শরণার্থীদের মাঝে কেনেডি সব শুনলেন, দেখলেন, বললেন:
ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
স্টাফ রিপোর্টার
কল্যাণী শরণার্থী শিবির। বুধবার দুপুর। ডাইনে বাঁয়ে সামনে শুধু জল। মাথার উপর শ্রাবণের অবিশ্রান্ত ধারা। তার মাঝে হেঁটে চলেছেন মারকিন সেনেটর কেনেডি। হঠাৎ সামনে একটি ডোবার মধ্যে পড়ে গেলেন। সবাই তাকে ধরে ওঠাবার জন্য হাত বাড়াতেই তরুণ সেনেটরের মন্তব্য কানে ভেসে এল: “দ্যাটস অল রাইট। ডোন্ট ওয়ারি।”
যাত্রা শুরু হয়েছিল সকাল ৮.৩০ মিনিটে রাজভবন থেকে। একটানা সাত ঘণ্টা ধরে ২৪ পরগনার বারাসত, নদীয়ার কল্যাণীর শরণার্থী শিবিরগুলি সফর করে বিকালে ফেরার পথে আবার লবণ হ্রদে। রাজভবনে যখন তিনি এসে পৌঁছলেন তখন ঘড়িতে সাড়ে তিনটে। অর্থাৎ একটানা সাত ঘণ্টা তিনি স্বচক্ষে দেখলেন পাক বর্বতার শিকার শরণার্থীদের দুর্গতি, স্বকর্ণে শুনলেন বাংলাদেশে পাক ফৌজের বর্বরতার কাহিনি।
রাজভবনে ফেরার পথে ইয়াহিয়া সরকার যে তাঁর ভিসা বাতিল করেছে সে সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য জানতে চাওয়া হলে তিনি একটি কথায় উত্তর দিলেন- ‘আনফরচুনেট”।
শরণার্থীদের অবস্থা দেখে তাঁর কী ধারণা হল- এ প্রশ্নেরও সংক্ষিপ্ত জবাব, “মানব ইতিহাসের এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।”
রাজভবন থেকে বারাসত হয়ে কল্যাণী প্রায় ৪০ মাইল। এই দীর্ঘ পথের বিভিন্ন স্থানে বহু নরনারী,- কোলেশিশু বহু জননী সময় ধরে অপেক্ষা করেছেন। আসা-যাওয়ার পথে হর্ষধ্বনি করে তাঁরা অতিথিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। সকলের সঙ্গেই টেড কথা বলতে চান। সঙ্গে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিভাগের অনেক কর্মী। কোন নিরাপত্তার সতর্কতা তিনি মানবেন না। কল্যাণীতে নদীয়ার জেলা শাসককে বলে দিলেন, এই ইউনিফরম পরা, ভদ্রলোকেরা আমার সঙ্গে কেন আসছেন। ওদের নিষেধ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ইউনিফরম পরা সব অফিসার দূরে সরে গেলেন।
সাহারা হাসপাতালে
এদিন রাজভবন থেকে বেরিয়ে সকাল সওয়া ন’টার সময় প্রথম যাত্রা-বিরতি দমদম সাহারার কাছে মাদারটেরেসার হাসপাতালে। সেনেটর কেনেডি ঘুরে ঘুরে দেখলেন প্রতিটি রোগীকে। কথা বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, কেন এসেছেন, কবে এসেছেন, এখানে কেমন আছেন? ওদের জবাবগুলি দোভাষী অনুবাদ করে জানালেন। শ্রীকেনেডি মারকিন ডেমোক্রাট সেনেটের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত বৈদেশিক বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান। এদিনকার পাঁচ মিনিটের সাংবাদিক বৈঠকে শ্রীকেনেডি অন্তত পক্ষে চারবার ৭৫ লাখ শরণার্থীর কথা উল্লেখ করে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
কেনেডির অন্যতম সঙ্গী কথায় কথায় জানালেন, টেডের এ স্বভাব বরাবরের। সবকিছু সে যাচাই করে দেখে নিতে চায়। দেখছেন না, চারিদিকে শরণার্থীরা কাতারে কাতারে ভেঙে পড়েছে। তিন-চারশ রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার তাঁকে ঘিরে দাঁড়িয়ে। কেনেডি-জিন্দাবাদ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা চাই,স্বাধীনতা চাই, শেখ মুজিবের মুক্তি চাই—কত রকমের ধ্বনি আবেগ। কিন্তু এরই ভিতর টেড খুব আস্তে মনোযোগ সহকারে শরণার্থীদের কথা শুনছেন। প্রয়োজন মতো তাঁর সঙ্গীদের নোট নিতে বলছেন। এ সবকিছুই তাঁর দেশে গিয়ে কাজে লাগবে।
দমদম বিমানবন্দরে বিমান থেকে যখন নামছিলেন তখন দেখেছিলাম তাঁর পরনে কালো স্যুট। ওখানে তাঁকে ভাল করে দেখতেও পারিনি। দেশী-বিদেশী ফটোগ্রাফার ও রিপোর্টাররা দাঁড়িয়ে ছিলেন। রাশিয়ায় শ্রীনিকিতা ক্রুশ্চভের সময় বাদ দিলে গত কয়েক বছরের ভিতর দমদম বিমানবন্দরে ফটোগ্রাফারও রিপোর্টারের ভিড় আমি দেখিনি। বিমানবন্দর থেকে ছুটে প্রেস কনফারেনসে।
সাংবাদিক বৈঠক
শ্রী কেনেডি রিপোর্টারদের কাছে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তাঁর ভারত পরিদর্শনের কথা বলে ফেলেন। দমদম বিমানঘাঁটিতে ঠাসা সাংবাদিক বৈঠক। মাইকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখলেন ঘরের চারদিকে আলোয় আলোময়। সবার দৃষ্টি তাঁর দিকে নিবন্ধ। টেলিভিশন টিম থেকে শুরু করে ফটোগ্রাফার পর্যন্ত। আস্তে খুব অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বললেন, ভারতে ৭৫ লক্ষ উদ্বাস্তুর অসহায় অবস্থা হতাশা ও দুঃখের বোঝা মারকিন যুক্তরাষ্ট্র দূর করতে চেষ্টা করবে।
বয়ড়ায় পৌঁছেই সোজা চলে গেলেন সীমান্তের খেয়াপারাপারের মাঝিদের কাছে। নিজেই প্রশ্ন করলেন, ‘কতদিন’? এভাবে লোকপারাপার করছেন? সাহেবের মুখে ইংরেজি কথা মাঝি বুঝে উঠতে পারেনি। বুঝিয়ে দিলেন তাঁর দোভাষী। বাংলায় সে বলল, ‘স্যার আমার নাম মোবারক আলি। সেই চত্তির মাস থেইকা এই পারাপারের কাজ করতেছি। দৈনিকই স্যার হাজার হাজার লোক এই পারে চইলা আসতেছে।’
সেনেটর কেনেডি বলেন, ‘ভারতে আমি এই প্রথম এলাম। আমার দাদা পরলোকগত মারকিন প্রেসিডেন্ট ১৯৫১ সনে ভারতে এসেছিলেন। ভারতের কথা তাঁর কাছেই শুনেছি। প্রায়ই দাদা আমাকে এই দেশের কথা বলতেন। ভালই লাগত শুনতে।’ উদ্বাস্তু ও গৃহহারাদের জন্য তাঁর সমবেদনা চিরদিনের। তাঁর মতো আরও অনেক সেনেটর আছেন। স্বচক্ষে উদ্বাস্তুদের অবস্থা দেখে যাওয়ার জন্যে তিনি আগ্রহী ছিলেন। এ যাত্রা বিফল হবে না বলে তাঁর আশা।
দমদমে একজন সাংবাদিক তাঁকে প্রশ্ন করেন, শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে আপনি কিছু বলবেন ?
শ্রী কেনেডি ফিরে যাচ্ছিলেন। প্রশ্নটি শুনে ফিরে দাঁড়ালেন। টেলিভিশনের জোরালো আলোয় তাঁর লালচে মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। মাইকে হাত রাখলেন। কিছু বলতে গিয়েও বললেন না। ‘নট নাউ’ বলে জোর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন।
দমদম বিমানবন্দরে যে কেনেডিকে দেখেছিলাম, সেই কেনেডির সঙ্গে শরণার্থীদের মধ্যে কেনেডির অনেক তফাৎংঃ সেখানে তিনি যেন শরণার্থীদের একেবারে কাছে চলে গিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে মিশে গিয়েছেন। তাঁকে দেখলাম লবণূহ্রদে শিবিরে, হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগীর পাশে বসে সম্পর্কে তাঁর সবকিছু জিজ্ঞাসা করতে। মহিলা ওই রোগীটির গায়ে হাত দিয়ে কেনেডি বললেন, ‘বোন, আপনার কি হয়েছে? কতদিন এখানে এসেছেন? ভদ্রমহিলা কেনেডির দিকে একবার তাকিয়ে পাশ ফিরে শুলেন। দোভাষী বললেন ‘স্যার ওর কথা বলবার মতো শক্তি নেই।’ টেড পকেট থেকে রুমালটা বের করে কপালটা মুছে নিলেন। ভিড় ঠেলে এগিয়ে গেলেন। সামনেই সেই পাইপের সারি। এখানেও আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থীরা। সেখানেও তিনি তাঁদের সঙ্গে করমর্দন করলেন। কথা বললেন।
সকলের সঙ্গে কথা বলেছেন
শ্রী কেনেডি রিপোর্টারদের কাছে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তাঁর ভারত পরিদর্শনের কথা বলে ফেলেন। দমদম বিমানঘাঁটিতে ঠাসা সাংবাদিক বৈঠক। মাইকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তিনি দেখছেন ঘরের চারদিকে আলোয় আলোময়। সবার দৃষ্টি তাঁর দিকে নিবন্ধ। টেলিভিশন টিম থেকে শুরু করে ফটোগ্রাফার পর্যন্ত। খুব আস্তে অথচ দৃঢ়তার সঙ্গে তিনি বললেন, ভারতে ৭৫ লক্ষ উদ্বাস্তুর অসহায় হতাশা ও দুঃখের বোঝা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রদূর করতে চেষ্টা করবে।…
লবণূহ্রদ থেকে শুরু করে বয়ড়া সীমান্ত-কেনেডি এ দিন যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই হাজার হাজার শরণার্থী ‘কেনেডি জিন্দবাদ’ শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, জয় বাংলা’ ধ্বনি দেন। বয়ড়া যাবার সময় দেখলাম রাস্তায় দু ধারে বহু মহিলা। তাঁদের হাতে নানান ধরনের প্লাকার্ড। তাতে লেখা “ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশ থেকে হঠাও-এক সপ্তাহের মধ্যে আমরা ফিরে যাব নিজের দেশে।’
সেনেটর কেনেডি সারা রাস্তায় এত লোক দেখে অভিভূত হয়ে পড়েন৷ প্লাকারডে কী লেখা সে সম্পর্কে তিনি তাঁর সঙ্গীদের কাছে খোঁজখবরও নেন। মাঝে মাঝে জল, বৃষ্টি। জামা কাপড় ভিজে চুপচুপ। কিন্তু তা সত্ত্বেও সেনেটরের কাজে তাতে কোন বাধা পড়েনি।
কপোতাক্ষ নদীর পারে একের পর এক নৌকো ভিড়তে দেখে সেনেটর কেনেডি ওদিকে এগিয়ে গেলেন। তখন বৃষ্টি সবে থেমেছে। আকাশ পরিষ্কার। পশ্চিম দিকে রোদ। নৌকো থেকে জনৈকা মহিলা নামলেন। কেনেডি বললেন, আপনার বাড়ি কোথায়? কিভাবে এলেন? এবং কেনই বা এলেন? দোভাষী বাংলা বুঝিয়ে বলার পর মহিলাটি বললেন, আমার নাম সন্ধ্যারানী পাল। সন্ধ্যারানীর কোলে চার মাসের একটি শিশু। খিদেয় ছটফট করছে। তাঁর পাশেই আরও তিনটে ছেলে। পরনে তাদের কোন বস্ত্র নেই।
সন্ধ্যারানী কেনেডির দিকে ফিরে বললেন, ‘স্যার, আমার স্বামী ব্যবসা করতেন। তাঁকে মিলিটারি মাইরা ফেলছে।’ কেনেডি: ‘এই কারণেই কি চলে এসেছেন?’
সন্ধ্যারানী: ‘মানুষজন নাই। চারিদিকে মিলিটারির অত্যাচার। চৈত্র মাস থিকা এই গোলমাল শুরু হইছে। আর থাকতে পারলাম না স্যার। সন্ধ্যারানী বললেন, আমার এই বাচ্চাদের কি হবে বলতে পারেন?’
ওই সময় শ্রী কেনেডি ২৪ পরগণার অতিরিক্ত জেলা শাসকের কাছে জানাতে চান যে, এই সব শরণার্থী আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁদের নামধাম কোথায় রেজিস্ট্রি করা হচ্ছে। এ সম্পর্কে অতিরিক্ত জেলা শাসকের জবাব সম্ভবত শ্রী কেনেডিকে খুশি করতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘এইখানেই তো এই রেজিস্ট্রির কাজ করা উচিত।’
বনগাঁ হাসপাতালে গিয়েও শ্রী কেনেডি আহত শরণার্থীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। ফরিদপুরের শ্রীমতী সুমতি দের দেহে বুলেটের আঘাত দেখে তিনি খুবই মর্মাহত হয়ে পড়েন। সবকিছু তিনি তাঁর কাছ থেকে জেনে নেন। পাক মিলিটারির গুলিতেই সুমতি দে আহত হন।
শ্রী কেনেডির সঙ্গে এসেছেন শ্রী নেভিন এস সিক্রমস, ইনি খাদ্যপুষ্টি সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কমিশনের ভারত সম্পর্কিত শাখার প্রাক্তন ডিরেকটর শ্রী জন পি লুইস।
আজ, বুধবার শ্রী কেনেডি আরও কয়েকটি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করবেন। তবে উত্তরবঙ্গে ইসলামপুরে যাবার তাঁর যে কর্মসূচী ছিল, তা বাতিল করা হয়েছে।
বয়ড়া সীমান্ত ১০ জুলাই-সেনেটর কেনেডি বাংলাদেশের দুজন তরুণ বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে সম্ভবত আজ বুধবার কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে আলোচনা করবেন। তাঁদের কাছ থেকে জেনে নেবেন ঢাকায় এবং বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গার পাক মিলিটারির অত্যাচারে কত তরুণ এপার বাংলায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
এদিন কোন একটি শরণার্থী শিবিরে গেলে বাংলাদেশের শেখ মুজিবর রহমানের প্রেস সেক্রেটারি শ্রী আমিনুল হক বাদশা এবং তরুণ ব্যারিস্টার শ্রী মওদুদ সেনেটর কেনেডিকে বলেন, স্যার আপনি আমাদের দশ মিনিট সময় দিন। আমরা আপনাকে বাংলাদেশে পাক মিলিটারি কি অত্যাচার করেছে সে সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল করাতে চাই।
আমাদের মতো হাজার তরুণ ব্যবহারজীবী, বুদ্ধিজীবী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।’
দৈনিক আনন্দবাজার, ১১ আগস্ট ‘৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন