You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.25 | কোন রকম সাহায্য দিয়ে পাকিস্তানের রক্তপিপাসু সামরিক সরকারকে শক্তিশালী না করার জন্যে বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান | জয়বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

কোন রকম সাহায্য দিয়ে পাকিস্তানের রক্তপিপাসু সামরিক সরকারকে
শক্তিশালী না করার জন্যে বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের প্রশাসনিক কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ ও পরিপূর্ণ আত্মমর্যাদার মধ্য দিয়ে একটা জাতি হিসাবেই আমরা বাঁচতে চাই—এই অটুট বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়েই আমাদের মুক্তিবাহিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন-পণ লড়ে যাচ্ছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ গত ১৩ই জুন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি সংগ্ৰামী মানুষের উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে এ কথা বলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীর জওয়ানদের অতুলনীয় সাফল্য বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র পেলে ইনশাল্লাহ অচিরেই আমাদের মুক্তিবাহিনী দেশ থেকে দু’জন সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধকে অধিকতর সুসংগঠিত ও জোরদার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন দুনিয়ার বৃহৎ শক্তি বর্গের কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যও বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাশক্তি এখানে স্থায়ী হবে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বেতার ভাষণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন বলেন, জনসাধারণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারই দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম দেশের পুষ্পপত্রের মত এ মাটি থেকে উদ্ভুত। যে অসহনীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যকে বিপর্যস্ত করেছিল, সেই সম্পর্কের অবসান ঘটাবার জন্য জনসাধারণের ইচ্ছা থেকে এর উৎপত্তি। একে ভারতের প্ররোচনা বলে পাকিস্তান যে প্রচারণা চালাচ্ছে, তা তার সুপরিচিত কৌশল। বাংলাদেশের সকল সম্পর্কেই এইরূপ প্রচারণা হয়েছে; এতে আর কেউ কান দিচ্ছে না।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১১ সপ্তাহের দুর্বার সংগ্রামের পর্যালোচনা করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, দখলকারী শত্রুরা এক নিদারুণ অবস্থায় পড়েছে। তাদেরকে লোক ও রসদ আনতে হয় বিমান পথে কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে। আমাদের মুক্তিবাহিনী আবার প্রত্যহ আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুতর বিপর্যয় ঘটাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, হানাদারদের ভীতি প্রদর্শন ও প্রলোভন সত্ত্বেও কোথাও এখনও বে-সামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু হবার কোন লক্ষণ নেই, কলকারখানার চাকাও ঘোরেনি।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সুপরিকল্পিত হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের নীতি গ্রহণ করে তারা নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে মানুষের শত্রু ও সভ্যতার শত্রুরূপে। তাদের আর জনসাধারণের মাঝে রয়েছে ঘৃণার সমুদ্র সমান ব্যবধান।
বৃহৎশক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে তাঁরা যেন রক্তপিপাসু সামরিক একনায়কত্ববাদকে আর শক্তিশালী না করে তোলেন।
বাংলাদেশ থেকে দখলদার সামরিকবাহিনী তুলে না নেওয়া পর্যন্ত ইসলামাবাদ সরকারকে কোন রকম সাহায্য না দেওয়ার জন্য তিনি বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানান।
তিনি আরও বলেন, ইসলামাবাদকে কোন রকম সাহায্য দেবার অর্থ পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা এবং সে শক্তি বাংলাদেশের মানুষকে দমন করার কাজেই শুধু ব্যবহৃত হবে।
মুসলিম বিশ্বের প্রতি আবেদন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বাংলাদেশের ইসলামী ন্যায়-নীতির জন্য যুদ্ধ করছে, এরকম ধারণা হয়ে থাকলে তা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক। কারণ, জনসাধারণের ইচ্ছা ও মানবাধিকারকে বর্বরোচিতভাবে দমন করে ইয়াহিয়া ইসলামের দোহাই পাড়ছে।
তুর্কী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বের মুক্তি সংগ্রামের উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুসলিম তুর্কীদের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তাঁরা মুক্তিসংগ্রাম করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই তারই অনুরূপ। বাংলাদেশের আপামরজনতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, বীরত্ব ও দেশপ্রেমের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক সৈন্যবাহিনীকে বীরত্বের সাথে বাধা দিয়ে তাঁরা পৃথিবীর সকল দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের হৃদয়কে সাড়া দিয়েছেন এবং তাঁদের শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, একদিকে লুণ্ঠনের পাশবিক লোভ, অন্যদিকে একটি জাতির স্বাধীনতা লাভের দুর্বার আকাঙ্খা। এই যুদ্ধে জয় আমাদের হবে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই।
জয়বাংলা (১) ॥ ১ : ৭ ॥ ২৫ জুন ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন