বাংলার মানুষ আর কোন গোঁজামিলের সমাধান গ্রহণ করবে না
-সৈয়দ নজরুল ইসলাম
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত ৬ই জুন সংগ্রামী বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও আটক সকল গণ- প্রতিনিধিদের অবিলম্বে মুক্তিদান, বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার বাহিনী ফিরিয়ে নেয়া, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকশ্রেণী কর্তৃক এ যাবৎ বাংলাদেশ থেকে অপহৃত ধনসম্পদ ও গত আড়াই মাসের লড়াইয়ে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের যে ক্ষতি সাধন করেছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে তা নির্ণয় করে লুণ্ঠিত ধন প্রত্যাবর্তন ও পূর্ণ ক্ষতিপূরণের দ্বারাই কেবল রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে অন্যথা রাজনৈতিক সমাধানের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না।
তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় রাজনৈতিক সমাধান বা আপোষ মীমাংসা সম্পর্কে যে জল্পনাকল্পনা চলছে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোন গোঁজামিলের সমাধান গ্রহণ করবে না।
আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের মাটিতে আর কোনদিন সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে সকল বাঙালী-হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান—এক সাথে লড়েছেন, বুকের তপ্ত লহু ঢেলে দিয়ে বাংলার মাটি সিক্ত করে তারা এটাই প্রমাণ করেছেন, এদেশের প্রতিটি প্রাণ ঐক্যবদ্ধ, অভিন্ন।
স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভাষণে তিনি বলেন, স্বাধীনতার সংগ্রামে হিন্দু কৃষক জীবন দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন মুসলমান কৃষক। মসজিদ পুড়েছে হানাদার দস্যুদের হাতে, পুড়েছে মন্দির গীর্জা আর বৌদ্ধ বিহার বিধ্বস্ত হয়েছে। বর্বর পাক-সেনারা হত্যা করেছে ডঃ গোবিন্দ দেব, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ও ফজলুর রহমানকে। আমরা এক সঙ্গে লড়েছি, একই সাথে জয়ী হবো। এবং জয়ী আমরা হবই।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, হানাদার দস্যু ইয়াহিয়ার বর্বর সৈনিকদের নির্মম অত্যাচারে কৃষক-মজদুর, ছাত্র, শিক্ষক, মধ্যবিত্ত আর অসংখ্য মানুষ বাংলার শ্যামল মাটির বুক ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন! তাদের তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন শত্রু হননের পর মুক্ত স্বদেশে ফিরে আমরা আবার তাঁদের আপন ভিটে মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করবই।
এই প্রসঙ্গে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান দেশত্যাগ করে যে সব বাঙালী ভাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আর বার্মায় আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের সাহায্য করায় ভারত সরকার ও বার্মা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের প্রশংসা করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সীমিত সামর্থের জন্য আপনাদের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন রণাঙ্গনে আপনারা যে অসীম অটল মনোবলের পরিচয় দিচ্ছেন, তার জন্যে আজ সারা বাঙালি জাতি গর্বিত। দেশমাতৃকার বীর সন্তান আপনারা। এ সংগ্রামে আপনাদের যে সব সাথী শহীদ হয়েছেন যারা পঙ্গু হয়েছেন তাঁদের পরিবারবর্গের রক্ষণাবেক্ষণের পুরো দায়িত্ব আমার সরকার ইতিপূর্বেই গ্রহণ করেছেন।
তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকেরা আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
জয়বাংলা ॥ ১ : ৬ ॥ ১৮ জুন ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন