You dont have javascript enabled! Please enable it!

আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশারদ ঢাকায়
আর এক আইকম্যান রবার্ট জ্যাকসন

কে এই ব্যক্তিটি? জ্যাকসন নামে যিনি কুখ্যাত? নাজীবাহিনীর হত্যা বিশেষজ্ঞ আইকম্যান-এর উত্তরসূরী রবার্ট জ্যাকসন?
আধুনিক উপনিবেশবাদের প্রধান পাণ্ডা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ও সরকারী কর্মচারী রবার্ট জ্যাকসন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে গণহত্যায় সহায়তা করেছেন। আন্তর্জাতিক গণহত্যা বিশারদ “কীলার জ্যাক” নামে তাকে উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশে হত্যা, ধ্বংস ও গণহত্যায় তার ভয়াবহ ভূমিকা ছিল। ২৫শে মার্চের হত্যাযজ্ঞের পূর্বেই জ্যাকসন ঢাকায় ছিলেন এবং ইসলামাবাদ ও জেনারেলদের সাথে তার যোগাযোগ ছিল প্রাত্যহিক। এ সমস্ত তথ্য আজ মার্কিন মুলুক থেকেই প্রকাশ পাচ্ছে।
সিনেটর কেনেডী সম্প্রতি নিউ ইয়র্কে রবার্ট জ্যাকসন সম্পর্কিত তথ্য বিশ্বের নিকট প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছিলেন যে, জ্যাকসনকে পুলিশ বিশেষজ্ঞ রূপে পুনরায় ঢাকায় প্রেরণ করা হচ্ছে। অপর একটি খবর থেকে প্রকাশ, ‘জল্লাদ জ্যাক’ বাংলাদেশে হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে পুনরায় ঢাকা পৌঁছছেন।
বাংলাদেশে গণহত্যার সাথে বিশেভাবে জড়িত এবং বাছাই করা ব্যক্তিদের হত্যার পরিকল্পনাকারী রবার্ট জ্যাকসনকে মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার পুলিশ- নীতির বিশেষজ্ঞ রূপে দীর্ঘ দিন পূর্বে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়েছিল। সে সময় তিনি প্রকাশ্যে সামরিক জান্তার পুলিশের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছিলেন বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে জ্যাকসন ঢাকাস্থ মার্কিন-কনস্যুলেটে একটি গোপন দফতর খুলে চক্রান্তমূলক কাজে লিপ্ত ছিলেন। তিনি কালক্রমে কনস্যুলেটে এতোটা শক্তিশালী হয়ে উঠেন যে, কনসাল জেনারেল ব্লাডের সাথে তার ক্ষমতায় লড়াই পর্যন্ত হয়। জ্যাকসনের এই ক্ষমতা ‘প্যান্টাগণ’ জুগিয়েছিল বলে আজ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে নানা সাহায্য সংস্থা ও সেবা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এভাবে বিশেষজ্ঞদের আচ্ছাদনে গুপ্তচর ও হত্যার পরিকল্পনাকারীরা প্রবেশ করে। রবার্ট জ্যাকসন সে ধরনের একজন ক্রীড়নক।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাধারণ মানুষে রক্তে যার হস্তরঞ্জিত, সেই জ্যাকসনই বাংলাদেশে নির্বাচিত হত্যার তালিকা প্রস্তুত করে সেনাপতিদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এই জল্লাদ জ্যাকই দক্ষিণ ভিয়েতনাম ও ব্রাজিল সরকারকে হত্যা ও ধ্বংসের পরিকল্পনা করে দেন। উক্ত দু’টি দেশে জ্যাকসন পরিকল্পিত সংস্থা নরহত্যা ও ধ্বংস দীর্ঘ দিন অব্যাহত রাখে।
একটি বিদেশী পত্রিকা গণহত্যা বিশেষজ্ঞ জ্যাকসনের ঢাকায় অবস্থান কালে যে বিভীষিকাময় কার্যক্রমের সাথে লিপ্ত ছিলেন, তা’ উদ্ঘাটন করেছে। পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে : “পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে গেলে যাদের যাদের হত্যা করা হবে, তার একটা দীর্ঘ তালিকা তিনি প্রস্তুত করেন। জ্যাকসন আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে ইসলামাবাদকে উপদেশ দিতেন। এই ব্যক্তির পরিকল্পনা উত্তমরূপে কার্যকারী হয়। ২৫শে মার্চ গণহত্যা আরম্ভ করার সময় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী তারই তালিকা অনুযায়ী বেছে বেছে বিশেষ বিশেষ শ্রেণীর ব্যক্তিদের হত্যায় লিপ্ত হয়।”
উল্লেখ্য যে, ১৯৬০ সাল থেকেই ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেলের সম্প্রসারিত অফিসের নামে শাহবাগ হোটেলের একটি ‘স্যুটে’ একটি গোপন অফিস ছিল। উক্ত গুপ্ত অফিসের উচ্চপদস্থ অফিসার জনাব ফরিদউদ্দিন আহমদে ১৯৬৪ সালের দিকে আকস্মিক ভাবে চাকুরী ছেড়ে দেন। তিনিই প্রথম প্রকাশ করেন যে, কতিপয় মার্কিন অফিসার সমস্ত গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি নেতা, গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মী, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী এবং অন্যান্য ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আলোকচিত্র, জীবনী ও কর্মতৎপরতা সম্পর্কে রিপোর্ট সংগ্রহ করে গোপন কক্ষে রাখা হয়। জনাব ফরিদ স্থানীয় একটি দৈনিকে সহকারী সম্পাদক রূপে কাজ পান। কিন্তু এই সমস্ত তথ্য সম্বলিত একটি পুস্তক প্রকাশ করতে তিনি ব্যর্থ হন-কোন প্রকাশক ছাপাতে চাননি।
শাহবাগ হোটেলে গুপ্তচর বৃত্তির কাহিনী বিভিন্ন মহলে ছড়িয়ে পড়ার পর মতিঝিলস্থ আদমজী কোর্টে অবস্থিত কনস্যুলেট অফিসে গুপ্ত অফিসটি সরিয়ে নেয়া হয়। জ্যাকসন শেষ অবধি এই অফিসের সাথেই সম্পর্কিত ছিলেন। জ্যাকসন একাই নন, তার সঙ্গে আরো তিন জন সহকারী জড়িত।
হত্যার সহায়ক ও গণহত্যায় পরিকল্পনাকারী এই কুখ্যাত ব্যক্তিটি দক্ষিণ ভিয়েতনামে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড অব্যাহত রাখার উদেশ্যে “অপারেশন ফিনিক্স” নামক একটি মানবতা বিরোধী প্রতিষ্ঠানের জন্ম দেন। জনৈক মার্কিন সিনেটর এই ধিকৃত ‘ফিনিক্স’-কে “দক্ষিণ ভিয়েতনামে রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যার মাধ্যমে ব্যাপক ভাবে উচ্ছেদ সাধনের কার্যক্রম” বলে উল্লেখ করেছেন। সমস্ত বিপ্লবী ঘাঁটি ধ্বংস এবং মুক্তি ফ্রন্টের সাথে সম্পর্কিত সকল ব্যক্তিকে হত্যাই ছিল জ্যাকসনের ‘ফিনিক্স অপারেশনের’ মূল লক্ষ্য। এক সময় মার্কিন সিনেট সাব-কমিটির জনৈক সদস্য ভিয়েতনাম সফর করে এসে বলেছিলেন যে, উক্ত ‘অপারেশন ফিনিক্স’ কার্যকরী করে পনের হাজার সায়গণ সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং অনেককে নিক্ষেপ করা হয়েছে ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে’। জ্যাকসন, যাকে বলা হয় ‘জল্লাদ জ্যাক’- ব্রাজিলে পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর লোক নিয়ে একটি আধা-সামরিক সংস্থা গঠন করেন। উক্ত দেশে পরিকল্পিত হত্যানুষ্ঠানের জন্যে দায়ী এই সংস্থাটির নাম “ডোপস্”। জ্যাকসন প্রতিষ্ঠিত ‘ডোপস্’ রাতের অন্ধকারে রাজনৈতিক বিরোধীদের নৃশংস ভাবে হত্যার অভিযান চালাতো। ভাড়াটিয়া হত্যাকারী জ্যাক ব্রাজিলের কর্তৃপক্ষকেও হত্যার জন্যে একটি দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। তদুপরি “সত্য উদ্ঘাটনের” নামে জ্যাক নির্দেশিত নয়া পদ্ধতিতে রাজনৈতিক কর্মীদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার চালান হতো। এই সমস্ত হত্যায় শিহরণ মূলক কাহিনী শুনে বিশ্বস্তম্ভিত হয়ে পড়ে-শেষ পর্যন্ত পোপের হস্তক্ষেপ দাবী করা হয়।
সেই ঘৃণ্য জল্লাদটি পুনরায় ঢাকায় ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তার নাম ও কার্যক্রম আন্তর্জাতিক ভাবে প্রকাশ পাওয়ায় তিনি হয়তো এবার বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে হত্যার পরিকল্পনা ফ্যাক্টরী করবেন। দক্ষিণ ভিয়েতনামে প্রায় সাত লক্ষ বৈদেশিক সৈন্য ও ঘাঁটি এবং তাঁবেদার সরকার ছিল। আর ব্রাজিলে ছিল মার্কিনযুক্ত রাষ্ট্রের পদলেহী সরকার। কিন্তু সেক্ষেত্রে ঢাকা তথা বাংলাদেশের বিদ্রোহী মাটি যে জ্যাকসনদের জন্যে আর নিরাপদ নয়, সেকথা উচ্চারণের অপেক্ষা রাখে না।
মুক্তিবাহিনীর সেনারা আজ খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই সব রক্ত পিপাসু কুকুর ও হায়না-যারা হত্যা করেছে, আর যারা হত্যার সহায়ক।
জয়বাংলা ॥ ১ : ১৪ ॥ ১৩ আগস্ট, ১৯৭১

সূত্র: আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ . ১ম খণ্ড – মুনতাসীর মামুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!