বিশ্বের মানচিত্র থেকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্ব মুছে ফেলার শক্তি কারো নেই
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্র কাননে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা হারিয়েছিল আর ১৯৭১ সালের ১৭ই এপ্রিল সেই প্রাচীন জেলারই আর এক আম্র কাননে জন্ম নিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র।
কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার একটি গ্রামের নতুন নামকরণ হয় মুজিব নগর। এই মুজিবনগরই হলো বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী।
সেদিন বেলা ১১টা ১০ মিনিট: মঞ্চের পশ্চিম দিক থেকে এলেন নেতারা। সমবেত জনতা জয়ধ্বনি দিলেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে নিলেন সশস্ত্র বাহিনীর অভিবাদন। এর পরে নেতারা মঞ্চে এসে চেয়ারে বসলেন।
প্রথমে উপরাষ্ট্রপতি। তারপর প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন। তারপর মন্ত্রী খন্দকার মুসতাক আহমদ, ক্যাপটেন মনসুর আলী, জনাব কামরুজ্জামান এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গনি উসমানি। স্বেচ্ছাসেবকরা পুষ্পবৃষ্টি করে তাদের অভিবাদন জানালেন।
জনাব আবদুল মান্নান শুরু করলেন অনুষ্ঠান সূচী। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ঘোষণাপত্র পাঠ করলেন দলের চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
সাড়ে ৭ কোটি বাঙালীর যে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ জন্ম নিল তার নাম হলো স্বাধীন গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলা দেশ। তখন সারা আকাশে ছিল থোকা থোকা মেঘ। চারটি ছেলে প্রাণ ঢেলে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গাইল। এর আগে পবিত্র কোরান শরীফ থেকে তেলাওয়াৎ করা হলো।
তারপর উঠে দাঁড়ালেন স্বাধীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। পায়জামা আর পাঞ্জাবী পরনে। শুরুতেই তিনি বললেন : অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে আমি তাজুদ্দিন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তার পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি। একে একে তিনি পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার তিন সহকর্মীর সঙ্গে। তারপর ঘোষণা করলেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল উসমানির নিয়োগ। আর বললেন সেনাবাহিনীর চীফ অব ষ্টাফ পদে নিয়োগ করা হয়েছে কর্নেল আবদুর রবকে।
তিনি সাড়ে ৭ কোটি বাঙালী মনমানসের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কথা বারবার বললেন। তার প্রতিভা, ব্যক্তিত্ব, আত্ম ও স্বার্থত্যাগ এবং বিরাট রাজনৈতিক জীবনের বর্ণনা দিলেন। তিনি বলেন, আজ এই আম্র কাননে একটি নতুন জাতির জন্ম নিল। বিগত বৎসর যাবৎ বাংলার মানুষ, তার নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগোতে চেয়েছেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থ কখনোই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের উপর আক্রমন চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগোতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের উপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারকে বিতাড়িত করবোই। আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই।’
তিনি বলেন, আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই।
‘আপনারা জানেন, পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সব কিছু পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার। আমি জোর দিয়ে বলছি তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। জাতির সংকটের সময় আমরা তার নেতৃত্ব পেয়েছি। তাই বলছি পৃথিবীর মানচিত্র আজ যে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম লগ্নের সূচনা হলো তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোন শক্তি তা মুছে দিতে
পারবে না।
আপনারা জেনে রাখুন, গত ২৩ বছর ধরে বাংলার সংগ্রামকে পদে পদে আঘাত করেছে পশ্চিমের স্বার্থবাদী, শিল্পপতি পুঁজিবাদী ও সামরিক কুচক্রীরা।
আমরা চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের অধিকার আদায় করতে। লজ্জার কথা, দুঃখের কথা ঐ পশ্চিমারা শেরে বাংলাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। তাই ওদের সঙ্গে আপোস নেই। নেই ক্ষমা।
আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষনজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতীত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের (অসমাপ্ত) )
[পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়নি]
জয়বাংলা ॥ ১ : ১ ॥ ১১ মে ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন