You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.04 | প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি

বাঙলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের চাপ পশ্চিমবঙ্গের উপর দিন-দিন যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে এ রাজ্যের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে গোটা প্রশাসন যন্ত্রই ভেঙ্গে পড়বে আর তার পরিণাম হবে রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা। তাই রাজ্যের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে বাধ্য হয়েছেন যে, হয় কেন্দ্রীয় সরকার অবিলম্বে শরণার্থীদের পূর্ণ দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণ করে রাজ্য সরকারের কাঁধ থেকে এই দুর্বহ বোঝা নামিয়ে নিন, নতুবা রাজ্যের প্রশাসনভার কেন্দ্রের হাতে নিয়ে কোয়ালিশন সরকারকে এই দায় থেকে মুক্তি দিন।
বাঙলাদেশে অবাধ হত্যা ও সন্ত্রাস করে ভারতের কাঁধে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী চাপিয়ে দেয়া পাক জঙ্গীশাহীর একটা রাজনৈতিক চাল। সেই চাল যদি পশ্চিমবঙ্গে নাভিশ্বাস উপস্থিত হয় আর দিল্লীর ভাগা-বিধাতারা শুধু মৌখিক আশ্বাস ও নমঃ নমঃ করে যৎসামান্য সাহায্য পাঠিয়েই দায় সারেন এবং সমস্ত বোঝা পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়েই চাপিয়ে রাখেন তবে বলতে হয় এই জাতীয় সমস্যার জাতীয় দায়দায়িত্ব তাঁরা এড়িয়ে চলার চেষ্টায় আছেন। পশ্চিমবঙ্গে এমনিতেই জনচাপ বেশি এবং সমস্যা বিস্তর; তার উপরে যদি এই পর্বত প্রমাণ বোঝার চাপ এসে পড়ে তবে ঢাকী শুদ্ধঢাক বিসর্জন হতে বাধ্য। এ যাবত চল্লিশ লক্ষাধিক শরণার্থী একমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই এসে আশ্রয় নিয়েছে। আরো কত আসবে ঠিক নেই। কেবল এদের আহার্য যোগানই সমস্যা নয়, বড় সমস্যা স্থান সঙ্কুলান ও স্বাস্থ্যরক্ষা। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও শরণার্থীদের মধ্যে কলেরা মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে এবং সহস্রাধিক লোক মারাও গিয়েছে। এই মহামারী স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। বর্ষা এসে গেছে। তাই মাঠে মাঠে এবার জলকাদা হবে। এরই মধ্যে নিরাপদ স্থানের সন্ধানে শরণার্থীরা কলকাতার কেদি আসতে শুরু করেছে। পঞ্চাশের মন্বন্তরের দৃশ্য যদি আবার কলকাতার জনাকীর্ণ রাজপথে দেখা দেয় তবে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে।
গোড়া থেকেই প্রধানমন্ত্রী বলে আসছেন শরণার্থীদের রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত দায়দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে গোটা দায়টাই এসে চেপেছে পশ্চিমবঙ্গের ঘাড়ে। সপ্তাহ খানেক আগে রাজ্যের পুনর্বাসন মন্ত্রী বলেছেন যে, শরণার্থীদের জন্যে রাজ্য সরকারকে যেখানে তাবৎ ব্যয় করতে হয়েছে ৫০ কোটি টাকা সেখানে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে পাওয়া গেছে মাত্র ৪ কোটি টাকা। সমস্ত দায়িত্ব পালনের প্রতিশ্রুতির এই তো নমুনা। তারপর ৬ মাসের জন্যে শরণার্থীদের দরুণ আনুমানিক ব্যয় বাবদ রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ২০০ কোটি টাকা চান ; কিন্তু অর্থমন্ত্রী শ্রীচ্যবনের বাজেটে মাত্র ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। শরণার্থীর সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলে ২০০ কোটি টাকায়ও কুলোবে না। অথচ শ্রীচ্যবন সাহেব ৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেই খালাস। বাকী টাকা দেবে কোন গৌরি সেন? মনে হয় পশ্চিমবঙ্গই যেন এ সমস্যার জন্য দায়ী এবং তার ভিক্ষাপাত্রে যৎসামান্য দান করাই যথেষ্ট। আসলে সমস্যাটা যে যুদ্ধকালীন জরুরী অবস্থার পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে প্রধানমন্ত্রী হয়তো এখনো পর্যন্ত সে বিষয়ে সচেতন নন বা তিনি নিজে সচেতন থাকলেও তাঁর সহকর্মীবর্গীও দিল্লী প্রশাসন যন্ত্রকে তিনি এ ব্যাপারে সচেতন ও সক্রিয় করে তুলতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গ যে দুঃসহ তাপে দগ্ধ হচ্ছে নয়াদিল্লীর আরামপ্রদ খাস মহলে তার লেশমাত্রও গিয়ে পৌঁছায়নি বলেই মনে হয়।
যে সব সীমান্তবর্তী অঞ্চলে শরণার্থীদের স্থান দেওয়া হয়েছে সেগুলো লোকে লোকাকীর্ণ। স্থানীয় অধিবাসীদের উপরও তার ফলে নানাভাবে চাপ পড়ছে। এতে তাদের মনে ক্রমশঃ ক্ষোভ জমে ওঠা অস্বাভাবিক নয়। এ নিয়ে অশান্তি দেখা দিতে পারে। উস্কানি দেবার লোকের অভাব নেই। কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশ, সি পি এম নাকি ঘোলা জলে মৎস্য শিকারের তালে আছে এ ধরণের গণ্ডগোল বাঁধিয়ে রাজনীতিক মতলব হাসিল করতে চায়। ভীড়ের মধ্যে পাক গুপ্তচরদের ঢুকে পড়া সহজ। পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন যেখানে জটিল সেখানে এরূপ একটি অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি বেশিদিন চলতে দেয়া কোনক্রমেই সঙ্গত নয়। এর আসনি হতে পারে অতি দ্রুত শরণার্থীদের অন্য রাজ্য স্থানান্তরিত করা। অন্য কোনো রাজ্যই নাকি শরণার্থীদের স্থান দিতে অনিচ্ছুক। এটা কারোর ইচ্ছা অনিচ্ছার প্রশ্ন নয়। চাপ দিয়ে অন্যান্য রাজ্যকে সম্মত করবার দায়িত্ব কেন্দ্রের। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীরাম বলেছেন ৫০ হাজার শরণার্থীকে মানা শিবিরে পাঠানো হবে। তাতে আর কতটুকু আসান হবে? শরণার্থীদের চাপে রাজ্যের সঙ্কট বাড়তেই থাকবে।
শরণার্থীদের ফিরে যাবার মতো অনুকূল অবস্থা অদূর ভবিষ্যতে বাঙলাদেশে হবার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তা যাতে হতে পারে তার জন্যে ভারত সরকারও এ যাবত তেমন কোনো ব্যবস্থা অবলম্বন করেননি। সুতরাং মানবতার খাতিরে শরণার্থীদের ঠাঁই ভারতে দিতেই হবে। কিন্তু সারা ভারত যদি সে দায় বহনে এগিয়ে না আসে তবে পশ্চিমবঙ্গের একার পক্ষে এত বড়ো জনচাপ বহন করা অসম্ভব। রাজ্যের কোনো গঠনমূলক কাজে হাত দেয়া তো দূরের কথা, কারণ শরণার্থীদের চাপেই প্রশাসন ভেঙ্গে পড়বে। তার ফলে পশ্চিমবঙ্গে যদি কোনো গুরুতর রকমের রাজনীতিক সঙ্কট দেখা দেয় সে জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী হবে ইন্দিরার কেন্দ্রীয় সরকার। সময় থাকতে প্রধানমন্ত্রীর হুঁশিয়ার হয়া উচিত।
১৫১. মহামারী সৃষ্টি করতে
দৈনিক কালান্তর, ৪ জুন ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন