রতিনিধিরা আমরা লড়ে চলেছি। তাই বাংলার মহান শ্রমিকেরা, তোমাদের কাছে আমি আহ্বান জানাই তোমাদের মেহনতের ফসলকে যারা শোষণ করেছে সেই বাইশ পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় যে সেনাবাহিনী আজ তোমাদের উপর আঘাত হেনেছে তাদের প্রতি প্রতিঘাত হানার জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে তোমরা শরীক হও, দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাও।
বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা, বাইশ তেইশ বছর পর্যন্ত বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিকাশের পথে যে পশ্চিম পাকিস্তানী কুচক্রীরা একটার পর একটা ষড়যন্ত্র করে চলেছে সে ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে দিয়ে বাঙ্গালী সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের জন্যেই আজকে স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা লিপ্ত হয়েছি। এই বাংলার অধ্যাপক, বাংলার শিক্ষক, বাংলার সঙ্গীত শিল্পী, বাংলার নাট্য-শিল্পী, বাংলার সাংবাদিক সহ সকল শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের কাছে আমি আকুল আবেদন জানাই এই সংগ্রামে আপনাদের লেখনী, আপনাদের প্রতিভা, আপনাদের চিন্তাধারা আজকে মুক্তি সেনানীদের বিপুল- বিজয়কে এগিয়ে নিয়ে যাক। আপনারা পিছনে পড়ে থাকবেন না, কারণ আগামী দিনের ইতিহাসে আপনাদের নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাক এই আমরা চাই।
সংগ্রামী ছাত্র সমাজ
বাংলার ছাত্ররা, ২৩ বৎসর পর্যন্ত তোমরা সংগ্রামের পুরোভাগে ছিলে। সালাম, বরকত, রফিক যেদিন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিলো সেদিন থেকে বার বার বাংলার সংগ্রামী ছাত্ররা তোমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছ। ৬২ সালের আন্দোলন, ৬৯ সালের মহান আন্দোলনে তোমরা ছিলে অগ্র-সেনানী। আমি জানি আজকের এই মহান মুক্তি যুদ্ধে তোমরা সংগ্রামের পুরোভাগে। আমি জানি আজকে তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ছেড়েছ, স্কুল ছেড়েছ, কলেজ ছেড়েছ; বাপ-মায়ের স্নেহের কোল ছেড়ে আজকে বাংলার পথে- প্রান্তরে তোমরা মুক্তি সেনানীদের অগ্রভাগে লড়াই করে চলেছ। তোমাদেরকে আমার অসীম ভালবাসা ও সঙ্গে সঙ্গে আমার সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাই।
বাংলার ছাত্র-যুবকেরা! যে স্বাধীনতার লড়াই আজ চলেছে সে স্বাধীনতার লড়াই সফল হলে ভবিষ্যতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হবে—সে বাংলাতেই তোমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে। মানুষের মতো বাঁচতে পারবে। অন্যথায় তোমাদের গোলাম হয়ে গোলামীর জীবন যাপন করতে হবে।
তরুণ ভাই-বোনেরা, ভবিষ্যৎ তোমাদের। আমাদের দিন গত প্রায়। আমরা যারা আজ বয়সে প্রবীন হয়ে গেছি আমরা জানি জীবনের মাত্র অবশিষ্ট কয়েকটি দিন আমাদের বাকী আছে। তোমাদের ভবিষ্যতের জন্যেই আজকে জীবনের সুখ-সম্পদ ছেড়ে আমরা গৃহহারা, সর্বহারা হয়ে আজকে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
ঐতিহাসিক দায়িত্ব
ভাই, বন্ধুরা—সংগ্রামী ছাত্ররা, যুবকেরা, আজকে তোমাদের মধ্যে আর আমাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। আমি তোমাদের কাছে আকুল আবেদন জানাবো, ইতিহাসের এই যুগ সন্ধিক্ষণে আজকে যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব তোমরা মাথায় তুলে নিয়েছ সে দায়িত্বকে পালন করার জন্য তোমরা দীপ্ত গতিতে এগিয়ে যাও। ইনশআল্লাহ তোমাদের প্রতি আল্লাহ সহায় আছে। জয়লাভ তোমরা করতে পারবে।
বাংলার মা-বোন
সর্বশেষ আমি বাংলার মা-বোনদের উদ্দেশ্যে দু’টি কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের মা-বোনেরা, বহু অশ্রু আপনাদের চোখ গড়িয়ে পড়ছে আমি জানি। আমি জানি আপনার বোনরা যখন বেইজ্জতি হয়েছে আপনার সামনে কি মর্মস্তুদ মর্মবেদনায় আপনার বুক জ্বালা করেছে। কি অসহনীয় অপমানে আপনি ঘরের ভেতর এবং বাইরে ঘুরেছেন। আপনার সন্তানদেরকে আপনি রণক্ষেত্রে পাঠিয়েছেন, আপনাদের বুক আপনারা খালি করেছেন। কিন্তু মা-বোনেরা, বীর সন্তানের মা হওয়ার যে সৌভাগ্য সে সৌভাগ্যের অধিকারী আপনারা হয়েছেন। আপনার যে সন্তান আজকে বাংলার পথে-প্রান্তরে লড়াই করে চলেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আজ যারা বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে দিচ্ছে মা-বোনেরা মনে রাখবেন এরা সারা বাঙালি জাতির সন্তান। আমি আপনাদের কাছে সবিনয়ে আবেদন করবো, আপনারা এদের জন্য গর্ব অনুভব করুন। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
অন্ধকার রজনী অবসান প্রায়
বাংলাদেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষেরা—আপনাদের দুঃখ, আপনাদের কষ্ট, আপনাদের আজকের ত্যাগ ও তিতীক্ষা শুধু শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেই ভুল করা হবে। আমরা আপনাদের এখন পর্যন্ত কোন স্বস্তি, কোন শান্তি দিতে পারিনি। সে অপরাধ যদি আমাদের হয়ে থাকে, সে অপরাধে আমরা অপরাধী। সে বিচার আপনারা করবেন। কিন্তু বাংলার মানুষেরা আপনাদেরকে আমি আমার সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দিতে পারি আপনাদের চোখে-মুখে হাসি ফুটাবার জন্য, আপনাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে সুখী করার জন্যে আমরাও সারা বাঙালি জাতির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে চলেছি।
বাংলাদেশের ভাই-বোনেরা, ন্যায়ের সংগ্রাম কোনদিন ব্যর্থ হয় নাই। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম কোনদিন ব্যর্থ হবে না। আঁধার রজনীর বিভীষিকা আমরা পার হয়ে এসেছি। বন্ধুরা আমার যে বিভীষিকাময় রাত্রির ওপারে আজকে নতুন সূর্য্য উদয় হচ্ছে, সে নতুন সূর্যালোকে যেদিন সারা বাংলার প্রান্তর উদ্ভাষিত হবে সেদিন আমি বিশ্বাস করি সেদিন বাঙালি জাতি মাথা তুলে দাঁড়াবে। আর পৃথিবীর যেখানে যারা আজো বাঙালি জাতির বৃহত্তর ত্যাগ সম্পর্কে কোন সন্দেহ পোষণ করেন সেদিন তাদের মোহমুক্তি ঘটবেই ঘটবে।
সমস্ত দেশবাসীর জন্য আমি আমার তরফ থেকে, সরকারের তরফ থেকে আবার জানাই ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর সালাম। ইনশআল্লাহ জয় আমাদের হবেই। জয় বাংলা
জয়বাংলা ॥ ১ : ২২, ২৩, ২৪ ॥ ৮, ১৫, ২২ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন