লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে কে-আমরা না তোমরা?
পাকিস্তানের সামরিক জঙ্গী চক্রের নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থার জন্যে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে দায়ী করে যে মিথ্যে অভিযোগ করেছেন তার প্রতিবাদে স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজুদ্দীন আহমদ বিশ্ববাসীর অবগতির জন্যে পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করে এক বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে জনাব তাজুদ্দীন আহমদ বলেন:
“বাংলাদেশ আজ যুদ্ধে লিপ্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধ। এটা আমাদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সংগ্রাম, আমাদের বাঁচা- মরার সংগ্রাম, এছাড়া আমাদের আর কোন গত্যন্তর ছিল না।
বাংলাদেশে আজ যে ব্যাপক গণহত্যা চলছে পাকিস্তান সরকার তার সত্যতা গোপন ও বিকৃত করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ কি কারণে আজ পার্লামেন্টারী রাজনীতির বদলে নিজেদের আশা ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের পথ ধরতে বাধ্য হয়েছে, তা বিশ্ববাসীর গোচরীভূত করা দরকার।
পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার সম্ভাব্য শেষ সমাধান হিসাবে আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচী পেশ করে। এর লক্ষ্য ছিল এক পাকিস্তানের আওতায় স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ। ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে অবতীর্ণ হয়ে আওয়ামী লীগ ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে বাংলাদেশের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি দখল করে। আওয়ামী লীগের বিজয় এত বিরাট ছিল যে বাংলাদেশে প্রদত্ত ভোটে মোট ভোটের শতকরা ৮০টি লাভ করে। এ বিজয়ের ফলে জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনোত্তর সময়ে মানুষের মনে জেগে উঠে বিরাট আশা ভরসা, কেননা পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের ইতিহাসে আর কোন জাতি কোনদিন কোন দলকে এমন বিরাটভাবে বিজয়ী করেনি। পাকিস্তানের উভয় অংশের মানুষের মনে এ বিশ্বাসের জন্ম নেয় যে অবশেষে ৬ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র রচনা হতে চলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধু ও পাঞ্জাবে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টি একক বৃহত্তর দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে, কিন্তু নির্বাচনী অভিযানে ৬ দফাকে কোন সময়ে ইসুও করেনি। সুতরাং নির্বাচনোত্তর কালে ৬ দফার বিরোধিতা করার দায়িত্ব তাদের ছিল না। বেলুচিস্তানে জাতীয় আওয়ামী পার্টি ৬ দফার পূর্ণ সমর্থক ছিল। সীমান্ত প্রদেশে ন্যাপ প্রাদেশিক পরিষদে প্রাধান্য লাভ করে এবং তারাও সর্বাধিক স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে ছিলেন। মোট কথা নির্বাচনে প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলির ভরাডুবি প্রেক্ষিতে পাকিস্তানের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপামর দেশবাসীর আশাবাদী হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল।
আশা করা গিয়েছিল যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের প্রস্তুতিলগ্নে রাজনৈতিক অঙ্গনে দেশের প্রধান প্রধান দলগুলোর মধ্যে আলোচনা ও বৈঠক শুরু হবে। পরিষদে যাবার পূর্বে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে নীতি ব্যাখ্যা এবং অন্যদের বিকল্প প্রস্তাব আলোচনায় আওয়ামী লীগ কোন সময় বিমুখ ছিল না। তবে একটি নির্ভেজাল গণতান্ত্রিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করতো যে গোপন আলোচনার পরিবর্তে জাতীয় পরিষদেই শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নাদি আলোচিত ও চূড়ান্ত হওয়া উচিত। এই উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ তাড়াতাড়ি জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আহ্বানের জন্য চাপ দিতে থাকে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে এই আশায় আশাম্বীত হয়ে আওয়ামী লীগ দিবারাত্রি কাজ করে চলে ও ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের একটি খসড়া প্রণয়নের প্রয়াস পায়। এবং অনুরূপ শাসনতন্ত্র রচনা ও তার বাস্তবায়নের সকল দিক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যত সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় জানুয়ারীর মাঝামাঝি সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়া ও শেখ মুজিবের মধ্যে। এই আলোচনায় জেনারেল ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের ৬-দফার তাৎপর্য জানতে চান। আশা করা গিয়েছিল জেনারেল ইয়াহিয়া শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে তাঁর নিজস্ব ধ্যান ধারণা ব্যক্ত করবেন। কিন্তু তা না করে তিনি এ ধারনাই ব্যক্ত করেন যে ৬ দফায় তেমন আপত্তির কিছুই নেই। তবে তিনি এ ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির সঙ্গে একটা বোঝাপড়ার উপর জোর দেন।
পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায় ২৭শে জানুয়ারী থেকে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির মধ্যে। এই আলোচনার সময় জনাব ভুট্টো তার দলবল নিয়ে আওয়ামী লীগের সাথে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে কয়েক দফা বৈঠকে মিলিত হন।
ইয়াহিয়া খানের মতো জনাব ভুট্টোও শাসনতন্ত্রের প্রকৃতি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন প্রস্তাব নিয়ে আসেনি। তিনি ও তার উপদেষ্টারা প্রধানতঃ ৬ দফার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনাতেই আগ্রহী ছিলেন। প্রতিটি ব্যাপারে তাদের সাড়া নেতিবাচক হওয়ায় এবং শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে তাঁদের কোন নির্দিষ্ট বক্তব্য না থাকায় আলোচনা বেশী গভীরে যেতে পারেনি। যাহলে হয়তো দুটি প্রধান দলের মধ্যে মত পার্থক্য দূর করা যেত। এটা স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যে, শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে জনাব ভুট্টোর কোন সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল না যেখান থেকে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।
পিপলস্ পার্টির নেতারা যখন ঢাকা ত্যাগ করেন, তখন তারা আভাস ইঙ্গিতেও একথা বলেননি যে আওয়ামী লীগের সাথে তাদের আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। বরং তাঁরা একথাই জানিয়েছিলেন যে আলোচনার সকল দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সাথে আলোচনার পর তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ দ্বিতীয় দফা আলাপ আলোচনায় আওয়ামী লীগের সাথে মিলিত হবেন; অথবা তাঁরা জাতীয় পরিষদে যোগ দেবেন এবং পরিষদের বিভিন্ন কমিটিতে বসে আলোচনার মাধ্যমে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে চূড়ান্ত ফয়সালা করবেন।
এমতাবস্থায় পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিদ্ধান্ত এ জন্যই সবাইকে আরো বেশী বিস্মিত করে যে শেখ মুজিবের দাবী মোতাবেক ১৫ই ফেব্রুয়ারী জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতই ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন।
পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সমস্ত দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত করা। এ কাজে ভুট্টোর হস্তকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর লেঃ জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের উপর পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। জনাব ভুট্টো ও লেঃ জেনারেল ওমরের প্রবল চাপ সত্ত্বেও পিপিপি ও কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বিমানে পূর্ব পাকিস্তানে গমনের টিকেট বুক করেন। এমনকি কাইয়ুম লীগের অর্ধেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমনও আভাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, পিপিপি-র বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোন কুলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না তখন গত ১লা মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতুবী ঘোষণা করে জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর দোস্ত ভুট্টোকে খুশী করার জন্য শুধু তাই না, জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর এডমিরাল আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। এ লোকটি ইয়াহিয়া প্রশাসনে মধ্যপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালীদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হইয়াছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিটারী জান্তার হাতে তুলে দেওয়া হলো।
এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোনক্রমেই ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণ-রায় বানচাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল একমাত্র সংস্থা যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরী করতে পারতো এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারতো। এটাকে বানচাল করার জন্যই চেষ্টা চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমতার উৎস না করে একটা ‘ঠুটো জগন্নাথে’ পরিণত করার।
জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিক্রয়া যা হবে বলে আশা করা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোন ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারী রাজনীতির নামে তামাসা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে এক পাকিস্তানের কাঠামোতে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোনো সম্ভবনা] নাই। নিজেই আহ্বান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালী শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাই তারা একবাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবর রহমানের উপর চাপ দিতে থাকেন।
শেখ মুজিব এতদসত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩রা মার্চ অসহযোগ কর্মসূচীর আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলার জন্যে শান্তির অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখনও তিনি আশা করছিলেন যে সামরিক চক্র তাদের জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২রা ও ৩রা মার্চ ঠাণ্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গুলী করে হত্যা করা মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শেখ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যেভাবে সাফল্যের সাথে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরীভাবে অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি, পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্ণর লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোন বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ জনপ্রশাসন বিভাগের কর্মচারিগণ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের বেসামরিক কর্মচারিগণ তাঁদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগ দান থেকে বিরত থেকেই তাঁরা ক্ষান্ত হলেন না। বেসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকেরা সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তাঁরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন যে আওয়ামী লীগ প্রধানের নির্দেশ ছাড়া তাঁরা কারো নির্দেশ মেনে চলবে না।
এ অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযোগের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হলো। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয় বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ করেছিলেন তাঁরা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলী সর্বান্তকরণে মাথা পেতে নিলেন এবং সমস্যাবলীর সমাধানকে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা কিন্তু এসব সমস্যাবলীর মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশে কোন আইনানুগ কৰ্তৃপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তাঁর কৌশল পাল্টালেন। ৬ই মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কনফ্রন্টেশনের জন্যে উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে মনে হলো। কেননা তাঁর ঐ দিনের প্ররোচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সংকটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামী লীগের উপর। অথচ যিনি ছিলেন সংকটের স্থপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্যে ঢাকায় সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণসতর্কীকরণ। লেঃ জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানে করে ঢাকায় পাঠালো হলো লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনোভাবের পরিচয়।
কিন্তু ইতিমধ্যে মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে উঠে। এ সত্ত্বেও শেখ সাহেব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যোগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা অপরদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌঁছানোর জন্য ইয়াহিয়াকে দেয়া হয় তাঁর শেষ সুযোগ।
বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুষ্পষ্ট প্রতীয়মান যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তাঁর জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তি জোরদার করার জন্যে কালক্ষেপন করা ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটা আজ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে অনুরূপ একটি সংকট সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেওয়া হয়েছিল।
১লা মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত ট্যাঙ্কগুলো ঢাকায় ফেরৎ আনা হয়। ১লা মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানী কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবারসমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লোকদের পরিবার পরিজনদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে।
১লা মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫শে মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পিআইএর কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পোষাকে সশস্ত্রবাহিনীর লোকদের বাংলাদেশে আনা হল। সি-১৩০ পরিবহণ বিমানগুলোর সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশে স্তূপীকৃত করা হয়।
হিসাব নিয়ে জানা গিয়েছে, ১লা মার্চ থেকে ২৫শে মার্চের মধ্যে প্রয়োজনীয় সাজ সরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানী করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমান বন্দরকে বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমান বন্দর এলাকায় আর্টিলারি ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন-নির্গমনের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাক কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ড সংঘটনে ট্রেনিং প্রাপ্ত একটা এস-জি কমাণ্ডো গ্রুপ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৫শে মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যে সব কুকাণ্ড ঘটে এরাই সেগুলো সংঘঠন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনাকর পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এ সবের উদ্দেশ্য।
প্রতারণার বা ভণ্ডামীর এই স্ট্রাটেজী গোপন করার অংশ হিসাবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আলোচনায় আপোষমূলক মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ই মার্চ আলোচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪ দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাবটি কি। জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে এ ব্যাপারে তাদের তেমন কোন আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে ৪ দফা শর্ত পূরণ ভিত্তিতে উভয় পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন।
আলোচনাকালে যে সব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলি হল : (১) মার্শাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
(২) প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল সমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। (৩) ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন। জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন। তারপর শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত কারণের উদ্দেশ্যে এক যুক্ত অধিবেশনে মিলিত হবেন।
আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনোরঞ্জনের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ৬ দফা হলো বাংলাদেশ এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযোগ্য নীল নকশা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়োগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানী এম এন এ দের পৃথকভাবে বসে ৬ দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলোপের আলোকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।
শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটিমাত্র প্রশ্ন থেকে যায়, এবং তাহলো অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন। এ ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ৬ দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচনা হতে যাচ্ছে মোটামুটি তার আলোকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই অংশটি সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরীর উদ্দেশ্য প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম এম আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ আলোচনায় তিনি স্পষ্টভাবে একথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬ দফা ও কার্যকরী করার প্রশ্নে দুর্লঙ্ঘ কোন সমস্যা দেখা দেবে না। এমন কি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না।
আওয়ামী লীগের খসড়ার উপর তিনি যে তিনটি সংশোধনী পেশ করেছিলেন তাতে একথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে সে নিয়ে। ২৪শে মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশোধনীগুলো আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত করণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোন বাধাই ছিল না৷
এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলতে হয়। কোন পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথবা ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাষ-ইঙ্গিতেও এমন কোন কথা বলেননি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না।
গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোচ্চুরীর আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি এবং তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল তিনিও সেভাবে একটা ঘোষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছাত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাকড়া তুলেছেন ইয়াহিয়া তাই অনুমোদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইয়াহিয়া ঘূণাক্ষরেও মুজিবকে এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার ইয়াহিয়া যদি আভাস ইঙ্গিতেও এ কথা বলতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তাতে আপত্তি করতো না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপলক্ষ্য করে আলোচনা বানচাল হতে দেয়া যায় না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু দল হিসাবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল তা শুধু ভুট্টোকে খুশী করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোন সময়ই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না।
২৪শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে জনাব এম, এম আহমদ তার সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহ্বানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোন চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং জনাব এম, এম আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫শে মার্চ করাচী চলে গেলেন।
২৫শে মার্চ রাত ১১টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে ‘পজিশন’ গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত্রি নাগাদ ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগণের উপর পরিচালনা করা হলো গণহত্যার এক পূর্বনির্দিষ্ট কর্মসূচী। অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজীর সমসাময়িক ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোন চরমপত্র। অথবা মেশিনগান, আর্টিলারী কামান সুসজ্জিত ট্যাঙ্কসমূহ যখন মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারী করা হয়নি কোন কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লেঃ জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারী করেন বেতার মারফৎ। কিন্তু ৫০ হাজার তার আগেই লোক প্রাণ হারিয়েছে বিনা প্রতিরোধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরক-কুণ্ডে, প্রতিটি অলিগলি ও আনাচে কানাচে চলতে লাগলো নির্বিচারে গুলী। সামরিক বাহিনীর লোকদের নির্বিচার অগ্নিসংযোগের মুখে রাতের অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যে সব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করলো তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো মেশিনগানের গুলীতে।
আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ এবং ইপিআর বীরের মতো লড়ে গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোন প্রতিরোধ দিতে পারলো না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটি নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং শীঘ্রই তা প্রকাশ করবো। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে সব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে মান করে দিয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙালী হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসীকে জানানো হলো এর কৈফিয়ৎ। এই বিবৃতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংঘটনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরষ্পরবিরোধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছিলেন সে দলের লোকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ আলোচনায় কোন সংগতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীর অবাধ মত প্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারলো না। তার বক্তব্য থেকে এ কথা সুষ্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো যে ইয়াহিয়া আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন্য তিনি জংঙ্গী আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর।
পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শতসহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসাবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিৎ ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের উপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোনমতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণ গত বিদ্বেষ এবং একটা জাতীকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লংঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারী পশুর মত। তারা চালিয়েছে হত্যা যজ্ঞ। নারীধর্ষণ, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচার ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজীর নেই। এ সব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাষ মেলে যে ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো তাহলে তারা একই দেশের মানুষের উপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারতো না।
ইয়াহিয়ার এই নির্বিচার গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানে বিয়োগান্ত ও মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া নিজেই রচনা করেছেন বাঙালীর রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পোড়া মাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হল আমাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলোকে ধূলিস্যাৎ করা যাতে একটা জাতি হিসাবে কোন দিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।
ইতিমধ্যে এ লক্ষ্য পথে তার সেনাবাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শোষণ করছে তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার হিসাবে সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৫০ বৎসর পিছিয়ে পড়লো।
অসউইজের পর গণহত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে এ উটপাখীর নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তাঁরা যদি মনে করে থাকেন যে এতদ্বারা তাঁরা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করছেন তাহলে তাঁরা ভুল করছেন। কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইয়াহিয়া খান নিজেও আজ মোহমুক্ত।
তাঁদের বোঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তাদের অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোন শক্তি এ নতুন জাতিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে, স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।
সুতরাং, রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিৎ ইয়াহিয়ার উপর পূর্ণ চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েট ইউনিয়ন ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেটবৃটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাবো। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তা হলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ভষ্ম ও ধ্বংসস্তূপের উপর একটা নতুন দেশ গড়ে তোলা। এ একটা দুরূহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে মানুষ এক ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং, তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতেই হবে। আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এতো ত্যাগ স্বীকার করতে পারে সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোন বাধা বিপত্তি টিকতে পারে না।
আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড়ো জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোন শক্তি ব-ক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না-আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসঙ্কোচে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে আমাদের। কারো তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।
আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে, তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষায়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, আর কালবিলম্ব করবেন না, এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন।
বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশী দাবীদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি।
জয়বাংলা।
জয়বাংলা ॥ ১ : ২, ৩, ৪, ৫, ৬, (মোট ৬ কিস্তিতে সমাপ্ত) ১৯, ২৬, মে, ২, ৯, ১৮, ৭ ॥ ২৫ জুন ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন