You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.01 | আমাদের প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী | স্বদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

আমাদের প্রধান সেনাপতি : জেনারেল ওসমানী

বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মহম্মদ আতাউল গনী ওসমানীর নাম আজ বাংলার ঘরে ঘরে গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে। আত্মত্যাগ ও নিষ্ঠা এবং সর্বোপরি দৃপ্ত ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের জন্য বাংলার এই চিরকুমার প্রধান সেনাপতি সকলের কাছে সুপরিচিত। আজ তিনি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরোভাগে এসে দাঁড়িয়েছেন। তাঁর সবল নেতৃত্বে হাজার হাজার বাঙালি এগিয়ে চলেছে জয়যাত্রার পথে। নব জনগণ বাংলার নতুন উষার পথে।
জাতিগত অধিকার এবং গণস্বার্থ আদায়ের জন্য যে সজাগ দৃষ্টি এবং সংগ্রামী মানসিকতার প্রয়োজন, বাঙালিদের মধ্যে সেই উপলব্ধিকে জোরদার করার জন্য জেনারেল ওসমানী অক্লান্ত পরিশ্রম করে যান তাঁর কর্মজীবনের প্রথম থেকেই।
১৯৫১ সালের শেষের দিকে জেনারেল ওসমানী কর্তৃক ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করার পর থেকে রেজিমেন্টের ইতিহাসে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়। বাঙালিদের সামরিক বাহিনীতে না নেওয়ার জন্য বাঙালি বিদ্বেষী স্বার্থ সংশ্লিষ্টমহল ‘বাঙালিরা সামরিক জাতি নয়’ এই মর্মে যে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছিল সেটাকে প্রতিরোধ করার জন্য তিনি প্রাণমন ঢেলে দেন ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সর্বত্বক উন্নতি সাধন ও মান উন্নয়নের জন্য। কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সকল রকমের বিঘ্ন সৃষ্টি করা সত্ত্বেও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করে এই রেজিমেন্টকে একটি সংগ্রামীযোদ্ধদল হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। যার ফলে যুদ্ধ কৌশল এবং বীরত্বের দিক থেকে ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানের বেলুচ এবং পাঞ্জাব ইত্যাদি সকল দলের মধ্যে নিজেদেরকে শ্রেষ্ঠ প্রতীয়মান করে। এই ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট একরকম বলতে গেলে, জেনারেল ওসমানীর নিজের হাতে গড়া। তাঁরই প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে। তারই প্রতিফল আমরা দেখি ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের লাহোর রণাঙ্গনে। সেই যুদ্ধে বীরবিক্রমে লড়াই করে লাহোরকে রক্ষা করে এই বাঙালিরাই।
বাঙালিদের সম্পর্কে পাঞ্জাবী চক্রের মিথ্যা প্রচারণার অবসান ঘটানো এবং সেনাবাহিনীতে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জেনারেল ওসমানী থাকতেন সকলের পুরোভাগে। এই জন্য তিনি পাকিস্তান সামরিক চক্রের বিরাগভাজন হন। সামরিক শিক্ষা ও কর্মদক্ষতার দিক থেকে তাঁর সমকক্ষ সেনাপতি পাকিস্তানে কেউ নেই, তবু তার পদোন্নতি বন্ধ করে দেয়া হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে তদানীন্তন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে জেনারেল ওসমানীই সর্বকনিষ্ঠ মেজর হিসাবে নিযুক্ত হন। বাঙালি অফিসারদের সব সময়ই পাকিস্তানে দাবিয়ে রাখা হয়। তিনি নিজের ভবিষ্যত এবং কর্তৃপক্ষ থেকে সম্ভাব্য সকল রকম বিপদ উপেক্ষা করে এই সব বাঙালিদের উন্নতির জন্য লড়াই করে গেছেন। আর বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা এবং তাদের হয়ে সংগ্রাম করার কারণে তাঁকে সামরিক কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বিভিন্নভাবে পর্যুদস্ত হতে হয়।
সাধারণ সৈনিকদের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম হে এবং বাংলার মানুষ তথা বাংলার ভাষার প্রতি তাঁর ভালবাসার প্রমাণ নিােক্ত দুটি ঘটনা থেকেই মেলে। সামরিক বাহিনীতে উর্দ্ধতন অফিসারদের কাছে সুবেদার মেজরদের দৈনন্দিন একটা রিপোর্ট দেওয়ার রেওয়াজ আছে। পাকিস্তান বাহিনীর নির্দেশ হচ্ছে, এই রিপোর্ট একমাত্র উর্দুতেই দেওয়া চলবে। জেনারেল ওসমানী এই সর্বপ্রথম তাঁর সুবেদার মেজরকে বাংলায় রিপোর্ট দেয়ার অনুমতি দেন। এই জন্য পাকিস্তান সামরিকচক্র তাঁর কাছ থেকে কৈফিয়ৎ দাবী করে, এবং তিনিও তার যথাযোগ্য জওয়াব দেন।
আর একটি ঘটনা হয়ত অনেকেরই জানা নেই। জেনারেল ওসমানী এক দানপত্রে তার সকল সম্পত্তি ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রতি এবং বাঙালি বাহিনীর প্রতি তাঁর আন্তরিক প্রীতির পরিচয় এখানেই পাওয়া যায়।
জেনারেল ওসমানী ১৯১৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর পূর্ব-বাংলার সিলেট জেলার সুনামগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্বপুরুষ শাহ নিজামউদ্দিন ওসমানী হজরত শাহজালাল সহ গৌরগোবিন্দ সিংহের রাজত্বকালে এদেশে আসেন। তাঁর পিতা মরহুম খানবাহাদুর মুফিজুর রহমান, বি, এ, কে, এইচ, এম সততা, মানবপ্রীতি ও নিঃস্বার্থ দেশ প্রেমের জন্য খ্যাত ছিলেন।
জেনারেল ওসমানী কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন সিলেট গভর্ণমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ইংরেজীতে বিশেষ দখলের জন্য প্রিটোরিয়া প্রাইজ লাভ করেন। ১৯৩৪ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার্থে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে গমন করেন। ১৯৩৮ সালে তিনি কলা বিভাগে ডিগ্রী লাভ করেন এবং ১৯৩৯ সালে মাষ্টার ডিগ্রীর চূড়ান্ত পরীক্ষার পূর্বেই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেন। ১৯৪০ সালের ৫ই অক্টোবর তিনি ইন্ডিয়ান মিলিটারী একাডেমী, দেরাদুন থেকে সামরিক শিক্ষা শেষ করে বৃটিশ ইন্ডিয়ান কমিশন প্রাপ্ত হন। এরপর থেকে তার দ্রুত পদোন্নতি হয়—১৯৪১ এর ফেব্রুয়ারীতে ক্যাপ্টেন এবং ১৯৪২-এর ফেব্রুয়ারীতে তৎকালীন বৃটিশ সাম্রাজ্যের সর্বকনিষ্ঠ মেজর হন ও মাত্র ২৩ বছর বয়সে একটি যান্ত্রিক পরিবহন ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক হয়ে এক রেকর্ড সৃষ্টি করেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে বর্মা রণাঙ্গনে যে অল্প কয়েকজন অশ্বেতাঙ্গ অধিনায়ক যুদ্ধ পরিচালনায় নিযুক্ত হয়েছিলেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৪৬ সালে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে ইষ্টার্ণ কমান্ড সিলেকসন কমিটি কর্তৃক তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য মনোনীত হন এবং ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত ফাষ্ট পোস্টওয়ার ষ্টাফ কলেজ এন্ট্রেন্স পরীক্ষায় বৃটিশ ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় উচ্চস্থান লাভ করেন ও ষ্টাফ কলেজে ১৯৪৮ সনের কোর্সে স্থান অর্জন করেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে তিনি আই, সি, এস, এ কোয়ালিফাইড হওয়ায় ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল সার্ভিসের জন্যও ১৯৪৬ সালেই মনোনীত হন কিন্তু সৈনিক জীবন পরিত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। পরে ১৯৪৭ সনের শুরুতে তৎকালীন ভারতীয় অন্তবর্তী সরকারের পররাষ্ট্র সচিব জওহরলাল নেহেরু তাকে একটি কূটনৈতিক পদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানান। জেনারেল ওসমানী সে প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন। একই সালে তিনি লেফটন্যান্ট কর্ণেল পদের জন্য মনোনীত হন এবং বৃটিশ ভারতের সিমলাস্থ জেনারেল হেডকোয়াটার্সএ কোয়াটার মাষ্টার জেনারেলের শাখায় সেকেন্ড গ্রেড ষ্টাফ অফিসার পদে নিযুক্ত হন।
ভারত বিভাগের পর পরই তিনি পাকিস্তানের জন্য অংশ নির্ধারণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বছর সাতই অক্টোবর পাকিস্তানে তাঁকে লেফটেনান্ট কর্ণেল এর পদে উন্নীত করা হয়। তারপর ১৯৪৮ সালে তিনি কোয়েটা ষ্টাফ কলেজের কোর্সে যোগদান করেন। ১৯৪৯ সনে ষ্টাফ কলেজ থেকে ডিগ্রী লাভ করার পর তাঁকে তদানীন্তন চীফ অফ দি জেনারেল ষ্টাফ মেজর জেনারেল রেজিনাল্ড হাটন এর সহকারী জেনারেল ষ্টাফ অফিসার পদে নিয়োগ করা হয়।
এরপর বিভিন্ন পদে সৈন্যবাহিনীতে অধিনায়কত্ব এবং বিশেষ খ্যাতি অর্জনের পর ১৯৫২ সনের দিকে তাঁকে ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়নের ভার দেয়া হয়। ১৯৫৫ সনে তাঁকে ই,পি, রাইফেল্স এর অতিরিক্ত কমান্ডান্ট পদে বহাল করা হয়।
১৯৫৬ সনে তিনি কর্ণেল পদে উন্নীত হন এবং জেনারেল হেড কোয়ার্টার্স এর জেনারেল ষ্টাফ এ মিলিটারী অপারেশনের ডেপুটী ডাইরেক্টর পদ গ্রহণ করেন। এই সময় থেকে তিনি বহু আন্তর্জাতিক সামরিক ও পরিকল্পনা বৈঠকে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং বিদেশী রাষ্ট্রের সর্বাধিনায়কদের শ্রদ্ধা ও প্রশংসা অর্জন করেন।
১৯৬৪ সনে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানকার সাঁজোয়া, গোলন্দাজ, পদাতিক এবং বিমানবাহী শত্রু ও অস্ত্রের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন।
১৯৬৭ সনে জেনারেল ওসমানী সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
অবশেষে ১৯৭১ সনের এপ্রিল মাসে বাঙালিরা তাঁকে তাঁর উপযুক্ত মৰ্য্যাদা দেয়, এবং বাঙালি সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদে তাঁকে বরণ করে নেয়। একই সঙ্গে প্রজাগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার তাকে জেনারেল পদে উন্নীত করেন। আজ তাঁরই অধিনায়কত্বে বাংলার সংগ্রামী সেনারা এগিয়ে চলেছে এক নবতর ভবিষ্যতের পানে।
স্বদেশ ॥ ১ : ২ ॥ ১ জুলাই ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন