অমানিশার অবসানে পূর্ব দিগন্তে ঊষার আলো দেখতে পাচ্ছি
জাতীর উদ্দেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের বেতার ভাষণ
“মুক্তি সংগ্রামের অন্ধকার অধ্যায় কাটিয়ে আমরা শুভ প্রভাতের দিকে এগিয়ে
চলেছি। ইতিমধ্যে আমি পূর্ব দিগন্তে ঊষার আলো দেখতে পাচ্ছি।’
গত ১৮ই মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরোক্ত ঘোষণা করেন।
তিনি বলেন, সেদিন বেশি দূরে নয়, যখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বহু বিদেশী রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করবে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার ভাষণে মুক্তি ফৌজের ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন এবং বলেন, মুক্তি ফৌজের কঠোর প্রতিরোধ ও তীব্র পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তান বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে এবং তাদের মনোবল একেবারে শূন্যের কোঠায় এসে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ইতিমধ্যেই অভাবিতপূর্ব ত্যাগ স্বীকার করেছে। লাখো লাখো লোক ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর গুলীতে প্রাণ দিয়েছে, কোটি লোক গৃহহারা হয়ে পথের ভিখারী বনেছে। লাখো লাখো মাতা তাদের সন্তান হারিয়েছেন, তাদের অশ্রুতে বাংলার আকাশ-বাতাশ আজ সিক্ত। শহীদদের রক্তে বাংলাদেশের পথপ্রান্তর আজ নদী। তবু তারা আজও সংগ্রামী মনোবল হারাননি। আজ তাদের এতসব ত্যাগের প্রতিদানে তিনিও শুধু অশ্রু দিতে পারেন।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দৃঢ়তার সাথে বলেন যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ত্যাগ বৃথা যেতে পারে না। এবং তা বৃথা যেতে দেওয়া হবে না। তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, বাঙালির এ অশ্রু একদিন তাদের মুখে হাসি ফোটাবে।
বাংলাদেশ কেন স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, ইয়াহিয়া ও তার উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ আলোচনা শেষে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীরা ২৫শে মার্চ সামরিক আইন প্রত্যাহার করে গণ-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটা ঘোষণা শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। কিন্তু সে ঘোষণা কোন সময় আর আসল না। তার বদলে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষের উপর।
তথাকথিত দুই শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের উপর যে দোষ চাপানোর প্রয়াস চলছে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ওটাকে একটা মিথ্যার বেসাতি বলে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারাই তাদের খসড়ায় এ প্রস্তাব করেছিলেন।
তাতে স্পষ্টভাবে লেখা ছিল যে, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্যগণ পৃথক পৃথক বৈঠকে মিলিত হয়ে দুটো শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবেন। তারপর যৌথ অধিবেশনে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হবে। ভুট্টোকে খুশী করার জন্য ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে এ প্রস্তাব করা হয়েছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ ব্যাপারে উদোরপিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা করেন।
সশস্ত্র আওয়ামী লীগ কর্মী এবং দুষ্কৃতিকারীদের উপরই শুধু সামরিক বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছে বলে সামরিক জান্তার পক্ষ থেকে যে দাবী করা হয়েছে তার জবাবে সৈয়দ নজরুল জিজ্ঞেস করেন : তাহলে ই পি আর ও পুলিসের সদর দফতরের উপর আক্রমণ চালান হল কেন? তারা তো আওয়ামী লীগ কর্মী বা দুষ্কৃতিকারীর কোনটাই ছিলেন না।
বাংলাদেশে ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যার ঘটনা দেখেও বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রবর্গ আজ যে নীরবতা অবলম্বন করেছেন তার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। তাদের উদ্দেশ্যে তিনি জিজ্ঞেস করেন : লাখো লাখো নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে বিনা কারণে হত্যা করা কি ইসলাম অনুমোদন করে? মসজিদ, মন্দির বা গীর্জা ধ্বংস করার কি কোন বিধান ইসলামে আছে?
বাংলাদেশের মানুষকে আশ্বাস দিয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ জনগণকে যেসব ওয়াদা দিয়েছিল তার প্রতিটি তারা পালন করবে। তিনি জানান যে, তার সরকার ভূমিহীনকে ভূমিদান, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, বড় বড় শিল্প জাতীয়করণ করে দেশকে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
যে সমস্ত বিশ্বাসঘাতক পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করছে, তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাদেরকে অবিলম্বে বাংলার স্বার্থবিরোধী ও মুক্তিসংগ্রাম বিরোধী ঘৃণ্য কাজ কারবার থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতেই তাদেরকে এসবের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তখন তাদের প্রতি কোনরূপ কৃপা প্রদর্শন করা হবে না।
তিনি বাংলাদেশের জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও মতাদর্শ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লক্ষ্যে অর্জনে- মুক্তি অর্জনে সহায়তা করার আবেদন জানান। কেননা, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। কোন শক্তিই তা ঠেকাতে পারবে না।
জয়বাংলা (১) ॥ ১ : ২ ॥ ১৯ মে ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন