You dont have javascript enabled! Please enable it!

ঝালকাঠি না ‘মাইলাই’

ঝালকাঠী অঞ্চলে পাক বাহিনীর বর্বরোচিত হামলা অত্যন্ত ভয়াবহ ও বেদনাদায়ক। নরখাদক পাক বর্বর বাহিনী বাংলা দেশের অন্যতম বাণিজ্য কেন্দ্র ঝালকাঠী বন্দরটি সম্পূর্ণরূপে লুণ্ঠন করেছে, জ্বালিয়ে দিয়েছে শহরের ৯০ ভাগ বাড়ীঘর- সম্পূর্ণ ফরিয়াপট্টি আরৎদারপিট্টি, মনোহারীপট্টির বড় বড় গুদামগুলি মর্টারের সেলের আঘাতে উড়িয়ে দিয়েছে, শহরের বড় মসজিদের মিনার- ধ্বংস করেছে কালীবাড়ী। সম্পূর্ণরূপে ধ্বংশ করে দিয়েছে কৃষি সম্পদে ভরপুর আটগর, কুরিয়ানা, সতাদশকাঠী, রুলা,ভীম খাজুরা, কৃত্তিপাশা, ঝাউকাঠী প্রভৃতি অঞ্চলগুলি। এইসব অঞ্চলের গইয়া, আখ্য। তরিতরকারী শুধু ঝালকাঠী বরিশালের প্রয়োজন মিটাত না প্রত্যহ কয়েকটি লঞ্চ বোঝাই দিয়া বাংলাদেশে অন্যান্য কেন্দ্রে বিশেষ করে ঢাকায় সরবরাহ করা হত। মেসিনগান ও রাইফেলের গুলিতে হাজার হাজার মানুষ এ অঞ্চলে হত্যা করেই নরখাদকেরা খান্ত হয় নাই, কুঠার ও রামদা দিয়ে কাঠ ফারার মত ফেরেছে হাত পা কেটে দিয়েছে, মাথা কেটে জবাই করেছে শত শত নিরাপরাধী যুবক শিশুকে। ইজ্জতহানি করেছে ধরে নিয়ে গেছে শত শত কুলবধু ও যুবতী মেয়েদের।
২৭ শে এপ্রিল ঝালকাঠীর প্রত্যেকটি মানুষের কাছে বিভীষিকাময় হয়ে থাকবে চিরদিন। এই দিনের ধ্বংশলীলা এ অঞ্চলের অধিবাসীরা কখনও ভুলিবে না৷ নরখাদক পাক সেনাবাহিনী কখন আসে এই ভীতির মধ্যে কয়েকদিন হতে সমস্ত অঞ্চলের মানুষকে কাটাতে হয়েছে। শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ। অনেকেই শহর ছেড়ে পাশ্ববর্তি অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে। ২৭শে এপ্রিল সন্ধ্যায় সকলেই শংকিত মনে ঘরে ফিরছে, এমন সময় ভারী মর্টারের শব্দ শোনা গেল। পাক সেনারা গানবোট থেকে মর্টারের সেল বর্ষণ করতে করতে ঝালকাঠী নদীতে প্রবেশ করেছে। শংকিত, ভীত মনে প্রত্যেকটি স্ত্রী, পুরুষ, শিশু ঘর থেকে বেড়িয়ে পরে অবস্থা লক্ষ্য করতে থাকে। সন্ধ্যা গাঢ় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনী তিনদিক দিয়ে শহরে প্রবেশ করে এবং চার-পাঁচ দলে বিভক্ত হয়ে শহরে ছড়িয়ে পরে। বিকট শব্দে বোম ফাটাতে থাকে। প্রত্যেকটি ঘরের তালা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে মূল্যবান মালপত্র লুট করে আগুন লাগিয়ে দেয়। একমাত্র লালকাঠী নদীর পার্শ্বস্থ কিছু বাড়ীঘর তারা ধ্বংশ করে না। যাহাতে নদীপথে যাতায়াতে ধ্বংস প্রাপ্ত স্থান চোখে না পড়ে অবশিষ্ট সমস্ত শহরে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। রাত্র যতই বেশী হতে থাকে আগুনের লেলিহান শিখা ততই তীব্র হতে থাকে। শহরের চতুর্দিকের প্রায় ১৫/২০ মাইল স্থান সম্পূর্ণরূপে দিনের মত আলোকিত হয়ে যায়। ৫০/৬০ মাইল দূর থেকে অনেকে সমস্ত রাত আগুনের লেলিহান শিখা প্রত্যক্ষ করে। মাঝে মাঝে কেরোসিনের পিপা, টিন ফাটার শব্দ, ঘরের চালের টিন ছোটার শব্দ, মানুষের বিকট চিৎকার, মর্টার মেসিনগান, রাইফেলের শব্দ, আতঙ্কগ্রস্থ মানুষকে আরও আতঙ্কিত করে তোলে।
সমস্ত রাত ধরে শিশু, যুবক, স্ত্রী পুরুষ সকলেই যার যার সামর্থ অনুযায়ী বোঝা মাথায় রেখে যতদূর পারে ছুটাছুটি করতে থাকে। প্রায় ৮ ঘণ্টা পর্যন্ত শহরে আগুন জ্বলেছে। ২৮ শে ভোরে গানবোট বোঝাই দিয়ে মাল নিয়ে পাক সেনারা চলে যায়। ৩রা মে ২৫০ জন পাক বর্বরবাহিনী ঝালকাঠী শহরে স্থায়ী ঘাটি করে এবং প্রত্যহ ঝালকাঠীর বিভিন্ন অঞ্চলে ধ্বংশলীলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়স্থল ২৩টি গ্রাম নিয়ে গঠিত মুক্তাঞ্চল কয়েক দিন আগে কয়েক হাজার পাক সেনা রাজাকার সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই অঞ্চলের ৯০ ভাগ ঘরবাড়ী জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। শত শত স্ত্রী-পুরুষ শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বিরাট বিরাট পেয়ারা বাগান কেটে ফেলা হয়েছে। ৭ দিন পৰ্য্যন্ত মুক্তাঞ্চলের চারপাশে কারফিউ জারী করে ১০ খানা বড় লঞ্চ ও গানবোট দিয়া পাহারা দেওয়া হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে বাইরের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ এই মুক্তাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিল। বহু লোক রাতে নিরূপায় হয়ে নদীতে সাঁতার দিয়ে পালাতে গিয়ে ডুবে মরে। শত শত বীভৎস চেহারা মানুষের মৃতদেহ সমস্ত অঞ্চলের বাতাস পানি অনেকদিন হতে দূষিত করে রেখেছে। দূষিত পানি অস্থাস্থ্যকর পরিবেশ, ইনজেকশসন, টিকার অভাবে কলেরায় বহু লোক মারা গিয়েছে।
বাংলা দেশের স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলনে ঝালকাঠি সবসময় বিশিষ্ট ভুমিকা গ্রহণ করেছে। এই বৎসরের বাঁচার দাবী আদায় তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং হানাদার শত্রু বিতাড়নে ঝালকাঠির সংগ্রামী জনতা প্রাণপণ রক্তাক্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মত মুক্তিবাহিনী গঠন করে ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। প্রায় ২০০ শত মুক্তি যোদ্ধাকে ট্রেনিং ক্যাম্প করে রুটিন করে নিয়মিত ট্রেনিং দেওয়া হয়। কিন্তু বিভিন্ন প্রকার অস্ত্রের অভাব অনেক অসুবিধার সৃষ্টি করে। ২৪শে এপ্রিল মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প কীর্তিপাশা সরিয়ে নেওয়া হয়। ৩রা এপ্রিল ১৫০ শত পাক হানাদার বাহিনী ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কীর্তিপাশা আক্রমণ করে, আমাদের মুক্তিবাহিনীর কাছে তখন মাত্র ৩৫টি রাইফেল ছিল। অসুবিধা দেখে ক্যাম্প ভীমরুলা নিয়ে যাওয়া হয়। ৩রা এপ্রিলের তীব্র আক্রমণে মুক্তি বাহিনীর লোকজন বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বহু কষ্টে আবার বাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিবাহিনী ১৩ গ্রামকে নিয়ে মুক্ত অঞ্চল ঘোষণা করে তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। গ্রামে গ্রামে গ্রামরক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়। আস্তে আস্তে মুক্ত অঞ্চল বাড়িয়ে ২৩টি গ্রাম মুক্ত অঞ্চল করা হয়। বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক গোপন অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। ২ মাসে ১২৫ জন জাতীয় শত্রু খতম করা হয়। তাদের মধ্যে ঝালকাঠির মোসলেম লীগ দালাল আদম আলী, রুস্তুম আলি, গাবখানের প্রাক্তন চেয়ারম্যান পান্না মিঞা, মেম্বর রত্তন মিঞা, লুঠ করার অপরাধে রত্তন খাঁ, আঃ মজিদ, আঃ খালেককে হত্যা করা হয়। কুখ্যাত ডাকাত মৌজে আলী ফজলুকে হত্যা করা হয়। দালাল নূর মৌলভী কাঞ্চন খাঁকে হত্যা করা হয়। বিগত মে মাসের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীর একটি দলকে আক্রমণ করে ১৪ জন পাক সেনা ও ৭ জন দালাল খতম করে। পাক বাহিনী আটগর [আটঘর] থেকে ফেরার পথে ইন্দুরকান্দিতে তাদের আক্রমণ করা হয়। এর ৩/৪ দিন পরে টহলদার পাক বাহিনীর উপর আক্রমণ করে বাউকাঠিতে মুক্তি বাহিনী ২ জন হানাদার খতন করে। কিছুদিন আগে পাক বাহিনী ও রাজাকার বাহিনীর একটি বিরাট দল উক্ত অঞ্চল আক্রমণ করে অঞ্চলটিকে ধ্বংসস্তুপে, পরিণত করে। মুক্তি বাহিনী বাধ্য হয়ে ওখান থেকে সরে গিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। বর্তমানে রাজাকার ও মিলিটারীর মিলিত বাহিনী অঞ্চলটির উপর অকথ্য নির্যাতন চালাচ্ছে। যুবকদের জোর করে ধরে নিয়ে রাজাকারে নাম দিচ্ছে।
তবুও বিভিন্ন প্রকার অসুবিধার মধ্যেও মুক্তিবাহিনী তাদের শক্তি বাড়িয়ে চলছে এবং দালালদের খতম করে। অতি শীঘ্রই মুক্তি বাহিনী হানাদার ও তাদের দালালদের সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করতে সমর্থ হবে।
বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১:১ ॥ ৪ আগষ্ট ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!