You dont have javascript enabled! Please enable it!

বারাসাত হাসপাতালে

বারাসাত হাসপাতালে কেনেডির ঢোকার কয়েক মিনিট আগে অপুষ্টিজনিত রোগে খুলনা জেলার রামপালের শ্রীমতী প্রমীলা দেবীর শিশু পুত্রটি মারা গিয়েছে। মৃত শিশুটি কোলে নিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছেন। কয়েকদিন আগে এই হাসপাতালে প্রমীলা দেবী তাঁর স্বামীকেও হারিয়েছেন। মৃত শিশুটির গালে হাত দিয়ে কেনেডি কী যেন অনুভব করলেন। প্রমীলা দেবীকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। কেনেডির চোখ তখন ছলছল করছে। বেরিয়ে আসার সময় তাঁর মুখে শোনা গেল, “এরা ভাগ্যাহত, এরা ভাগ্যাহত।”

কল্যাণীর পথে
বারাসত ছেড়ে কল্যাণীর পথে রওনা হওয়ার মুখে বৃষ্টি শুরু হল। পথের মধ্যে একবার গাড়ি থামিয়ে রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে সেনেটর কৃষকদের চাষের কাজ দেখলেন। দোভাষীকে জিজ্ঞাসা করলেন, এখানে কী এইভাবেই চাষ হয়? কৃষ্ণনগর রোড ছেড়ে যখন তিনি কল্যাণীর রাস্তায় সেখানে শরণার্থীদের শিবিরে তখন জয় বাংলা ও জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা উড়ছিল। কয়েক হাজার লোক সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিচ্ছেন- শেখ মুজিবের মুক্তি চাই, কেনেডি জিন্দাবাদ, ইন্দিরা জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া নিপাত যাক, পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র বন্ধ কর, বন্দে মাতরম ইত্যাদি। জেলা শাসক তাঁকে একটি ছাতার তলায় নেওয়ার চেষ্টা করলেন। সেনেটর তা প্রত্যাখান করে এগিয়ে চললেন। তাঁবুর ভিতরে ঢুকে শরণার্থীদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমরা কী কী রেশন পাও।’ ওদের জবাব, “আমরা চাউল, ডাউল পাই। এখানে এক রকম ভালোই আছি। কারণ এখানে আমাগো কেউ মারছে না।” আর একটি শিবিরের সামনে গিয়ে তিনি কুষ্টিয়ার হাফিজ মিঞাকে জিজ্ঞেস করলেন- দেশে ফিরে যাবে? ওর জবাব, ‘সাহেব, জামু। কিন্তু দ্যাশ স্বাধীন হইলে। তার আগে তোমরা পশ্চিমাদের তাড়াইয়া দ্যাও।”
বৃষ্টি, বৃষ্টি আর বৃষ্টি। তার মাঝেই খালি মাথায় সেনেটর হেঁটে চলেছেন। কোথাও একহাঁটু জল আবার কোথাও তার বেশি। হঠাৎ একটি তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে জনৈক মহিলার বৃষ্টিতে রান্নার অসুবিধা হচ্ছে কি না, তা খোঁজ নিলেন। ওই মহিলা বললেন হ্যাঁ অসুবিধা হচ্ছে। কিন্তু এখানে ইজ্জত বেঁচে আছে।
কল্যাণী শিবির পরিক্রমার সময় জেলা শাসক তাঁকে খানা ডোবার পাশ কাটিয়ে যতবার নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন কেনেডি ততবারই নিজের ইচ্ছা মতো পথ নিয়েছেন। এক জায়গায় জলে ঢাকা ডোবার মধ্যে পড়েও গেলেন। যেতে যেতে সামনে যাকে পাচ্ছেন তাঁর সঙ্গেই কথা বলছেন। প্রায় ৭০ বছরের শ্রীমতী ঊষারানী মন্ডল (যশোরের) হাত জোড় করে অভিযোগ করলেন, তাঁর পরিবারের সব লোকদের খান সেনারা হত্যা করেছে। তাঁদের অপরাধ তাঁরা আওয়ামী লীগের সমর্থক। এই শিবিরে প্রায় শতাধিক নরনারীর সঙ্গে কথা বলে তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে তিনি গেলেন কল্যাণী হাসপাতালে। সেখানেও রোগীদের কাছ থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করলেন। সেখান থেকে যখন বেরিয়ে এলেন তখন ঘড়িতে সওয়া একটা। তখনও বৃষ্টি ঝরছে। রাস্তায় আসতে আসতে বাঁ দিকে আর একটি শিবির। গাড়ি চালককে নির্দেশ দিলেন গাড়ি থামাতে। নেমে পড়লেন। প্রায় ৩০০ গজ হেঁটে শিবিরে গিয়ে আবার সেই একই প্রশ্ন করলেন। এখানেও প্রায় মিনিট কুড়ি কাটিয়ে বেরিয়ে এলেন। এবার কলকাতায় ফেরার পালা।
দৈনিক আনন্দবাজার, ১২ আগস্ট ‘৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!