শরণার্থীর চিঠি
দেবেন্দ্রনাথ দত্ত
সভাপতি, পটুয়াখালী জিলা সাহিত্য পরিষদ, বাংলাদেশ
(পবিত্র ঈদ উপলক্ষ্যে কলকাতা থেকে জয়বাংলা সম্পাদকের কাছে প্রেরিত)
আজ রমজানের পবিত্র ঈদ। মনে পড়ে অতীত বছরগুলির কথা। এমন দিন কত ঘরে মুসলীম ভাইদের দাওয়াত পেয়ে তাদের উৎসবের শরিক হতাম। আজ পড়ে আছি এক দুষ্পার দূরে। পড়ে আছি গভীর বেদনাভরা বুকে বাইরে জন্মভূমির কোলছিন্ন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। সাতপুরুষের আমল ধরে ভাই কাকা চাচা মামা দাদু দোস্থ এমনি নানা ডাকে যাদের সাথে চলে এসেছে আমাদের প্রীতির বাধন, তারা অনেকেই এখন আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে অলক্ষ্য দূরে তাই দূর থেকে সেই ফেলে আসা ভাইদের প্রতি জানাচ্ছি এবারের ঈদ মোবারক।
আমরা কেন এলাম দেশ ছেড়ে। ইচ্ছে করে নয়, বাধ্য হয়েছি আসতে। আমরা বিতারিত হয়েছি। বাংলার দুষ্টগ্রহেরা নৃশংস অত্যাচার, সর্বস্ব লুণ্ঠন, গণহত্যা, অগ্নিদাহ, মা-বোনের ওপর পৈশাচিক বর্বরতা- এমনি সব বীভৎস তাণ্ডবে এমন অসহ অবস্থা সৃষ্টি করেছিল, ভাইয়ের বিরুদ্ধে ভাইকে লেলিয়ে এমনি বিষময় করেছিল, আমাদের বেঁচে থাকার বাতাস যার ফলে নিঃস্ব বিপন্ন বিক্ষত হয়ে শেষটায় প্রতিবেশী দেশের দোরে আমাদের শরণপ্রার্থী হওয়া ছাড়া গতান্তর ছিল না।
কিন্তু, আপন মাতৃভূমি, আগ পুরুষের স্মৃতির মাখা ভিটে-মাটি, নিত্য দিনের মাঠ, ঘাট, নদী, খাল, আকাশ, গাছপালা, পাখী, আশৈশবের চেনা জানায় মাখামাখি প্রতিবেশীদের ছেড়ে কেউ কি পারে দীর্ঘদিন কৃপাধীন প্রবাসী জীবনে মনে শান্তি পেতে? পারে না। পাচ্ছি না। তাই বাংলাদেশের লখ লক্ষ শরণার্থী আমরা সব্দেশ মায়ের কোলে ফিরে যাওযার জন্যে ব্যাকুল।
দেশের মুসলমান ভাইরা আজ পবিত্র ঈদের উৎসবে মুখর। মনের ময়লা ঝেরে শুচিশুদ্ধ চিত্তে তারা জামাতে মিলে খোদার দরগায় মোনাজাত করবেন। এই মহতি অনুষ্ঠানের আসরে তাদের মনে কি পড়বে না স্বদেশ বিতাড়িত দুঃখী শরণার্থীদের স্মৃতির একটু খানি ছায়াপাত? তাদের প্রাণের তন্ত্রে বেজে উঠবে না কি আমাদের বেদনার সমতানে একটি করুণ সুর? আমরা জানি, নিশ্চয়ই তা হবে। তাই আবেদন করছি আসুন, এই পবিত্র দিনে এক আদম সন্তান আমরা বাংলার হিন্দু মুসলমান সকল ভাই অন্তরে অন্তর মিলিয়ে সকল বেদনা বাসনা নিবেদনের পরম ঠাই বিশ্ব-পিতার কাছে মোনাজাত করি, যেন অচিরে আমাদের বেদনা ও বিচ্ছেদের অবসান ঘটে, যেন পশু হাতের পেষণে বিতাড়িত বাংলার সন্তানেরা পূর্ণ নিরাপত্তা, পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে ফিরে যেতে পারে স্বদেশের কোলে প্রতিবেশীদের প্রীতির মাঝে; আসুন, আমরা আরো মোনাজাত করি, যারা খুনি চক্রের পৈশাচিক লীলায় ক্রীড়নক হয়ে বাংলার প্রতি মির্জাফরী বৃত্তিতে জড়িয়ে পড়েছেন, তারা যেন আগেই পাপমুক্ত হয়ে পবিত্র সুন্দর চিত্তে ভ্রান্তপথ থেকে ফিরে আসে।
চক্রান্তকারিদের মতলব ছিল তার জাগ্রত বাংলাকে জ্ঞানে অর্থে জনতয় দুর্বল করে বুকের পরে চির কায়েম করবে প্রভুত্বের মসনদ আর চিরকাল অকটোপাশের মতো ছাড়িয়ে যাবে শোষণ। তাদের সেই বর্বর বাসনা অলীক স্বপ্নে পরিণত হতে চলছে। খোদার রাজ্যে শয়তানীর দাপট চলতে পারে না বেশীদিনকে দিন নির্ঘাত নেমে আসে তার উপর তাঁর কঠিন ন্যায়দণ্ড।
সেই ন্যায়দণ্ড নেমে এসেছে মুক্তিকামী আহত বাঙালীর রক্ত শিরায়। নইলে কেন ঐ বঙ্গবন্ধু? কিসের উদ্দীপনায় সহস্রফণা বাসুকীর মতো ফুঁসে উঠেছে বাংলার তরুণেরা? কোন অগ্নিবলে বলীয়ান হয়ে ক্ষীণকায় অসামরিক বাঙালীর সন্তানেরা দুর্বার হয়ে মৃত্যুর পানে তুলে ধরেছেন পাঞ্জা, দুর্জয় সাহসে মরণ আহরে হুলী খেলছে দুর্ধর্ষ শত্রু দানবের রক্তে?
বাংলার স্বর্ণ প্রভাত উদয়ের পথে। তার অরুণ ছটায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে এমন বাংলা যেখানে থাকবে না কোনো শোষণ, কোনো নির্যাতন, দারিদ্রের পেষণ, বাইরের কোনো প্রভুয়ানা ব্যক্তি স্বাধীনতার কোনো বাঁধা; ধানে চালে দুধে মাছে, বারো মাসের তেরো পার্বনে প্রতিবেশীর পারস্পরিক অনাবিল আবার হাসবে আমাদের সুজলা শ্যামলা কণকভূষণা স্নেহময়ী বাংলা-মা। আসুন, পরম পালক মঙ্গলময়ের চরণতলে মোনাজাত করি, সেই শুভ আগমনীকে আমরা যেন অচিরে স্বাগত জানাতে পারি। জয় বাংলা।
জয়বাংলা ॥ ১ ॥ ৩২ ॥ ১৪ ডিসেম্বর
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন