বাঙলা দেশের মুক্তিযুদ্ধ
স্বতস্ফূর্ততার স্তর শেষ : এবার সংগঠন
যোগাযোগ কর : সংগ্রাম পরিষদ ও মুক্তিবাহিনীর শাখাগুলির প্রতি নির্দেশ
আওয়ামী লীগের সমস্ত সংগ্রাম পরিষদ, মুক্তিবাহিনী সমস্ত শাখাকে তাজুদ্দিন আমেদের সঙ্গে যোগাযোগ কর। বুধবার বাঙলাদেশের জনগণ প্রজাতান্ত্রিক সরকার এই নির্দেশ জারি করেছেন। তাজুদ্দিন হলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
ইউ এন আই আরও জানিয়েছে, বাঙলাদেশের যে বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে মুক্তিবাহিনী ও সংগ্রামী জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীকে উৎখাত করেছে এখন সেই জায়গায় নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার কাজে মুক্তিবাহিনী তৎপর।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা এখনও আশা ছাড়েনি। এখনও তারা লড়েছ তবে শহরের মধ্যে নয় আশেপাশে। ওদিকে পশ্চিম থেকে সামরিক প্রশাসকের প্রচারকরা বলছে সব কিছু ঠিক আছে- সব কিছু স্বাভাবিক।
২৫ মার্চ রাত ১২-টার পর থেকে বুধবার ছ’দিন পার হলো। এই ছ’দিন ধরে বাংলাদেশের সবত্র চলেছে প্রাণ দেওয়া নেয়ার উন্মাদনা। এখন জয়ের পালা। অতএব জয়কে সংহত করার পালাও বটে। তাই সমস্ত সংগ্রাম পরিষদের কাছে, সমস্ত মুক্তি বাহিনীর কাছে ঐ নির্দেশ গেছে যোগাযোগ কর। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুদ্দিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করার এই নির্দেশ দেওয়া হলেও কোথায় যোগাযোগ করতে হবে তা বলা হয়নি। তবে এই নির্দেশ হলো স্বতঃস্ফূর্ত স্তর থেকে সংগঠিত অভিযানের সূচনা।
শ্রী তাজুদ্দিন, বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের বিশ্বস্ত সঙ্গী, ইয়াহিয়া যে আলোচনা ভেঙে দিয়ে পশু শক্তি নিয়ে নিরস্ত্র জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাজুদ্দিন ছিলেন সেই আলোচনার অন্যতম সদস্য। তাজুদ্দিনের সদর দপ্তর বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা জানেন তাই শত্রুকে জানানো হয়নি কোথায় তিনি আছেন।
বুধবারও লড়াই চলছে। তবে এখন লড়াই হলো পশ্চিম পাকিস্তান সৈন্যদলকে আত্মসমর্পণ করার জন্য লড়াই। কুষ্ঠিয়ার জনসাধারণ মুক্তি উৎসব করলেন বন্দী সৈন্যদের রাস্তায় মার্চ করিয়ে। সৈয়দপুরে, যেখানে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালিয়ে স্ফুর্তি করেছিল সেখানে সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করছে।
স্বাধীন বাংলার বেতার কেন্দ্র আজ শোনা যায় নি। সাইক্লোনের আবহাওয়া দরুণ।
দুই একদিনের মধ্যে ঢাকা থেকেই স্বাধীন সরকারের প্রচার শোনা যাবে। বিধ্বস্ত বেতার কেন্দ্রটি প্রচারের উপযোগী করার জন্য ৩৫ জন ইঞ্জিনিয়ার দিনরাত পরিশ্রম করছেন। বুধবার ঢাকা বেতার থেকে আগরতলায় এক পরিচিত কণ্ঠস্বর শোনা গেছে। লড়াই শুরু হওয়ার পূর্বে এই ঘোষকের কণ্ঠ শোনা যেত।
চট্টগ্রাম শহরে বুধবারও লড়াই চলছে। এখানে সৈন্যরা মুক্তি যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে ট্যাঙ্ক ব্যবহার করছে।
ঢাকার কাছে তেজগাঁও বিমান বন্দরটি দখলের জন্য তীব্র লড়াই চলছে। ঠাকুরগাঁও পার্বতীপুর শহর এবং সাহেবগঞ্জ ও লালমনিরহাট বিমান বন্দরটি মুক্তি বাহিনীর হাতে তবে দিনাজপুরে লড়াই চলছে।
শ্রীহট্টের মুক্ত জনগণ সৈন্যদের দ্বারা নতুনভাবে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন।
যশোর, খুলনা এবং কুমিল্লার বেশির ভাগ এলাকা মুক্তি বাহিনীর দখলে থাকলেও কিছু অংশে পশ্চিমী সৈন্যরা এখন লড়ছে।
রংপুর এখনও পাকিস্তানী সৈন্যদের দখলে কি মুক্তি বাহিনী চারদিক থেকে তাদের ঘিরে ফেলেছে।
বিতাড়িত তিন জন অফিসার এবং বেশ কিছু সৈন্যরা সীমান্ত পার হয়ে ত্রিপুরার কর্তৃপক্ষের কাছে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছে।
পর্যুদস্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের এখনও সর্বপ্রকারে সাহায্যে দেওয়ার জন্য বিমান বাহিনী চেষ্টা করছে।
বুধবার রাজশাহীতে আবার বোমা ফেলা হয়েছে। ইতিপূর্বে এখানে বোমা ফেলে প্রচুর ক্ষতি করা হয়েছিল। শিবগঞ্জেও বোমা পড়েছে।
ঢাকা এবং চট্টগ্রাম ছাড়া রংপুর এবং দিনাজপুরেও ট্যাঙ্ক ব্যবহার করা হচ্ছে।
চট্টগ্রামের কাছে কক্সবাজার বিমান বন্দরটি মুক্তিফৌজের হাতে। ওখানে দুটি ডাকোটা বিমান এবং একটি হেলিকপ্টার মুক্তিফৌজের দখলে এসেছে।
তিনদিন লড়াই-এর পর মঙ্গলবার মুক্তি-বাহিনী কুমিল্লার কাছে ফকির হাট রেল সেতুটি দখল করেছে। এখানে উভয় পক্ষেরই বেশ কিছু হতাহত হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ দখলের চেষ্টা ব্যর্থ
শীতলক্ষা নদীর ওপর নারায়ণগঞ্জ বন্দরটি দখলের জন্য পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করার জন্য মুক্তি বাহিনী ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ সড়কটি কেটে দিয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরে এই বন্দরটির সামরিক গুরুত্ব অসীম। এই বন্দরটি নদী পথে কুমিল্লা নোয়াখালী অঞ্চলে নদী পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে।
রাজশাহীতে দশ হাজার নিহত
আমাদের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন বুধবার বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এবং সোপুরায় হানাদারদের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রাম চালাচ্ছে। মুক্তিফৌজ আশা প্রকাশ করছেন আজ রাতেই ঐ দুটি স্থান দখল হয়ে যাবে।
নাটোর মুক্তিফৌজের দখলে
সংবাদদাতা— মুক্তিফৌজের দাবি অনুযায়ী জানাচ্ছেন যে দাসুরিয়াতে পশ্চিম পাকিস্তানী সশস্ত্র হানাদারের একটি গাড়ি “গোপন গর্তে” পড়ে যায়। ফলে হানাদাররা সকলেই প্রাণ হারায়। হানাদারদের খতম করার জন্য মুক্তিফৌজ অনেক গুপ্ত গর্ত তৈরি করেছে।
সংবাদদাতা আরও জানাচ্ছেন গতকাল সকাল আটটায় রাজসাহীতে নওহাটার এরোড্রমে হানাদাররা রকেট চালায়। ঐ এলাকায় বোমা এবং রকেট বর্ষণে প্রায় দশহাজার লোক নিহত হয়েছেন বলে জানা গেল। হানাদারা রেডিও স্টেশনটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে জিনিসপত্র লুঠ করে নিয়ে গেছে।
দৈনিক কালান্তর, ১ এপ্রিল ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন