You dont have javascript enabled! Please enable it!

শত্রুকবলমুক্ত চাঁদপুর ও ফেনী ক্রমশ স্বাভাবিক হচ্ছে
রনজিত রায়

চাঁদপুর, ২৮ ডিসেম্বর-মেঘনার পূর্বে রেল ও সড়ক সংযোগ স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে। কিন্তু লোক যাতায়াত করছে। প্রায়ই তাদের ঘোরাপথে যেতে হচ্ছে। আমাকেও ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া ও আসায় এই ঘোরাপথই ধরতে হয়। পশ্চিম পাকিস্তানীদের ধ্বংসলীলার আগে মোটরে বা ট্রেনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে যেতে ৬/৭ ঘণ্টা সময় লাগত। সেই জায়গায় আমার লাগল এক-এক পিট দেড় দিন।
কিন্তু এসব সত্ত্বেও লোক যাচ্ছে আর আসছে। নৌকা, মোটরলঞ্চ, স্টীমার, বাস অথবা ট্রেন যেকোন যানবাহনই পাওয়া যায় তাতেই লোক ঠাসাঠাসি করে যাচ্ছে আর আসছে। নয় মাস ধরে জঙ্গীশাসকদের বর্বর তাণ্ডবলীলায় মরিয়া হয়ে লোক শহর ছেড়ে পালিয়েছিল। গ্রামেও শান্তি ছিল না। লক্ষ লক্ষ লোক গৃহহীন হয়েছিল-নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য তারা পায়ে হেঁটে বা নৌকোয় গ্রাম থেকে গ্রামে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছিল।
তারা এখন সবাই ফিরে আসছে। “আল্লার দোহাইতে আমরা পাকিস্তানীদের কবলমুক্ত হয়েছি।” কথাটি বললেন, “বিউটি অফ বিক্রমপুর” মোটর লঞ্চের সারেং মৌলবী ফরিদ আহমেদ। এই লঞ্চেই আমি ঢাকা থেকে চাঁদপুর যাচ্ছিলাম। দিল্লির একজন রিপোরটার জেনে সারেং ভদ্রলোক আমার ভি আই পি-র খাতির দিতে শুরু করেন। আমার জন্য আলাদা কেবিন এবং চা থেকে শুরু করে বিশেষভাবে মাছের ঝোল ভাত রেধে দেওয়া পর্যন্ত সবরকম আদর আপ্যায়ন হল। এর উপর আবার তিনি এসবের দাম এমনকি লঞ্চের ভাড়াও নিতে চাইলেন না। তাঁর শুধু এইটুকু নিবেদন যে, পশ্চিম পাকিস্তানীরা এই সুন্দর দেশের কি হাল করে ছেড়েছে সেটা যেন বিশ্ববাসীকে ভাল করে জানানো হয়।
এখন ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে যাতায়াত করতে হলে চাঁদপুর ও ফেণী হয়ে যেতে হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রাম রক্ষার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছে সেইজন্য চাঁদপুর ও ফেণী সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যুদ্ধের ফলে চাঁদপুর বা ফেণীর ক্ষতি হয়নি। অধিকাংশ ক্ষতি পাক দখলদারবাহিনী ও রাজাকারদের হাতেই হয়েছে। এইসব জায়গায় বহুলোক খুন হয়েছে-ঠিক কত কেউ কোনদিন তা হয়ত বলতে পারবেন না। ভয় দেখিয়ে বাঙালিদের নীতিস্বীকার করানোর উদ্দেশ্যে অনেককে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে। নোয়াখালি জেলায় ফেণী ও কুমিল্লা জেলায় চাঁদপুর-এই দুই ব্যবসাকেন্দ্র। পুরানবাজার হল পাইকারী ব্যবসা কেন্দ্র-এরই ক্ষতি হয়েছে সর্বাধিক। শহরের প্রাণকেন্দ্র নতুনবাজারও পশ্চিম পাকিস্তানীদের দৃষ্টি এড়ায়নি। তবে পুরানবাজারের তুলনায় এর ক্ষতি হয়েছে অনেকাংশে কম।
বিমান থেকে বোমাবর্ষণের একদিন পর ৭ এপরিল একদল দখলদার পাকসেনা ফেণী থেকে এসে ঐ শহরের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেপরোয়া নারকীয় হত্যালীলায় মেতে ওঠে। মেঘনার দুই তীরে শহরের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ে তারা অবাধে ধ্বংস ও হত্যা করতে থাকে-মুখে তাদের গগনভেদী “রণহুঙ্কার।”
রাজাকার ও মুসলিম লীগের লোকের সাহায্যপুষ্ট হয়ে পাকসেনারা প্রতিটি মহল্লায় ও দোকানে বেপরোয়া লুঠতরাজ ও ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম চালাতে থাকে। এই সংবাদটি আমায় দিলেন চাঁদপুর থানা আওয়ামী লীগের চেয়ারম্যান শ্রীরফিউদ্দিন আখন্দ। পাকিস্তানীদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য তিনি আত্মগোপন করেছিলেন। তাঁর লোহার সিন্দুকটি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং গদিও লুঠ করা হয়। তাঁর একজন কর্মচারী খুন হয়। তাঁর সম্প্রদায়ের অন্যান্য কয়েকজনের বাড়িও লুঠ হয়। কয়েকজনকে খুনও করা হয়।
পাক দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা হিন্দু ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের এলাকাতেও নির্মম অত্যাচার চালাতে ছাড়েনি। এই এলাকাটি হল-পশ্চিমে শ্রীরামদি। আগের দিন এখানে বোমাবর্ষণ করা হয়। হিন্দুরা সদলবলে এখান থেকে পালিয়ে যায়। জনশূন্য বাড়িগুলিতে লুঠতরাজ চালিয়ে তার জানলা দরজাগুলি পর্যন্ত খুলে নিয়ে যাওয়া হয়। কোন কোন বাড়ি ও দোকান অবশ্য ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পায়। কারণ বোধ হয় জঙ্গীশাসকদের স্থানীয় দালালরা ঐগুলি নিজেরা রাখতে চেয়েছিল। শ্রীআখন্দ এইরকম কয়েকটি বাড়ি ও দোকান আমায় দেখান। ঐসব বাড়ির অন্দরমহলের পরিবর্তন বিশেষ কিছু চোখে পড়ল না, তবে বাইরের দেওয়ালে মুসলিম গৃহসজ্জার কিছু নিদর্শন চোখে পড়ল। এইসব বাড়ির প্রাপকরা মনে করেছিলেন যে, তাঁদের আর বাস্তুচ্যুত করা যাবে না।
অধিকাংশ হিন্দুর দোকানও জঙ্গীশাসকবর্গের স্তাবকদের মধ্যেও অনুরূপভাবে বিলি করা হয়। এই দোকানগুলিও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
আত্মসমর্পণের ২ দিন আগে পর্যন্ত তা অবাধে চলতে থাকে। গ্রামগুলির ক্ষতিও কম নয়। চাঁদপুর থেকে ফেণী যেতে ও আসতে ট্রেনে আমার সহযাত্রীরা বহুগ্রামের দুর্দশা দেখালেন। ঐসব গ্রামগুলি আংশিক বা পুরাপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশি সংখ্যক হিন্দুর বাস বা গেরিলা কাজকর্মের কেন্দ্র বলেই হয়ত ঐসব গ্রামের উপর পাক সেনাদের কোপ দৃষ্টি বেশি পড়েছে। সম্প্রদায় নির্বিশেষে নারীধর্ষণ এক নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ফেণীর চিত্র কিছু পৃথক নয়। অত্যাচারের রকম প্রায় একই। হিন্দুদের সমূলে নিধন বা বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করতে চাওয়া হয়েছিল। হাজারিপাড়া (দাউদপুর পূর্ব) ও সহদেবপুরের হিন্দু মহল্লাটি এই স্বাক্ষরই বহন করছে। শহরের প্রাণকেন্দ্র শ্রীনাথজীউর মন্দিরটি বিধ্বস্ত হয়। বিগ্রহও অপহৃত। বাঘা মজুমদারের বাড়িও বিধ্বস্ত।
ফেণীতে খাজা আহমেদ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসাবে গত ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি বিবরঘাটি বাড়ির সরঞ্জাম সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কয়েকটি লরি ভাড়া করেন। ইতিমধ্যে ঐসব বিবরঘাটিগুলি ভেঙ্গে ফেলা শুরু হয়েছে। একটি স্কুলের মাঠে ঐসব সরঞ্জাম স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। এরমধ্যে কি নেই—জানলা-দরজা থেকে শুরু করে গাছের গুঁড়ি পর্যন্ত আছে। আর আছে রেলের স্লিপার। এই স্লিপারগুলি রেলকে ফেরত দেওয়া হবে। আর অন্যান্য জিনিসগুলি গৃহপ্রত্যাগত শরণার্থীদের বাড়িঘর তৈরী কাজে ব্যবহার করা হবে। খাজা সাহেব এরজন্য অর্থসাহায্যের আবেদনও জানিয়েছেন। সাড়াও ভাল মিলছে।
খাজা সাহেব জানান ফেণীর শতকরা ৪০ ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য হিন্দুদের হাতেই ছিল। সুতরাং শরণার্থীরা ফিরে এলে প্রকৃত মালিককে তাঁদের জমিজমা ফিরিয়ে দেওয়ার অসুবিধা হবে না।
এঁদের অসুবিধা থাকবে পরবর্তী ফসল কাটার সময় পর্যন্ত। ততদিন পর্যন্ত গ্রাসাচ্ছনই হবে এঁদের সমস্যা। দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করায় কিছু আমন শস্য কাটা হয়েছে। তবে অনেকেই এর ফল ভোগ করতে পারবেন না।
কেবল খুনখারাপি বা লুঠতরাজ নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রেও অত্যাচারের নিষ্ঠুর নিদর্শন রয়েছে যেমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বীক্ষণাগারগুলি এর স্বাক্ষর বহন করছে। প্রাচীন সংস্থা ফেনী পাবলিক লাইব্রেরী রান্নাবাড়িতে পর্যবসিত হয়েছিল। বইগুলি হয়েছিল জ্বালানি।
মেঘনার পূর্বে অন্যান্য স্থানের মধ্যে চট্টগ্রাম, ফেণী ও চাঁদপুর ছিল সক্রিয় গেরিলা আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র। স্টীমার “টারন”-এর প্রথম শ্রেণীর কেবিনের ওপরের ডেকে বুলেটের চিহ্ন ছিল। ‘বিউটি অফ বিক্রমপুর’ লঞ্চেও এইরকম বুলেটের চিহ্ন দেখতে পাওয়া গেল। পাকিস্তানী সেনারা খালাসীদের এইসব লঞ্চ চালাতে বাধ্য করেছিল। ফলে ঐগুলি গেরিলাদের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা এই গেরিলা-বাহিনীকে ফাঁপিয়ে তুলেছিল।
চাঁদপুরে আমি এক ধনী মুসলমানের গৃহে রাত কাটাই। এই ভদ্রলোকের একটি ছেলে গেরিলাবাহিনীতে ছিল। মুক্তিসংগ্রামে ছেলেটি প্রাণ হারায়। এই বাড়িটি ছিল মুক্তিসংগ্রামীদের আস্তানা।
এই বাড়িতেই শ্রীআবদুল মোমিন খাঁর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। মার্চ মাসে তিনি ঢাকা সিটি ল কলেজের ছাত্র ছিলেন। তিনি কখনও দূর থেকেও রাইফেল দেখেননি। আজ তাঁর কি পরিবর্তন। তাঁকে সেদিন দেখলাম একজন পাক গেরিলা হিসাবে একটি স্টেনগান নাড়াচাড়া করছেন। বাহিনীর তিনি নেতৃত্ব করেন। তাঁর নতুন নাম হয় মাখন। তাঁর ইউনিটের নাম হয় পদ্যা। শত্রুপক্ষের সঙ্গে এই ইউনিটের বহু সংঘর্ষ হয়। দুইজন প্রাণও হারায়। এঁদের হাতে শত্রুপক্ষেরও অনেকে নিহত হয়। শ্রীখাঁ আজ তাঁর মাতৃভূমি বাংলাদেশকে মুক্ত করার আন্দোলনে অংশ গ্রহণে গর্ব অনুভব করেন।
খাজা সাহেব জানান, ফেনীর শতকরা ৪০ ভাগ ব্যবসা-বাণিজ্য হিন্দুদের হাতেই ছিল। একটি মাত্র দোকান অক্ষত ছিল। তার সিন্দুকটিও যথাস্থানে ছিল। চাঁদপুরে একইরকম উন্নতির লক্ষণ দেখা দেয়। হিন্দুদের দোকান বাড়ি যারা ছিনিয়ে নিয়েছিল পাকিস্তানী সেনারা পরাজিত হবার পর তারা উধাও হয়। শরণার্থীরা প্রত্যাবর্তন করে ঐসব বাড়িঘর যতদিন না বুঝে নিচ্ছে ততদিন আওয়ামী লীগ ঐগুলির দেখাশোনা করছে।
শ্রীআখন্দ জানালেন, চাঁদপুরেও এইসব দোকান ও বাড়ি চাবি দিয়ে সীল করে রাখা হয়েছে। চাঁদপুরের শ্রীআখন্দ ও ফেণীর খাজা আহমেদ উভয়েই বলেছেন, অবিধ্বস্ত বাড়ি ও দোকানগুলি প্রকৃত মালিকের হাতে অর্পণ করাই পুনর্বাসনের অঙ্গ। এইসব লোকেদের যা কিছু টাকাকড়ি ছিল, সবই হয় খোয়া গিয়েছে না হয়ত গত নয় মাসে প্রাণধারণের জন্য ব্যয় হয়ে গিয়েছে। এঁদের ব্যবসাবাণিজ্যে আবার প্রতিষ্ঠিত করতে চাই অর্থ-সাহায্য ও অল্প সুদে ঋণদান।
শ্রীঅধীরচন্দ্র সেনের কথায় চাঁদপুরে হিন্দু ব্যবসায় সম্প্রদায়ের দুর্দশার একটি করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। চাঁদপুরে শ্রীসেনের একটি দোকান ছিল। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তিনি আমায় জানালেন যে, তাঁর বাড়ির একটি ইঁটকাঠও নেই। বাজারে তাঁর দোকানটি লুণ্ঠিত হয়েছে। তিনি এখন কপর্দকশূন্য। এক বন্ধুর বাড়িতে তিনি থাকেন। ত্রিপুরা থেকে তিনি তাঁর পরিবারকেও আনতে পারছেন না। ত্রিপুরায় তাঁরা সকলে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
এইরকম বহু ব্যবসায়ী আজ চরম বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁরা আবার ব্যবসাবাণিজ্য শুরু করতে চান। কিন্তু এরজন্য চাই অর্থ। কোথায় যে অর্থ পাওয়া যাবে? বাংলাদেশ সরকার এখনও এই সমস্যার প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবার সময় পাননি এবং এই সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোন কর্মসূচী রচিত হয়নি। গৃহপ্রত্যাগত শরণার্থীদের সবরকম সুযোগ-সুবিধা দেবার তাঁদের বাসনার কোন অভাব নেই। কিন্তু অন্যান্য গুরুতর সমস্যায় বাংলাদেশ সরকার এখন ভারাক্রান্ত হয়ে রয়েছেন বলেই মনে হয়।
গ্রামাঞ্চলে শরণার্থীদের পুনর্বাসনে বিশেষ অসুবিধা হবে বলে মনে হয় না। কারণ ব্যাপকভাবে ঘরবাড়ি তৈরি করে দিলেই এই সমস্যার অনেকটা সুরাহা হতে পারে। গ্রামাঞ্চলে পাক জঙ্গীশাসকদের স্তাবকরাও এখন উধাও হয়েছে।
দৈনিক আনন্দবাজার, ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!