You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থী শিবিরে
(শিবির প্রতিনিধি)

এখনো শরণার্থীরা আসছেন : ৫ লক্ষ শিশু মারা যাবে? শরণার্থীরা বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছেন ভারত সরকার ‘ইসিএমে’র সাহায্য চেয়েছেন : করিমপুরে শিবিরবাসীদের জন্য হাসপাতাল পশ্চিম বাংলার সীমান্তবর্তী জেলা সমূহের শরণার্থী শিবিরগুলিতে এখনো প্রতিদিনই হাজার হাজার নতুন শরণার্থী এসে পৌচাচ্ছেন এদিকে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ দাবী করছে, বাংলাদেশের পরিস্থিতি ‘শান্ত’ এবং শারণার্থীরা ধীরে ধীরে ফিরে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও পৈতৃক ভিটামাটির আকর্ষণে কিছু কিছু শরণার্থী ফিরে যাবার চেষ্টা যে করছেন না, তা নয়। কিন্তু প্রায় ক্ষেত্রেই মাঝপথ থেকেই তাঁদের ফিরে আসতে হচ্ছে। যারা কোন প্রকারে নিজ নিজ গ্রামে পৌঁছাতে পেরেছেন তাঁদেরও অধিকাংশকে পুনরায় ভারতে চলে আসতে হচ্ছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় এ ধরনের ঘটনা নিত্যই ঘটছে। তাছাড়া মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বাড়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর এবং ক্ষেত্র বিশেষে অভ্যন্তরভাগেরও বহু থানা, ইউনিয়ন এমনকি মহকুমা এখন কার্যত মুক্তাঞ্চল। কিন্তু পাক-বাহিনীর দূর পাল্লার কামান ও বিমান হামলা।
এ সব অঞ্চলে বেসামরিক জনসাধারণের অবস্থান বিপদসংকুল করে তুলেছে। ফলে এ সব এলাকার সাধারণ মানুষ যারা এতদিনও কোনপ্রকারে ভিটেমাটি আঁকড়ে থেকেছে তারা এখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে আসছেন।
বাংলাদেশের ভেতরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাষাবাদ বন্ধ থাকায় এবং বাড়তি এলাকা থেকে ঘাটতি এলাকায় খাদ্য শস্যাদির সরবারাহ না থাকায়, স্থানে স্থানে চরম দুর্ভিক্ষাবস্থা দেখা দিয়েছে। তাছাড়া উন্নয়নমুলক কার্যকলাপ বন্ধ থাকায় এবং ব্যবসা বাণিজ্যে অচলাবস্থা দেখা দেওয়ায় দিনমজুর ও বেসরকারী সংস্থার কর্মচারীরা অধিকাংশই এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। এ ধরনের ব্যক্তিরা নেহাৎ পেটের তাড়ায় দেশত্যাগে বাধ্য হচ্ছেন এবং স্ত্রী-পুত্র-পরিজন নিয়ে শরণার্থী শিবির গুলিতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, পশ্চিম দিনাজপুর, মালদহ, নদীয়া, চব্বিশপরগনা প্রত্যেক জেলায় দৈনিক কয়েক হাজার নতুন শরণার্থী আসছেন। এদের অধিকাংশই হচ্ছেন মুসলমান চাষী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। গত সপ্তাহে কেবলমাত্র নদীয়া জেলাতেই দশহাজার নতুন শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসেছেন।
শরণার্থী শিবির গুলিতে শিশুখাদ্যে অভাব ক্রমেই বাড়ছে। কতিপয় বিদেশী ত্রাণসংস্থা এবং ভারতীয় রেডক্রস এর পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে কিছু পরিমাণ শিশুখাদ্য সরবরাহ করা হলেও, তা প্রয়োজন মেটাতে পারছে না। শিবিরাবাসীরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, তাঁদের প্রাপ্য শিশুখাদ্য সঠিকভাবে বিতরণ করা হয় না। বিভিন্ন শিবিরে অপুষ্টিনিত কারণে শিশুমৃত্যুর হার মারাত্মক রকমে বেড়েছে। কিছুদিন পূর্বে জাতিসংঘের জনৈক বিশেষজ্ঞ শিবিরগুলি পরিদর্শন করে বলেছিলেন, যথাযথ; ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হলে অচিরেই কমপক্ষে ৫ লক্ষ শিশুর মৃত্যুমুখে পতিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে।
পশ্চিম বাংলার বাজারে শিশুখাদ্য এমনিতেই দুষ্প্রাপ্য। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মত এখানেও একশ্রেণীর ব্যবসায়ী শিশুর খাদ্যের কালোবাজারীতে লিপ্ত রয়েছে এবং শরণার্থী শিবিরের জন্য প্রাপ্ত শিশু খাদ্যও কোন কোন ক্ষেত্রে কালো গুদামে চলে যাবার অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। ছাত্রপরিষদ এবং যুব কংগ্রেসের সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বিরোধী আন্দোলনের জের হিসাবে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি ঘটেছে এবং শিশুখাদ্য বিক্রীর ব্যাপারে কিছুটা কড়াকড়ি নিয়ম প্রবর্তিত হয়েছে। এর সুফল শরণার্থী শিবির গুলিতে পরোক্ষভাবে হলেও কিছুটা অনুভূত হতে পারে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হবে বলে মনে হয় না।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে শিশুদের প্রয়োজনের দিকে ত্রাণ সংস্থাগুলোর আরো কিছুটা বেশি নজর দেওয়া দরকার এবং বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত দ্রব্যাদির যথাযথ বিতরণ হচ্ছে কি না সেদিকেও আরো বেশি দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।
শরণার্থী শিবিরগুলি সীমান্তের খুব কাছাকাছি থাকায় এখানে মারাত্মক রকমের যুদ্ধাতংক বিরাজ করছে, এ ব্যাপারে আমরা গতবারেও আলোচনা করেছি। যুদ্ধ হোক বা না হোক, শরণার্থীরা যুদ্ধের বিভীষিকার মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে বিনিদ্র রাত কাটাচ্ছে, শিবিরগুলোতে ঘুরে এলেই তা হৃদয়ঙ্গম হবে।
যে ভীতি-সন্ত্রাসের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য শরণার্থীরা পিতৃপুরুষের ভিটামাটি ছেড়ে এসেছেন, সেই একই ভীতি-সন্ত্রাস এখানেও তাঁদের তাড়া করছে। ‘ঘর পোড়া গরু সিদুরে মেঘ দেখলেই ভয় পায়’, শরণার্থীদের অবস্থাও তথৈবচ। তা ছাড়া সীমান্ত এলাকাগুলিতে যুদ্ধ এক রকম লেগেই গেছে বলা যায় না কি?
শরণার্থী শিবিরগুলো সীমান্ত এলাকা থেকে দূরে সরিয়ে নতুন করে নির্মাণের খরচা এবং ঝক্কি বিরাট হবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু ক্ষেত্র বিশেষে তা’ করাই হয়তো বাঞ্চনীয় হবে। সীমান্ত থেকে বেশী দূরে সরিয়ে নিলে শরণার্থীরা ভারতের জনসাধারণের সাথে মিশে গিয়ে ভারতের জনসংখা বাড়িয়ে দিতে পারে, এ আশংকা কেউ কেউ করছেন। কিন্তু এভাবে ভয়-সন্ত্রাসের মধ্যে থাকতে হলে ক্রমাগত অধিক সংখ্যক শরণার্থী শিবির ছেড়ে যাবার পথ খুঁজবে এবং তার ফল আরো মারাত্মক হতে বাধ্য।
ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের জন্য কতিপয় ত্রাণ দ্রব্যাদির প্রয়োজন মেটাবার জন্য ‘ইউরোপীয় কমন মার্কেটের’ কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
এ যাবৎকাল বিভিন্ন সূত্রে পরিমাণ সাহায্য প্রতিশ্রুত হয়েছে সে হিসাবে ধরার পর ১৯৭১-৭২ সালে কি পরিমাণ অতিরিক্ত সাহায্য দান হবে, ভারত সরকার তার পরিমাণ তালিকাও সেই সাথে পেশ করেছে।
ভারত সরকারের হিসাবে ১৯৭২ সালে শরণার্থীদের জন্য ৩১১,০০০ টন চাল ১৭৫,০০০ টন গম, ৫০,০০০ টন চিনি, ১৮৭,০০০ টন ডাল, ৪০,০০০ টন লবণ ৮,৩০০ মণ গুঁড়া দুধ প্রয়োজন হবে। শরণার্থীদের জন্য সর্বমোট ৪,৩৪,০০০ খানা দরকার বলে হিসাব ধরা হয়েছে। এ ব্যাপারেও ই, সি, এম, এর সাহায্য চাওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি করিমপুরে বাংলাদেশের ভলান্টিয়ার কোরের উদ্যোগে আয়োজিত ১৫ বেডের হাসপাতাল প্রস্তাব হয়েছে। বাংলাদেশের জনপ্রতি দের পরিচালনাধীন এই হাসপাতালটিতে ডাক্তার, নার্স ও অন্যন্য সবাই বাংলাদেশে নাগরিকদের হাসপাতাল থেকে কয়েক লক্ষ রোগী উপকৃত হবেন বলে আশা করা যায়।
দেশ বাংলা ॥ ১ : ৪ ॥ ১৮ নভেম্বর

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!