You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.11 | জাতির আজিকার এই সংকট সময়ে আপনার আমার দায়িত্ব -তাজুদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার | জয়বাংলা - সংগ্রামের নোটবুক

জাতির আজিকার এই সংকট সময়ে আপনার আমার দায়িত্ব
-তাজুদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

স্বাধীন বাংলাদেশ আর তার সাড়ে সাত কোটি সন্তান আজ চূড়ান্ত সংগ্রামে নিয়োজিত। এ সংগ্রামের সফলতার উপর নির্ভর করছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর-আপনার, আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ। আমাদের এ সংগ্রামে জয়লাভ করতেই হবে এবং আমরা যে জয়লাভ করব তা অবধারিত।
মনে রাখবেন আমরা এ যুদ্ধ চাইনি। বাঙলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক উপায়ে বিরোধের মীমাংসা করতে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি শোষকশ্রেণী ও রক্তপিপাসু, পশুশক্তির মুখপাত্র ইয়াহিয়া-হামিদ-টিক্কা খান সে পথে পা না বাড়িয়ে বাঙালীর পাট বেচা টাকায় গড়ে তোলা সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের উপর সর্বশক্তি নিয়ে। তারা নির্বিচারে খুন করছে আমাদের সন্তানদের, মা-বাপদের, ইজ্জত নষ্ট করছে মা-বোনদের, আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম। তাই আমরা আজ পাল্টা হামলায় নিয়োজিত হয়েছি। গঠন করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার। এ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হলো বাঙলাদেশকে শত্রু-কবল হতে মুক্ত করা। বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রামের ধর্ম, মত, শ্ৰেণী বা দল নেই। বাঙলার মাটি, পানি ও আলো বাতাসে লালিত-পালিত প্রতিটি মানুষের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালী। আমাদের শত্রুপক্ষ আমাদের সেইভাবেই গ্রহণ করেছে। তাই তারা যখন কোথাও গুলি চালায়, শহর পোড়ায় বা গ্রাম ধ্বংস করে তখন তারা আমাদের ধর্ম দেখে না, মতাদর্শ দেখে না-বাঙালী হিসাবেই আমাদেরকে মারে।
স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকার সকল রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী, সমৃদ্ধ সুন্দর সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
তাই জাতির এই মহাসঙ্কট মুহূর্তে স্বাধীন বাঙলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আপনাদের প্রতি আমার আবেদন :
(১) কোন বাঙালী কর্মচারী শত্রুপক্ষের সাথে সহযোগিতা করবেন না। ছোট-বড় প্রতিটি কর্মচারী স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকারের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করবেন। শত্রু কবলিত এলাকায় তারা জনপ্রতিনিধিদের এবং অবস্থা বিশেষে নিজেদের বিচারবুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন।
(২) সরকারী, আধা-সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের যে সমস্ত কর্মচারী অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা স্ব স্ব পদে বহাল থাকবেন এবং নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকার ও মুক্তিফৌজকে সাহায্য করবেন।
(৩) সকল সামরিক, আধা-সামরিক লোক কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত-অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দিবেন। কোন অবস্থাতেই শত্রুর হাতে
পড়বেন না বা শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না।
(৪) স্বাধীন বাঙলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারও বাঙলাদেশ থেকে খাজনা, ট্যাক্স, শূল্ক আদায়ের অধিকার নেই। মনে রাখবেন আপনার কাছ থেকে শত্রুপক্ষের এভাবে সংগৃহীত প্রতিটি পয়সা আপনাকেও আপনার সন্তানদের হত্যা করার কাজে ব্যবহৃত করা হবে। তাই যে কেউ শত্রুপক্ষকে খাজনা-ট্যাক্স দেবে অথবা এ ব্যাপারে তাদেরকে সাহায্য করবে, বাঙলাদেশ সরকার ও মুক্তিফৌজ তাদেরকে জাতীয় দুশমন বলে চিহ্নিত করবে এবং তাদের দেশদ্রোহের দায়ে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।
(৫) যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে নৌ চলাচল সংস্থার কর্মচারীরা কোন অবস্থাতেই শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না। সুযোগ পাওয়া মাত্রই তাঁরা যানবাহনাদি নিয়ে শত্রু কবলিত এলাকার বাহিরে চলে যাবেন।
(৬) নিজ নিজ এলাকার খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। আর এ চাহিদা মিটানোর জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখবেন বর্তমান অবস্থায় বিদেশী খাদ্যদ্রব্য ও জিনিষপত্রের উপর নির্ভর করলে তা আমাদের জন্যে আত্মহত্যার শামিল হবে। নিজেদেরে ক্ষমতা অনুযায়ী কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে এবং দেশজ দ্রব্যাদির উপর নির্ভর করতে হবে। স্থানীয় কুটিরশিল্প বিশেষ করে তাঁতশিল্পের উপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
(৭) কালোবাজারী, মুনাফাকারী, মওজুদদারী, চুরি, ডাকাতি, বন্ধ করতে হবে; এদের প্রতি কঠোর নজর রাখতে হবে। জাতীয় এই সঙ্কট সময়ে এরা আমাদের এক নম্বর দুশমন। প্রয়োজনবোধে এদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
(৮) আর এক শ্রেণীর সমাজবিরোধী ও দুষ্কৃতিকারী সম্পর্কেও সদা সচেতন থাকতে হবে। এদের কার্যকলাপ দেশদ্রোহমূলক। এদেরকে চিনে রাখতে হবে। কেন না, এরাই হলো আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু। এরা ধর্মের দোহাই দিয়ে, অখণ্ডতার বুলি নিয়ে সরলপ্রাণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। এদের আসল পরিচয়, এরা পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি ও শোষকদের স্থানীয় দালাল। এরা ধর্মের লেবাস পরে পীর, মুরশেদ, আলেম, মৌলবী হিসেবে জনগণের মধ্যে অনুপ্রবেশ করে। একবার এদের খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার নেই। এ ধরনের লোক সম্পর্কে সাবধান থাকতে হবে। এদেরকে দেশদ্রোহিতা ও বেইমানির পথ ছেড়ে দেবার জন্য বলতে হবে। তাতেও যদি তাদের শুভবুদ্ধির উদয় না হয় তবে তাদের বিষ দাঁত ভেঙে দিতে হবে, অথবা তাদেরকে ধরে এনে মুক্তিফৌজের হাতে অর্পণ করতে হবে। কর্তৃপক্ষ দেশদ্রোহের অভিযোগে এদের বিচার করবেন এবং এদের শাস্তির ব্যবস্থা করবেন। বলা বাহুল্য, দুনিয়ার সর্বত্র দেশদ্রোহের একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড।
(৯) গ্রামে গ্রামে রক্ষীবাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম শিক্ষাশিবিরে রক্ষীবাহিনীর স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠাতে হবে। গ্রামের শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষা ছাড়াও এরা প্রয়োজনবোধে মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে। আমাদের কোন স্বেচ্ছাসেবক বা কর্মী যাতে কোন অবস্থাতেই শত্রুর হাতে না পড়ে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
(১০) শত্রুপক্ষের গতিবিধির সমস্ত খবরাখবর অবিলম্বে মুক্তিবাহিনীর কেন্দ্রে জানাতে হবে।
(১১)স্বাধীন বাঙলা মুক্তিবাহিনীর যাতায়াত ও যুদ্ধের জন্য চাওয়া মাত্র সমস্ত যানবাহন (সরকারী বা বেসরকারী) মুক্তিবাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
(১২) বাঙলা মুক্তিবাহিনী অথবা বাঙলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারও কাছে পেট্রল, ডিজেল, মবিল ইত্যাদি বিক্রি করা চলবে না।
(১৩) কোন ব্যক্তি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর অথবা তাদের এজেন্টদের কোন প্রকারের সুযোগ-সুবিধা, সংবাদ সরবরাহ অথবা পথনির্দেশ করবেন না। যে করবে তাকে আমাদের দুশমন হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
(১৪) কোন প্রকার মিথ্যা গুজবে কান দেবেন না বা চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। মনে রাখবেন যুদ্ধে অগ্রাভিযান ও পশ্চাদাপসরণ দু’টাই সমান গুরুত্বপূর্ণ। কোন স্থান থেকে মুক্তিবাহিনী সরে গেছে দেখলেই মনে করবেন না যে, আমরা সংগ্রামে বিরতি দিয়েছি।
(১৫) বাঙলাদেশের সকল সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্র সহ নিকটস্থ মুক্তিবাহিনী শিবিরে রিপোর্ট করতে হবে। এ নির্দেশ সকল আনসার, মোজাহিদ ও প্রাক্তন সৈনিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
(১৬) শত্রুবাহিনীর ধরা-পড়া সমস্ত সৈন্যদের মুক্তিবাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হবে। কেন না, জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগৃহীত হতে পারে।
(১৭) বর্বর ও খুনী পশ্চিমা সেনাবাহিনীর সকল প্রকার যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
(১৮) তথাকথিত পাকিস্তান বেতারের মিথ্যা প্রচারে আদৌ বিশ্বাস করবেন না। এদের প্রচার অভিযানের একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো আমাদের সাফল্য সম্পর্কে বাঙালীর মনে সংশয়, সন্দেহ, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা এবং হতাশা আনয়ন করা।
উপসংহারে বাঙলার মানুষের প্রতি আমার আবেদন, আপনারা নিজের উপর বিশ্বাস হারাবেন না। আমাদের চূড়ান্ত বিজয় সম্পর্কে মনে এতটুকু সন্দেহ পোষণ করবেন না। কেন না, আমাদের এ সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, এ সংগ্রাম সত্যের সংগ্রাম, এ সংগ্রাম আজাদীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এটা আমার কথা নয়। এ কথা বলেছেন আপনার আমার তথা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ভুলে যান আজ আপনার ধর্ম, বর্ণ, পেশা কি? আমরা সবাই বাঙালী। আমি আগেই বলেছি শত্রু আজ আপনার আমার ধর্ম বিচার করছে না। শুধু বাঙালী হওয়ার অপরাধে আজ আপনাকে আমাকে মারছে, আপনার আমার বাড়ী-ঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে। শত্রু মসজিদে, মন্দিরে, গীর্জায় আশ্রয়গ্রহণকারী ও প্রার্থনারত নিরীহ মানুষকে হত্যা করতেও ছাড়ছে না। তাই আজ আপনার আমার একমাত্র কর্তব্য, নিজেদের যথাসর্বস্ব এমনকি প্রাণ দিয়েও বাঙলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সাথে সহযোগিতা করা আর শত্রুকে ঘায়েল করা। আমাদের ঐক্য বজায় থাকলে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কেন, দুনিয়ার কোন শক্তিই আমাদেরকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে পারবে না।
‘জয় বাঙলা’।

জয়বাংলা (১) ॥ ১।১। : ১১ মে ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন