বাঙলাদেশ থেকে আগত লোকদের উদ্বাস্তু হিসাবে না দেখে মুক্তি-সংগ্রামী
হিসাবে ট্রেনিং দিতে হবে- কমিউনিস্ট পার্টির সংসদীয় প্রতিনিধিদল
(স্টাফ রিপোর্টার)
কলকাতা, ৮ মে- বাঙলাদেশ থেকে আগত লোকদের উদ্বাস্তু হিসাবে গণ্য না করে তাদের স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসাবে গণ্য করা উচিত এবং তাঁদের যথাযথ ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করা উচিত যাতে তাঁরা প্রত্যয় ভরে নিজেদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিতে পারেন।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সংসদীয় প্রতিনিধিদল ২৪ পরগণার বনগাঁ ও বসিরহাট মহকুমার সীমান্তবর্তী এলাকা সফর করে আজ সাংবাদিকদের কাছে একথা জানান।
তাঁরা বলেন যে, শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে দেবার যে প্রস্তাব রাজ্য সরকার করেছেন, তাতে সমস্যার সমাধান হবে না।
বাঙলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীরা এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আসেন নি, তাঁরা নিজেদের দেশে ফিরে যেতেই চান বলে নেতৃবর্গ জানান।
কমিউনিস্ট পার্টির জাতীয় পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পার্টির চারজন পার্লামেন্ট সদস্য সর্বশ্রী ড: রণেন সেন (পশ্চিমবঙ্গ), কে, বালঠণ্ডায়ুথন (তামিলনাড়), সরয়ু পাণ্ডে (উত্তর প্রদেশ), ও ভোগেন্দ্র ঝা (বিহার) দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ২৪ পরগনা জেলার বাসিরহাট ও বনগাঁ মহকুমার আগত শরণার্থীদের অবস্থা পরিদর্শন করে এসে সাংবাদিকদের কাছে উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
এক বিবৃতিতে তাঁরা জানান, বসিরহাট মহকুমার চণ্ডীপুর থেকে হাকিমপুর পর্যন্ত তাঁরা হাজার হাজার শরণার্থীরা মিছিল দেখেছেন। তাঁরা মাঠে, গাছতলায় রয়েছেন, অনেকে সীমান্তবর্তী মুসলিম পরিবারগুলিতে আশ্রয় নিয়েছেন। এঁদের জন্য সরকারের তরফ থেকে না আছে পরিবহন ব্যবস্থা, না হয়েছে সকলের আশ্রয়, খাদ্য, স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা, শরণার্থীদের অনেকের হাতে অর্থ নেই দোকানগুলিতেও যথেষ্ট পণ্য নেই। ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। বহু শরণার্থী স্থানীয় স্কুল কলেজ ও বিভিন্ন শিক্ষায়তনে আশ্রয় নিয়েছে এর ফলে যেমন গোবরগঙ্গা কলেজে এই মাসেই পরীক্ষা হবার কথা সেই পরীক্ষা কীভাবে নেওয়া হবে তা নিয়ে সমস্যা দেখা দিয়েছে। গোবরডাঙ্গা পৌরসভার পৌর চেয়ারম্যান তাঁদের জানিয়েছেন, ইতিমধ্যেই শরণার্থীদের মধ্যে অনেকের জলবসন্ত হয়েছে এবং তাঁদের কোনও চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই৷
মহকুমা শাসক ও দিশেহারা হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তিনি জানান যে, ইতিমধ্যেই সরকারী ভাবে রেজেস্ট্রী করা শরণার্থীর সংখ্যা লক্ষাধিক এবং আরো লক্ষাধিক শরণার্থী রয়েছেন রেজেস্ট্রীভুক্ত হবার আশায়। সীমান্তের ওপার থেকে আগত শরণার্থীদের কাছ থেকে জানা গেল কয়েক দিনের মধ্যেই খুলনা জেলার ৯৬টি গ্রাম থেকে শরণার্থীরা সীমান্ত অতিক্রম করছেন ইয়াহিয়া ফৌজের বর্বর অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচবার জন্য। তাঁদের সংখ্যা হবে প্রায় দু লক্ষ। কমিউনিস্ট পার্টির সংসদীয় প্রতিনিধি দল মনে করেন, রাজ্য সরকারের বর্তমান প্রশাসনিক কাঠামো বর্তমানের এই বিপুল সমস্যা মোকাবিলা করতে পারবে না, শুধুমাত্র শরণার্থীদের সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য আলাদা করে প্রশাসনিক সংগঠন গড়ে
তুলতে হবে। অন্যথায় এইসব জেলার স্বাভাবিক প্রশাসনিক কাজকর্মও অচল হয়ে পড়বে।
তাঁরা আরো জানান যে, ওপার বাঙলায় ইতিপূর্বে বিহার ও উত্তর প্রদেশ থেকে যাঁরা গিয়ে বসবাস করছিলেন পাকিস্তানী নাগরিক হিসাবে, তারাও অনেক এপারে চলে এসেছেন এবং তাঁরা তাদের পুরোনো এলাকায় অর্থাৎ বিহার ও উত্তর প্রদেশে ফিরে যেতে চান। মানসিকভাবে সমস্যাটিকে দেখে যাতে তাঁদের আদি বাসস্থানে ফিরে যাবার অনুমতি দেওয়া হয় সেজন্য তাঁর ভারত সরকারের কাছে সুপারিশ করবেন বলে জানান।
তাঁরা জানান, বাঙলাদেশ থেকে আগত লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা না করা হলে সমস্যা গুরুতর হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে ওপার বাঙলা থেকে যেসব নিঃস্ব ক্ষেত মজুর এসেছেন তাঁরা অনেক কম মজুরিতে তাদের শ্রম বিক্রী করতে প্রস্তুত। এর ফলে স্থানীয় লোকদের সঙ্গে শরণার্থীদের একটা সংঘাত দেখা দেবার আশঙ্কা রয়েছে।
এরই সঙ্গে সঙ্গে হাকিমপুর সীমান্তের ওপার থেকে পাকিস্তানী ফৌজের হামলা, গুলিবর্ষণ এবং এপারে তার প্রত্যুত্তর দেবার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা সীমান্তবর্তী ভারতীয়দের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করেছে এবং তাঁরাও অনেকে তাঁদের ঘরবাড়ি ছেড়ে সীমান্ত থেকে দূরে সরে যাবার কথা চিন্তা করছেন। পাকিস্তানী নৌবাহিনীর বর্বরতার বর্ণনা দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন, গত পরশু ওপার বাঙলা থেকে চারজন নারী যখন নৌকায় সোনাই নদী পার হয়ে আসছিলেন, সেই সময়ে ইয়াহিয়া ফৌজ জোর করে তাদের ধরে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে ক্ষেতের মধ্যে ফেলে রেখে যায়। এদের মধ্যে শাহজাহানের ২০ বছর বয়স্কা তরুণী স্ত্রী আসিরাণ বিবির সঙ্গে প্রতিনিধিদল দেখা করেন। পাক ফৌজ নিরীহ নিরস্ত্র অসামরিক নাগরিকদের উপর অত্যাচর ও আক্রমণ করার সময়ে কোনও ধর্মাধর্ম বিচার করছে না।
তবে, অতি সম্প্রতি পাক-সামরিক ঠগীবাহিনী হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালিয়ে তাদের তাড়াবার ব্যবস্থা অবলম্বন করেছে- যাতে তারা এপারে এসে তাদের দুর্দশার কথা বলে এবং পশ্চিমবাঙলায় একটা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দেয়।
তাঁরা জানান, বসিরহাট শহরের সরকারী শিবির গুলিতে কোনও আলোর ব্যবস্থা নেই। শরণার্থীরা -চালডাল ও জ্বালানী চান যাতে নিজেরাই রান্না করে খেতে পারেন; আর চান কিছু হাত খরচের পয়সা। শরণার্থীদের এই অনুরোধ সরকারের বিবেচনা করা উচিত বলে তাঁরা জানান।
তাঁরা বলেন যে, এই সমস্যার সমস্ত দায়িত্ব অবশ্যই কেন্দ্রকে গ্রহণ করতে হবে।
প্রতিনিধিদল রাজ্যের উপমূল্যমন্ত্রী শ্রীবিজয় সিং নাহারের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের সুপারিশ সমূহ জানিয়েছেন।
দৈনিক কালান্তর, ৯ মে ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন