You dont have javascript enabled! Please enable it!

মালদা জেলা থেকে শরণার্থীরা ফিরছেন
(সেচ্ছাসেবক)

১০ জানুয়ারি, সোমবার থেকেই বুঝতে পারলাম এ অঞ্চলের শরণার্থীদের মধ্যে ঘরে ফেরার জন্য একটি ব্যাপক তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। ভোর থেকেই ‘জয় বাঙলা’, “ইন্দিরা গান্ধী জিন্দাবাদ’, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ইত্যাদি ধ্বনির মধ্যে দিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু হলো।
রাস্তায় বের হয়ে দেখলাম, এই আলো-অন্ধকারে, যাঁরা যা আছে তাই নিয়ে, প্রচণ্ড শীতকে উপেক্ষা করে শরণার্থীরা পথে বেরিয়েছেন ইসুজু ট্রাকে করে অনেকে যাচ্ছেন। আবার ট্রাকে যেতে বিলম্ব হবে ভেবে অনেকে হাঁটা পথেই স্টেশনে রওনা দিয়েছেন।
রামপুর ক্যাম্পে গিয়া দেখি, যাবার জন্য সবাই প্রস্তুত। হাঁড়ি, কড়া, কম্বল, মা পোর্টম্যান নিয়ে সবাই চেয়ে আছেন পথের দিকে। এক বৃদ্ধকে দেখলাম কাঁদছে। এক পাশে ডেকে জিজ্ঞাস করলাম, কী ব্যাপার, কাঁদছেন কেন? বৃদ্ধ বলল, “ব্লাড- প্রেসারের রুগী, দুঃখ কষ্টে প্রায় আট মাস এখানে ছিলাম। ওখানে নিজের ঘরদোর এখন আছে কি না জানি না। যাওয়া হবে শুনে তিন রাত ভিটে মাটিতে ফিরে যাওয়ার আনন্দে ঘুম হয়নি; কিন্তু আজ যাবার সময়ে কেন জানি না, আপনা থেকেই কান্না পাচ্ছে।” বৃদ্ধ আরো বলল, “বাবু, এদেশে এসে এতদিন খেতে পেলাম, থাকতে দিলেন, কম্বল, চাল-ডাল টাকা পয়সাও পেলাম, তাই বোধহয় চোখে জল আসছে।” শিবিরের আরো ভিতরে গিয়ে দেখলাম যাবার তোড়জোড়ের মধ্যেই চাল গম মাপা হচ্ছে। প্রশ্ন করে জানতে পারলাম অনেকেই মাপার সময়ে জমানো চাল- গম বিক্রি করে দিচ্ছে।
মালদা থেকে প্রথম পর্বে রাজশাহী জেলার শরণার্থীদের পৌঁছে দেবার জন্য বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মালদা, ভালুকা, শ্যামসী, হরিশচন্দ্রপুর, রেল স্টেশনে আশপাশের রেল স্টেশনে আশপাশের থেকে শরণার্থীদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
যাবার সময়ে প্রতিটি শরণার্থী পরিবারকে মাথাপিছু বড়দের ৩ টাকা ও ছোটদের দেড় টাকা দেওয়া হয়। একপক্ষ চাল-ডাল-মশলা ইত্যাদিও তাঁরা সাথে করে নিয়ে গেছেন। এ ছাড়াও কাপড় ইত্যাদিও তাঁদের রয়েছে।
হরিশচন্দ্রপুর স্টেশনে জন লোকে লোকারণ্য। শুধু মানুষ আর মানুষ মূখে “জয় বাঙলা” ধ্বনি। প্রত্যেকেই কিছু কিছু নতুন জিনিস কিনেছেন। এদেশের শিবির জীবনের হিসাবে। সবচেয়ে আশ্চর্য বড় বড় টিনের রংকরা নতুন বাক্স দেখে। জিজ্ঞেস করে জানলাম বাঙলাদেশে নিয়ে যাবার জন্য কাটিহার থেকে এগুলো কেনা হয়েছে। স্টেশনেই পরিচয় মাদার থানার গোপাল সাহা নগাঁ থানার গোবিন্দ সাহা, হাট থানার রমণীমোহন প্রভৃতির সঙ্গে। এরা কেই কাউকে চিনত না, কিন্তু গত আট মাস এক ছাউনি তলায় দুঃখ কষ্টে থেকে ওরা অনেক দিনের জানা আত্মীয়ের মতো হয়ে গেছে। ওরা তাই একই সঙ্গে যাবে।
মালদা জেলা থেকে প্রায় ১,৩০০০ শরণার্থী স্বদেশে গেছেন। এর মধ্যে বেশ কিছু নিজ প্রচেষ্টায় দেশে পৌঁছাতে পেরেছেন করেছেন। এ জেলায় মোট শরণার্থী ছিলেন কমবেশি ৪,০০,০০। ৪২টি শিবিরের মধ্যে ১৩টি ইতিমধ্যেই শরণার্থী সম্পূর্ণ খালি হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ শিবিরের সব শরণার্থীদের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে দেশে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়েছে।
সাপ্তাহিক সপ্তাহ, ২৮ জানুয়ারি ১৯৭২

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!