বনগাঁ সীমান্তের বয়রা গ্রামে
আগত শরণার্থী ও যুদ্ধাহতদের প্রতি সরকারী ঔদাসীন্য
বয়রা গ্রাম (বনগাঁ-যশোহর সীমান্ত), ২৪ এপ্রিল-বনগাঁ শহর থেকে ২০ মাইল দূরের এই বয়রা গ্রামে প্রতিদিন সীমান্ত পেরিয়ে ৫০০ জন শরণার্থী এসে পৌঁছেছেন। সীমান্তবয়রা গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা কপোতাক্ষ নদী। নৌকা বা গরুর গাড়িতে সর্বস্ব চাপিয়ে দলে দলে নরনারী শীর্ণকায়া কপোতাক্ষ পার হয়ে বয়রায় এসে জড়ো হচ্ছেন।
নদীর ঘাটের ঠিক সামনেই স্থানীয় ক্লাব উদয়ন সঙ্ঘের কার্যদপ্তর। এখানে এখন শরণারীদের চিকিৎসা কেন্দ্র। প্রতিটি শরণার্থীকে মহামারী প্রতিষেধক টীকা দেওয়া হচ্ছে। আর যুদ্ধাহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা ও শুশ্রূষাও করা হচ্ছে।
যাঁরা এই কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন তাঁরা সকলেই নীল রতন সরকারী হাসপাতালের ডাক্তার। যে সংগঠন তাঁদের এই কাজের পরিচালনা করছে তার নাম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্প্রসারণ সমিতি, যার সম্পাদিকা শ্রীযুক্ত মৈত্রেয়ী দেবী। আর পূর্ণোদ্যমে সহায়তা করছেন উদয়ন সঙ্ঘের কর্মীবৃন্দ। প্রচুর ঔষধপত্রে, ডাক্তারী সরঞ্জামে চিকিৎসা কেন্দ্রটি সুসজ্জিত।
এ্যাম্বুলেন্স নেই
ডাক্তার এরা মিহির সরকার, সুভাষ ভট্টাচার্য ও বিমল দাস এখানে দিবারাত্রি দুর্গতদের শুশ্রুষা করছেন। তাঁরা বললেন, প্রত্যহ বুলেট বিদ্ধ বহু আহত বয়রায় এসে পৌঁছাচ্ছে। এমনকি সেদিন চুয়াডাঙ্গা থেকেও একটি বুলেট বৃদ্ধ ‘কেস’ এসে পৌঁছেছিল। গতকাল তো ছয়টা অনুরূপ কেস এসেছে। অথচ এদের বনগাঁ হাসপাতালে পৌঁছে দেবার কোন যানবাহন নেই। এ্যাম্বুলেন্স নেই একটাও। নির্ভর করতে হচ্ছে কেবল প্রাইভেট গাড়িগুলির উপর। মাঝে বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্স (বি- এস-এফ) এ ট্রাকে করে ওঁদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল এখন তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
ওদের সমস্যাটা গুরুতর অনুধাবন করলাম। সরকারী কর্তৃপক্ষের ঔদাসীন্য এ ব্যাপারে খুব একটা প্রকট। কিন্তু বেসরকারী চিকিৎসা সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্প্রসারণ সমিতিকে সাহায্য করা হয় নি। ডাক্তারদের ভাষাতেই শুনুন। “আই এম এ-র কিছু লোক কয়েকদিন আগে এসেছিলেন। তাঁদের সবকিছু জানিয়েছি। কিন্তু এখনও ওরা কিছু করলেন না। অন্ততঃ একটা এ্যাম্বুলেন্স তো জোগাড় করে দিতে পারতেন।”
ডাক্তারদের ভাষাতেই শুনুন। “আই, এম, এ-র কিছু লোক কয়েকদিন আগে এসেছিলেন। তাঁদের সবকিছু জানিয়েছি। কিন্তু এখনও ওরা কিছু করলেন না। অন্ততঃ একটা এ্যাম্বুলেন্স তো জোগাড় করে দিতে পারতেন।”
এস, ডি, ওর হৃদয়হীন আচরণ
এ সব কিছু ছাপিয়ে গেছে স্থানীয় এস, ডি,ও-র হৃদয়হীন আচরণে। যাঁরা নদী পার হয়ে সপরিবারের সর্বস্ব নিয়ে আসছেন তাঁদের জন্য স্থানীয় শ্রীগুরু সঙ্ঘ চিড়ে, গুড় ও কিছু বেবি ফুড সরবরাহ করছিল। অকস্মাৎ গত মঙ্গলবার, ২০ এপ্রিল থেকে স্থানীয় এস, ডি, ও নির্দেশ দিয়েছেন- বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান এভাবে খাদ্য সরবরাহ করতে পারবে না। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে বয়রায় কোন খাদ্য সরবারের পরিকল্পনা তো দূরের কথা, খাদ্য শিবির তৈরির প্রকল্প ও নেই। ফলতঃ বয়রায় যাঁরা এসে পৌঁছাচ্ছেন তাঁদের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও বস্তুত অভুক্ত থাকতে হচ্ছে (এস.ডি-ও র নির্দেশের পটভূমিকায়) যত বর্ণনা তাঁরা পাঁচ মাইল দূরে মামা ভাগ্নে গ্রামের শরণার্থী শিবিরে মা পৌঁছেচ্ছেন।
এস ডি-ওর নির্দেশ অমান্য করে উদয়ন সঙ্ঘের কর্মীরা অবশ্য কিছু বিস্তৃত শরণার্থীদের মধ্যে সরবরাহ করছেন, যেহেতু তাঁদের বিবেক বোধ আছে।
এ বারিপাতের সময় রেহাই পাবার উপায় নেই। উদয়ন সঙ্ঘের কার্যদপ্তর বা স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবাল- বৃদ্ধ বর্ণিত কোনক্রমে মাথা গোঁজার ঠাই খুঁজছেন। কিন্তু অত লোকের আশ্রয় মেলা ভার। অনেকেই প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে চুপসে যাচ্ছেন।
ডাক্তাররা বললেন, আধা-স্থায়ী কোন ‘শেড’ নির্মাণ করা একান্ত প্ৰয়োজন। কিন্তু এস্, ডি, ও এ ব্যাপারে একেবারেই উৎসাহী নন।
বনগাঁ মহকুমা বেষ্টিত সীমান্তের শিবিরগুলিতে ২,০০০ শরণার্থী
বনগাঁ মহকুমা বেষ্টিত সীমান্তে চারটি শরণার্থী শিবির তৈরি হয়েছে (হরিদাসপুরে একটি, মামা-ভাগ্নে গ্রামে দুটি এবং বাগদায় একটি)। এর মধ্যে মামা-ভাগ্নে নম্বর ৭ নম্বর ক্যাম্পট্রিতে ৫, ৫ এবং সব মিলিয়ে মোট ২২,০০০ শরণার্থী এসে পৌঁছেছেন। এই শিবিরগুলিতে প্রচুর অব্যবস্থা তবে মামা ভাগ্নে শিবিরে ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত- ভাল অর্থাৎ যথা সময়ে খাদ্য সরবরাহ এবং আবর্জনা দূরীকরণ হচ্ছে। কিন্তু বাগদায় অবস্থা শোচনীয়। এবং বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য কোথাও কোন স্থায়ী ‘শেড’ নেই৷
ভারত সরকার এই শরণার্থীদের এখনও পুরোদস্ত উদ্বাস্তুরূপে গণ্য করছেন না। কারণ, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের উদ্বাস্তু জনিত সুযোগ-সুবিধাসমূহ দিতে হবে। তবে ত্রাণকার্যে নিযুক্ত বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃবর্গের মতে, কেবলমাত্র মানবিকতার স্বার্থে সরকারের উচিত শরণার্থীদের জন্য অধিকতর দায়িত্ব গ্রহণ।
সাম্প্রদায়িকতা রুখবোই!
একটা জিনিস চোখে পড়ল। আগে যেমন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই সীমান্ত পেরিয়ে চলে আসছিলেন, সপ্তাহ খানেক ধরে কিন্তু হিন্দু শরণার্থীদের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ওপারে হিন্দুদের বিচ্ছিন্ন করে অত্যাচার চালানো হচ্ছে খুব সম্প্রতি। অর্থাৎ ইয়াহিয়া মুসলিম লীগ ও জামাত-ই-ইসলামীর সহায়তায় এই লড়াইকে সম্প্রদায়িকতার চোরাপথে টেনে নিয়ে যেতে চায়, যাতে তার প্রতিফলনে ভারতেও অনুরূপ সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিতে পারে।
মামা-ভাগ্নে শিবিরে একথা শুনতে শুনতে দুজন প্রাথমিক শিক্ষক খড়কি গ্রামের মহম্মদ কেরামতুম আর ঝিকরগাছার গণেশচন্দ্র দাসকে প্রশ্ন করলাম : “ইয়াহিয়ার ঐ পরিকল্পনা সফল হবে?” তাঁরা উভয়েই জানলেন, “কখনই নয়।” জান থাকতে বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে ঐ চক্রান্ত রুখবোই।” সব মিলিয়ে মোট ২২,০০০ শরণার্থী এসে পৌঁছেচ্ছেন। এই শিবিরগুলিতে প্রচুর অব্যবস্থা তবে মামা- ভাগ্নে শিবিরে ব্যবস্থা অপেক্ষাকৃত ভাল ভাল অর্থাৎ যথাসময়ে খাদ্য সরবরাহ এবং আবর্জনা দূরীকরণ হচ্ছে। কিন্তু বাগদায় অবস্থা শোচনীয়। এবং বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য কোথাও কোনা স্থায়ী ‘শেড’ নেই।
ভারত সরকার এই শরণার্থীদের এখনও পুরোদস্তুরূপে গণ্য করছেন না। কারণ তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে তাঁদের উদ্বাস্তুজনিত সুযোগ-সুবিধাসমূহ দিতে হবে। তবে ত্রাণকার্যে নিযুক্ত বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নেতৃবর্গের মতে, কেবলমাত্র মানবিকতার সাথে সরকারের উচিত শরণার্থীদেরজন্য অধিকতর দায়িত্ব গ্ৰহণ ৷
দৈনিক কালান্তর, ২৫ এপ্রিল ১৯৭১
সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন