You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.24 | বাংলাদেশ সরকারি কর্মীদের দেশগড়ার শপথ গ্রহণ ঢাকায় - জমায়েতে প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন | আনন্দবাজার - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ সরকারি কর্মীদের দেশগড়ার শপথ গ্রহণ ঢাকায়
জমায়েতে প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন
পার্থ চট্টোপাধ্যায়

ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর-পুরোনো পল্টনের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে আজ ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের দশ হাজার কর্মচারী হাত তুলে শপথ নিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে দেশ পুণর্গঠনের জন্য তাঁরা জীবন উৎসর্গ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শ্রী তাজুদ্দিনের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ওঁরা বলেছেন, “তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’। এই ঢাকা সেক্রেটারিয়েটের কর্মীরাই গত মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলনের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে সরকারি প্রশাসন-যন্ত্র অচল করে দিয়েছিলেন। বহু নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের তমসা অতিক্রম করে পুরোনো পল্টনে আবার মুক্তির আনন্দে উত্তাল হয়ে উঠেছে। প্রধানমন্ত্রী শ্রী তাজুদ্দিন, অর্থমন্ত্রী শ্রী মনসুর আলি, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কামারুজ্জামান ও পররাষ্ট্র মন্ত্রী শ্রী খন্দকার সেক্রেটারিয়েট উপস্থিত হলে দিকবিদিক প্রতিধ্বনিত করে ওঁরা আওয়াজ তোলে, জয় বাংলা। তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব।
পুরোনো পলটনের নতুন সেকরেটারিয়েট ভবনে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে দশ হাজার মানুষের জমায়েতকে উদ্দেশ্য করে আজ সকালে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি আপনাদের কাছে দাবি করছি, আপনাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। লাল ফিতে, নীল ফিতে বাঁধন ছিঁড়ে বৈপ্লবিক মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে দেশ গঠনের কাজে।
প্রধানমন্ত্রী সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, একথা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাই, সমাজে যারা বিশৃক্মখলা সৃষ্টি করেছে, যারা পাকিস্তানের দালালি করেছে, দস্যু বাহিনীর সহযোগিতা করেছে মনে রাখবেন তারা কেউ ক্ষমা পাবে না। তাদের যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচার করা হবে। তবে ব্যক্তিগতভাবে আপনারা কেউ আইন- শৃক্মখলা মাথায় তুলে নেবেন না। বাংলার মাটিকে যাঁরা ভালবাসেন, তাঁদের আমরা রক্ষা করব। কেউ বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে-শুধু বাংলা ভাষার কথা বললেই ক্ষমা পাবেন না। আবার বাংলাতে কথা না বললেই বিনা বিচারে কাউকে কোনও দণ্ড দেওয়া হবে না৷
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মধ্যেও কোটিখানেক মানুষ যারা ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাঁদের পূর্বেকার ব্যবসায়ে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এই গুরুদায়িত্ব আমাদের যুদ্ধকালীন অবস্থা মনে করে পালন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এমন এক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই যে, সমাজে শ্রমিক তার শ্রমের যোগ্য মর্যাদা পাবে। কৃষক তার ক্ষেতের ফসল ভোগ করতে পারবে। যে সমাজে ভূমিহীন কৃষক তার জমি পাবে। বেকার কাজ পাবে। প্রতিটি পিতামাতা তার সন্তানকে শিক্ষিত করে তুলতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আমাদের আদর্শ। ধর্ম সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত ব্যাপার। ধর্মের নামে জবরদস্তি চলবে না (হাততালি) ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ রাজনীতি করতে পারবেন না (শ্রোতাদের উল্লাস)। মনে রাখবেন, বিশৃক্মখলার জন্য আমাদের দেশের মানুষ প্রাণ দেয়নি। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ শাসন প্রবর্তনের জন্য আমাদের মানুষ প্রাণ দিয়েছে। তাই গঠনমূলক কাজের জন্য আগে দরকার শান্তি প্রতিষ্ঠা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রায় প্রতিটি বাঙালিই আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন। দালালদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবে যারা বিবেকের বিরুদ্ধে কাজ করেছে, তাদের সম্বন্ধে আমরা বিবেচনা করব। আমরা ‘উইচ হানটিং’ করতে চাই না। তবে যারা প্রকাশ্য দিবালোকে শত্রুর সঙ্গে, সহযোগিতা করেছে, তাদের ছাড়ব না। যাদের বিবেক পরিষ্কার, তাদের ভাববার কিছু নেই। যাদের বিবেক পরিষ্কার নেই, তাদের বলি বিবেকের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিন। আমাদের যে সমস্ত অবলা মা-বোনেরা ইজ্জৎ খুইয়েছেন, তাঁদের আমরা পূর্ণ মর্যাদার সঙ্গে মাতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। লাঞ্ছিত মা-বোনদের সমাজে তুলে নিতে হবে।

ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা
প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের মধ্যে অনেকখানি জুড়ে ছিল ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। প্রধানমন্ত্রী যখন ভারতের প্রসঙ্গ উত্থাপন করছিলেন, তখন জনতা অকুণ্ঠ-চিত্তে তাঁকে অভিনন্দিত করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ মহান ভারতের মহান জনগণ ও মহীয়সী নেত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমরা কৃতজ্ঞতা জানাই। (ধ্বনি : ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী জিন্দাবাদ। ভারতের প্রধানমন্ত্রী জিন্দাবাদ)। আমাদের এই বিপদে ভারত শুধু এগিয়েই আসেনি।
দৈনিক আনন্দবাজার, ২৪ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন