You dont have javascript enabled! Please enable it!

এপারের শরণার্থী শিবির হয়ে ওপারে কপোতাক্ষের তীরে
(বিশেষ প্রতিনিধি)

সীমান্তের ওপার থেকে দলে দলে শরণার্থী আসছেন, তাঁদের ত্রাণকার্যে সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে একাধিক শরণার্থী শিবির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই শিবিরগুলোর অবস্থা এবং আগত নরনারীর সুবিধা-অসুবিধা জানার জন্যই সেদিন ভোরে বনগাঁ রওনা হয়েছিলাম। সেদিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ২২ এপ্রিল। সীমান্তের ওপারে যাবার কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু ঘটনাচক্রে সীমান্ত ডিঙিয়ে মুক্তিফৌজের সহায়তায় দেখে এলাম ইয়াহিয়া বাহিনীর প্রতিহিংসা পরায়ণ মনোবৃত্তির সাম্প্রতিকতম সাক্ষ্য।
বনগাঁ স্টেশন থেকে ঘুরতে ঘুরতে সরকারি রিলিফ অফিসে পৌঁছে জানলাম বাস ধর্মঘটের দরুন বাস বন্ধ থাকলেও বনগাঁ থেকে ১৬ মাইল পূর্বে মামা— ভাগ্নে গ্রামের শরণার্থী শিবিরগামী একটি ট্রাক পাওয়া যেতে পারে। জানতে পেরেই স্থির করলাম, ঐ ট্রাকে চড়ে মামা ভাগ্নে গ্রামে পৌঁছতে হবে। তার আগে চটপট কিছু তথ্য জেনে নিলাম। এ পর্যন্ত বনগাঁ মহকুমা সংলগ্ন সীমান্তে আগত মোট ২২,০০০ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি সাহায্য বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কর্তৃক সংগঠিত চারটি শিবিরে। এর একটি হরিদাসপুর সীমান্তে, দুটি মামাভাগ্নে এবং একটি বাগদা গ্রামে। অফিসে উপস্থিত সরকারি কর্মচারীরা হিসেব করে বের করলেন গড়ে দেড় হাজার শরণার্থী এই সীমান্ত অঞ্চলে প্রত্যহ প্রবেশ করছেন।
রাস্তায় বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না। সিভিল ডিফেন্স সংস্থার ট্রাক অচিরে এসে গেল পেট্রোপোল থেকে। গন্তব্য স্থল: মামা ভাগ্নে গ্রামের শরণার্থী শিবির। উঠে পড়লাম ট্রাকে ঝটপট। ট্রাকের পেছনে কিছু চট পড়ে ছিল। সেগুলো বিছিয়ে তার উপর বসে পড়লাম ট্রাক ছেড়ে দিল।
আমার পাশে সাদা পাঞ্জাবি আর লাল লুঙ্গি পরিহিত একটি তরুণ বসেছিলেন। কচি মুখ, দাড়ি বা গোঁফের রেখা পর্যন্ত অনুপস্থিত। ওঁর সঙ্গে আলাপ করলাম। ওঁর নাম দিলীপ কুমার দাস, সবে কলেজে ঢুকেছেন, বাড়ি যশোর শহরেই। বাবা সরকারি কর্মচারী। বললেন- “হামলা শুরু হতেই চলে এসেছি। আছি পেট্রাপোল ক্যাম্পে। বাড়ির কাউকে পাইনি। তাই বয়রা যাচ্ছি দেখতে কাউকে পাই কিনা।” মা-বাবা আর দুই বোনকে কাছে পাবার প্রগাঢ় আকাঙ্ক্ষা ফুটে উঠল চোখ দুটিতে।
মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। চোখেমুখে জলো হাওয়ার বিস্রস্ত মাতামাতি। দুপাশের ধানক্ষেতে কচি ধানের চারাগুলো দুলছে। বহু ক্ষেতে চলছে পাট বোনার প্রস্তুতি। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে পৌঁছলাম মামাভাগ্নে দুই নম্বর শিবিরে।
ঘড়িতে বেলা সাড়ে বারোটা বাজে। গ্রামীণ রমণীরা তখন খাদ্যের সারিতে থালাবাসন হাতে ব্যগ্রচিত্তে দাঁড়িয়ে। অধিকাংশের পরনের বসন শতচ্ছিন্ন। অদূরেই ছাউনি। অর্থাৎ শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল। সেখানে গিয়ে মানিকদি গ্রামের আলতাব হোসেন আর বৈভবপুর গ্রামের শান্তিপদ খাঁর সঙ্গে পরিচিত হলাম। ওঁরা দুজনেই জানালেন— “যশোর শহর থেকে সাত মাইল উত্তরে কোন গাছের পাতা অবশিষ্ট নেই। গোলাগুলোতে সব ধ্বংস হয়ে গেছে।” ওঁদের কাছ থেকে শুনলাম, এখন খুব সম্প্রতি হিন্দুদের উপর নিপীড়নের মাত্রা মুসলমানদের চেয়ে বেড়েছে। যেমন হৈবতপুর গ্রামে যে সাতজনকে ইয়াহিয়া বাহিনী নৃশংসভাবে খুন করেছে এর মধ্যে পাঁচজনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁদের ছয় জনই হিন্দু। অর্থাৎ পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ এখন সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে বিপর্যস্ত করার চেষ্টা করছে। ওদের মদত যোগাতে পারে এপারের সাম্প্রদায়িক দলগুলো। তবে খড়কি গ্রামের মহম্মদ কেরামতুল্লাহ ঝিকরগাছার গণেশচন্দ্র দাস প্রত্যয়ের সঙ্গে বললেন- “জান থাকতে ঐ চক্রান্ত রুখবোই।”
***

শিবিরের ব্যবস্থাপক স্বামী বিজয়ানন্দকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, বয়রা যাওয়া যায় কী করে? বয়রাহলো মামাভাগ্নে থেকে পাঁচ মাইল দূরের সীমান্ত-সংলগ্ন গ্রাম। সেখানেই প্রথম এসে জড়ো হচ্ছেন দলে দলে শরণার্থী। স্বামীজী কী মনে করে সিভিল ডিফেন্সের একটি ট্রাকের ব্যবস্থা করে দিলেন।
বিশাল ট্রাক। দু পাশে চষা জমি। মাঝখানে পিচঢালা পাকা সড়ক। সেই সড়কের বুক চিরে হেলতে দুলতে ট্রাক বয়রায় পৌঁছল দেড়টা নাগাদ।
বয়রা গ্রাম ঘিরে বয়ে চলেছে কপোতাক্ষ। মাইকেলের জন্মভূমি সাগরদাঁড়ির সঙ্গে যে কপোতাক্ষ নদীর নাম একাত্ম হয়ে আছে। সেই শীর্ণকায়া কপোতাক্ষ ই সীমান্তরেখা। নৌকা বা গরুর গাড়িতে সর্বস্ব চাপিয়ে নদী পেরিয়ে এপারে এসে উঠছেন শত শত নরনারী।
বয়রা গ্রামে শরণার্থী শিবির তৈরি হয়েছে, খবর— এ পৌঁছে ছিল কোন সূত্ৰে। কিন্তু স্বচক্ষে দেখলাম, বয়রাতে আগত পরিবারদের থাকার কোনো ব্যবস্থা নেই। আশ্রয়স্থল বলতে কয়েকটি কাঁচা-পাকা বাড়ি, তার মধ্যে একটি ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। আরেকটি একতলা বাড়ি ছিল স্থানীয় ক্লাব উদয়ন সঙ্ঘের কার্যদপ্তর। এখন সেটি রূপান্তরিত হয়েছে প্রাথমিক শুশ্রূষা কেন্দ্রে।
ঐ প্রাথমিক শুশ্রূষা কেন্দ্রে অক্লান্তভাবে কাজ করছেন গুটিকয়েক তরুণ ডাক্তার। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওঁদের শুশ্রষা কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কলকাতার ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্প্রসারণ -পরিষদ’ উদ্যোগে। এতক্ষণ চোখে পড়েনি, এখন লক্ষ্য করলাম শুশ্রূষা কেন্দ্রের বাইরে দেওয়ালের উপর ঝুলছে একটি ব্যানার- নীল কাপড়ের উপর সাদা অক্ষরে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্প্রসারণ পরিষদ’ লেখা। ডাক্তাররা বললেন- “আমরা নীলরতন সরকার হাসপাতালে হাউস সার্জন। কিছুদিন আগে ‘দিদি’ (‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্প্রসারণ -পরিষদ’সাধারণ সম্পাদিকা শ্রীযুক্তা
মৈত্রেয়ী দেবী) আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখানে আসার প্রস্তাব দেন। আমরা তিনজন এখানে ১৩ তারিখ থেকে আছি।
ইতিমধ্যে এসে পৌঁছেছেন জনৈক যুদ্ধাহত যুবক। ১৯ বছরের আবদুল হামিদ। যশোহর থেকে চার মাইল পশ্চিমে অবস্থিত এড়েন্দা গ্রামের কৃষক। গতকাল (অর্থাৎ বুধবার ২১ এপ্রিল) সকাল ১১টার সময় জনা পঞ্চাশেক পাক সৈন্য ঐ গ্রামে প্রবেশ করে যথেষ্ঠ তাণ্ডব চালায়। আবদুলকে ওরা প্রথমে প্রচণ্ড প্রহার করে ওঁর উপর গুলি চালায়। দেহে গুলি লেগেছে তিন জায়গায় পিঠে, ঘাড়ে এবং মুখে। থুতনির পাশ দিয়ে গাল ভেদ করে একটি গুলি বেরিয়ে গেছে। মুখটা অস্বাভাবিক ফুলে গেছে। প্রাথমিক শুশ্রূষার পর ওঁকে কিছু পানীয় দেওয়া হলো। গিলতে পারলেন না। সমস্তটা বেরিয়ে এল।
এখন প্রয়োজন ওঁকে বনগাঁ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা। অথচ যানবাহন নেই। অগত্যা আমাদের ট্রাক ছেড়ে দিতে হলো ওঁদের জন্য। ডাক্তারত্রয় মিহির সরকার, সুভাষ ভট্টাচার্য ও বিমল দাস অনুযোগ করলেন- “এটাই বিপদ। প্রতিদিন একাধিক যুদ্ধাহত আসছেন এখানে। এমন কি চুয়াডাঙা থেকেও যুদ্ধাহত এসেছেন। অথচ ওঁদের নিকটবর্তী হাসপাতালে পাঠাবার জন্য কোন অ্যাম্বুলেন্স পর্যন্ত নেই। এতদিন বি এস এফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী)-এর ট্রাকে ওঁদের স্থানান্তরিত করা হচ্ছিল, গত দুদিন থেকে তা-ও বন্ধ। তো গতকালই ছয়টা ‘কেস’ এসে পড়ল। এখন শুধু প্রাইভেট গাড়ির উপর নির্ভর করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। দিন চারেক আগে আই এম এস (ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল এসোসিয়েশন) থেকে কয়েকজন এসেছিলেন। ওঁদের বার বার বললাম ঃ একটা অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিন। অথচ ওঁরা এখনও কোন ব্যবস্থা করলেন না।”
ডাক্তাররা আগত শরণার্থীদের প্রত্যেককে মহামারী প্রতিষেধক টীকা দিচ্ছেন। সেদিক থেকে চিকিৎসার কোন ত্রুটি নেই। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয়, গত দুদিন থেকে স্থানীয় এসডিও-র দৌলতে শরণার্থীদের অভুক্ত রাখা হচ্ছে। ডাক্তার বন্ধুদের কাছে সব জানতে পারলাম বেশ কিছুদিন থেকে স্থানীয় শ্রীগুরু সঙ্ঘের কর্মীরা শরণার্থীদের জন্য চিড়ে, গুড় এবং বেবিফুড দিচ্ছিলেন দুদিন হলো স্থানীয় এস ডি ও জানিয়েছেন, কোন বে- সরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ঐ খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করা চলবে না। অথচ সরকারের উদ্যোগেও খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নেই। ফলত, দূর-দূরান্তের গ্রাম থেকে পদব্রজে হেঁটে আসা অগণিত শরণার্থী অভুক্ত থাকছেন যতক্ষণ না পর্যন্ত তাঁরা পাঁচ মাইল দূরের মামা ভাগ্নে গ্রামে প্রবেশাধিকার লাভ করছেন।
নদীর ওপারে কাবিলপুর গ্রাম বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে। স্থির করলাম ওপারে যাব, শরণার্থীদের কাছ থেকে ওখানকার অবস্থা জানতে। … ওপারে গিয়ে জনৈক নেতৃস্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীর সঙ্গে দেখা। উনি বললেন- এ পথে গিয়ে কোন লাভ নেই। তার চেয়ে আপনারা বরং ওপারে মাসলিয়া গ্রামের ই পি আর ক্যাম্পে যান, ওঁরা সব খবরা খবর দিতে পারবেন। এই তো পরশু দিন চৌগাছা বাজার তছনছ করে হানাদাররা দোকানপাট জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে।
ওঁর কথামত আবার নৌকায় পার হলাম নদী। এবার বুঝলাম বয়রা গ্রামের তিনদিকে বাঙলাদেশ। একটি মাত্র পথ ভারতের সঙ্গে তার সম্পর্ক বজায় রেখেছে। …নদী পেরিয়ে চষা মাটির উপর দিয়ে পথ চলা। একটু পরেই ঢুকলাম লক্ষ্মীপুর গ্রামে। ভারত সীমান্তের শেষ গ্রাম। মাটির চালাঘরে-ঘরে পাটের গাদা। বুঝলাম পাট পাচার হচ্ছে বিপুল সংখ্যায়।
একটু পরেই পথের বাঁ পাশে অতিক্রম করলাম সীমান্তফলক। এবার আর পাকিস্তান নয়, এখন বাঙলাদেশ। কিছু দূরে যেতে জনৈক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে পরিচয় হলো। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিলেন। নদীর তীরে উঁচু ঢিবির উপর ট্রেঞ্চ খুঁড়ে শত্রুর জন্য অপেক্ষমান। হাতে রাইফেল। আমরা মাসলিয়া যেতে চাই শুনে সোৎসাহে বললেন, আমি নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের।
পথে যেতে যেতে হাজরাখানা গ্রামের তারাপদ মালের সঙ্গে পরিচয় হলো। ওঁরা দুজনেই জানালেন, গত রাত্রে (অর্থাৎ বুধবার, ২১ এপ্রিল) যশোর-বেনাপোল রোডে মুক্তিফৌজের সঙ্গে ইয়াহিয়া বাহিনীর প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর মুক্তিফৌজ হানাদারদের নাভারণ থেকে ঝিকরগাছা পর্যন্তহটিয়ে দিয়েছেন। দুজনের চোখে মুখেই উদ্ভাসিত উল্লাস।
মাসলিয়া গ্রামে পৌঁছতে পৌঁছতে চারটে গড়িয়ে গেল। আকাশ মেঘাক্রান্ত হতে শুরু করেছে। আমাদের ইচ্ছা, মাসলিয়া থেকে মাইল তিনেক দূরের চৌগাছা বাজারে গিয়ে ইয়াহিয়া বাহিনীর তাণ্ডবের সাক্ষ্য দেখে আসি।
মাসলিয়ার ই পি আর ক্যাম্পে উড়ছে ‘জয় বাঙলা’ রাষ্ট্রীয় পতাকা। ওখানে ক্যাম্প প্রধান জানালেন, মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চৌগাছায় পাক ফৌজ যথেচ্ছ ভাঙচুর করেছে, ব্যাঙ্ক লুট করেছে। আমরা চৌগাছা ঘুরে আসতে চাই শুনে উনি তক্ষুনি দুজন মুক্তিযোদ্ধাকে আমাদের সঙ্গ নিতে বললেন। ওঁরাই হবেন আমাদের পথপ্রদর্শক ও নিরাপত্তারক্ষী। ঘড়িতে চারটে বাজে শুনে ক্যাম্পে প্রধান বললেন, “সাড়ে ছয়টা সাতটার মধ্যে নিশ্চয়ই ফিরতে পারবেন।”
***

মুক্তিযোদ্ধারা পোশাক পরিবর্তন করে পরেছেন পুরোপুরি ‘সিভিল ড্রেস’। শার্ট আর লুঙ্গি। দুজনেই মুজাহিদ বাহিনীর সদস্য। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাক যুদ্ধের সময় ওঁরা উভয়েই বয়রা অঞ্চলে সৈন্যসংঘর্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। ওঁরা দাবি করলেন, সে সময় পাক ফৌজ লক্ষ্মীপুর গ্রাম দখল করেছিল। মাত্র সাড়ে পাঁচ বছরের ব্যবধান। এরই মধ্যে পরিস্থিতি কতদূর পাল্টে গেছে। ওঁদের কথাবার্তার ধরা পড়ল আমাদের প্রতি গভীর আন্তরিকতা। ওঁদের কথা শুনতে শুনতে নিজেদের খুব হীন মনে হলো।
আমরা হাঁটছি। হঠাৎ দেখি নদীর তীরে এসে একটি নৌকা ভিড়ল ৷ মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরা জানালেন পায়ে হেঁটে যেতে যতক্ষণ, নৌকা বেয়ে যেতেও একই সময় লাগবে। ওঁদের কথামত নৌকায় চড়ে বসলাম।
মুক্তিযোদ্ধাদের একজন ঋজু, দীর্ঘদেহী। উনি জানালেন, মঙ্গলবার দিন পাকি হানাদারেরা তিন ইঞ্চি মর্টার, তোপখানা (ছোট আকৃতির কামান) ও চীনা মেশিনগান নিয়ে চৌগাছা আক্রমণ করে। শুধু তাই নয়, ঐ মর্টার ও তোপখানা চৌগাছার পার্শ্ববর্তী গ্রামসমূহকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এদের মধ্যে ক্ষতির পরিমাণ সিংহঝুলি ও স্বরুপদাহে অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি “আর একটি জিনিস- যারা চৌগাছার পার্শ্ববর্তী গ্রাম দিঘলসিং, চানপুর, জগন্নাথপুর, সিংহঝুলি, কয়েরপাড়া, মাড়ুয়া, কদমতলা, স্বরূপদাহ, পাকনামনা, টেঙুরপু-থেকে ফিইর্যা আইছে। চাষ-আবাদ করতে হইবে তো।”
এক মাইল পথ এইভাবে নৌকায় চড়ে আসার পর আমরা সবাই অনুভব করলাম নৌকা যথেষ্ট জোরে যাচ্ছে না। এদিকে চৌগাছা পৌঁছতে হবে। দিনের আলো থাকতে থাকতে। নচেৎ ধ্বংসলীলার আলোকচিত্র তোলা যাবে না। তাই স্থির করলাম হেঁটেই যাওয়া যাক।
কিছুদুর হেঁটে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্দেশে একটু ছড়িয়ে পড়লাম। আর একটা বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে কতকগুলো কাঁঠাল গাছকে পিছনে ফেলে ধরলাম একটা ‘সর্ট কার্ট’ রাস্তা। তারপর একটা বাঁকের মুখে একটি কালভার্ট পার হয়েই প্রবেশ করলাম চৌগাছায়।
বাঁদিকে গোরস্থান। সামনে কয়েকজন বৃদ্ধ উদ্বিগ্নভাবে বসে আছেন। আমাদের প্রশ্ন করতেই মুক্তিযোদ্ধারা জানালেন- মাসলিয়া থেকে আসছি। একটু এগিয়ে ডান দিকে দেখা গেল জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাওয়া দুটি চালাঘর। ততক্ষণে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির মধ্যেই আমরা এগিয়ে চললাম।
আমরা সবাই ছড়িয়ে পড়েছি। কিছুদূর যেতেই পৌঁছলাম চৌগাছা বাজারে। ডান আর বাঁ পাশে দুটি বিরাট দালানবাড়ির ভগ্নস্তূপ। ভগ্নস্তূপের মধ্যভাগে তখনও কালো ধোঁয়া উঠছে। জ্বলন্ত পাটের সাক্ষ্য। যে দুজনের দালানবাড়ি হানাদাররা ভেঙে ফেলেছে, তাঁদের নাম এনামুল হক এবং আবদুল কাদের মিরধা। ওঁদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হল অচিরেই। ওঁরা দুজনেই পাটের ব্যবসায়ী। জানালেন- প্রায় এক হাজার মণ পাট জ্বালিয়ে ফেলা হয়েছে। “ওরা আমাদের পথের ভিখারী করতে চায়।”
আবদুল কাদের মিরধার পাট গুদামের ঠিক পাশেই মোমিনপুর ইন্ডাস্ট্রিয়াল- কো অপারেটিভ ইউনিয়ন লিমিটেড’-এর চৌগাছা ব্রাঞ্চের কাপড়ের দোকান। সেখান থেকে প্রায় হাজার তিরিশেক টাকার কাপড় লুট করেছে হানাদাররা।
চৌগাছা বাজারের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে যশোহর সৈন্য ছাউনি পর্যন্ত পাকা সড়ক। ঐ সড়ক ধরেই সেদিন সকাল ১১টায় হানাদাররা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চৌগাছায় এসে পড়ে। তারপর চালায় তাণ্ডব। ঐ সড়কের উপরে ছোট একটি হোটেল সম্পূর্ণ ভস্মীভূত করে। ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক অব পাকিস্তানের শাখাটি থেকে সমগ্র অর্থ লুট করে নিয়ে যায়। এমনকি একটি সরকারি দপ্তর, চৌগাছা সাব-রেজিস্ট্রি অফিস পর্যন্ত জ্বালিয়েছে। দুজনকে খুন করেছে। তারপর আড়াইটা নাগাদ তাণ্ডবলীলা সমাপ্ত করে ফিরে গেছে যশোহরের দিকে।
চৌগাছা বাজারে বসে কথা হলো স্থানীয় বৃদ্ধ হাজী রিয়াজুদ্দীনের সঙ্গে। ইয়াহিয়ার সৈন্যরা ওঁর যুবতী কন্যার দিকে শ্যেনদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ওকে ‘চেয়েছিল’। হাজী সাহেব মোটা অর্থ ও একটি আস্ত মোটর সাইকেলের বিনিময়ে কন্যার সম্মান রক্ষা করেছেন।
হাজী সাহেবের বেকারির ব্যবসা। অবস্থাপন্ন লোক। বললেন- হানাদাররা এসে প্রথমে ই পি আর, মোজাহিদ ও হিন্দুদের খুঁজেছে। তারপর অন্যদের উপর আক্রমণ করেছে। সিংহঝুলি গ্রামে একই সময়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরূপে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত জনাব মুশিয়ুর সাহেবকে ধরে নিয়ে যায়।
হাজী সাহেব জানালেন- প্রথমে বিভিন্ন বাড়ির উপর পেট্রল ছড়িয়ে তারপর আগুন লাগানো হয়। এইভাবে ইসমাইল হোসেন বিশ্বাস, রহিম বক্স বিশ্বাস ও আবদুল হাজী তরফদারের বাড়িগুলো পুড়িয়েছে।…হাজী সাহেবকে প্রশ্ন করলাম- “এইভাবে এসে ধ্বংস করে ওরা ফিরে গেল কেন? কেন এই অঞ্চল দখলে রাখল না?” হাজী সাহেব উত্তর দিলেন- “যশোহর মহকুমার বিশিষ্ট বাজার চৌগাছা। এখানে প্রকাশ্য দিবালোকে ৬৪টি গাড়ি করে ৩০০ জন পাক সৈন্য এসে বাড়িঘর লুট করল, দোকান-পাট এবং ‘পাট’ পোড়াল— এ সবকিছু মানুষকে সন্ত্রস্ত করার জন্য— কিন্তু দখল রাখা অন্য ব্যাপার। প্রশ্ন হলো- কে কাকে দখলে রাখবে?”
***
এবার অভিবাদন জানিয়ে ফেরার পালা। ঘাটে নদী পার হলাম নৌকায়। ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে। পশ্চিমাকাশে গোধূলির ফাগ।
মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুটির পাশে গা ঘেঁসে হাঁটছি। বললেন- “আপনারা তো চলে যাবেন। আমাদের আজ রাত্রে আবার আসতে হবে এ পথে। ডিউটির জন্য। কালো ঘন রাত্রিতে যদি বৃষ্টি পড়ে তো আরও ভালো।” একটু থেকে আবার বললেন- “ওদের চার ডিভিশন সৈন্য- আধুনিক অস্ত্র নিয়ে তৈয়ার। আর আমাদের সারা বাঙলাদেশে ই পি আর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, মুজাহিদ মিলিয়ে এক ডিভিশন।…তাও তেমন অস্ত্র নেই। তবে কি জানেন, যুদ্ধে জেতার জন্য সবচেয়ে আগে চাই বুদ্ধি। সেটা আমাদের আছে, ওদের নেই। দেখেন না, দু-চারদিনের মধ্যেই গেরিলা লড়াই শুরু হইব। এ যুদ্ধ যে জিততে হবেই।” ঘনায়মান অন্ধকারে স্পষ্ট দেখলাম ওঁর চোখ দুটি জ্বলে উঠল মুহূর্তের জন্য।
সাপ্তাহিক সপ্তাহ, ০৭ মে ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!